বিদেশি বিনিয়োগ

বৈশ্বিক বিনিয়োগপ্রবাহে ভাটা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগপ্রবাহ (এফডিআই) বেড়েছে। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে এসে বাংলাদেশে এফডিআই–প্রবাহ বেড়েছে ৬৮ শতাংশ। যদিও পরিমাণের দিক দিয়ে এই বিনিয়োগ এতটাই নগণ্য যে অধিক বিনিয়োগপ্রাপ্ত দেশগুলোর কাছাকাছি যেতেও আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। 

২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পেরেছে ভারত। এর পরিমাণ ৪ হাজার ২৮৮ কোটি ডলার, যা এ অঞ্চলের আটটি দেশের মধ্যে সর্বাধিক। দক্ষিণ এশিয়ায় মোট এফডিআইয়ে ৭৮ শতাংশ পেয়েছে ভারত। আর ৩৬১ কোটি ডলার বা ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পেয়ে বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি পাঁচটি দেশের চেয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণে আমরা এগিয়ে আছি ঠিকই, কিন্তু ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে ব্যবধানটি আকাশ-পাতাল। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি উন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থা থাকা দরকার। বাংলাদেশে একধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও অন্যান্য দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। শিল্পকারখানার জন্য যে জমি দরকার, তা সহজে পাওয়ার উপায় নেই। অন্যদিকে সরকারি অনুমোদন নিতে উদ্যোক্তাদের ঘাটে ঘাটে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এসব কারণেই বিশ্বব্যাংকের সহজ ব্যবসার সূচকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। 

একসময় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ছিল প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ। বর্তমানে চীন সেই স্থান দখল করেছে। নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্যের অবস্থান যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যে ৩৬০ কোটি ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ পেয়েছে, এর মধ্যে এককভাবে চীনেরই ১০৩ কোটি ডলার। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন। কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে অনেক ফারাক। কোনো এলাকাকে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা কিংবা জমি অধিগ্রহণ করলেই তো হবে না। অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নও নিশ্চিত করতে হবে। 

বিদেশি বিনিয়োগ আনতে যখন সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন দেশীয়ও বিনিয়োগের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। বেসরকারি বিনিয়োগের হার একই জায়গায় থমকে আছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর অন্যতম প্রধান শর্ত আস্থার পরিবেশ। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের ধস ও শেয়ারবাজারের নাজুক পরিস্থিতি যে সেই পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা, সেটিও নীতিনির্ধারকদের স্বীকার করতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, অনেক সংগ্রাম করে যখন বাংলাদেশ মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করল, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সমুদ্রসম্পদ আহরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশ কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তীব্র প্রতিযোগিতার বিশ্বে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না। 

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রধান উপাদান হলো সস্তা শ্রম। কিন্তু এখন শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে খুব বেশি বিনিয়োগ আনা যাবে না। সে জন্য তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। একই সঙ্গে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, উন্নত অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দূর করতে হবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও। সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, যেসব শিল্প দেশের পুঁজি বাড়াবে এবং অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। বিনিয়োগের পূর্বশর্তগুলো পূরণ না করতে পারলে সরকারের ঘোষিত ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ ফাঁকা আওয়াজ হয়েই থাকবে।