হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি

পবিত্র ধর্মের নামে জঙ্গিগোষ্ঠী যে কতটা ভয়ংকর ও নৃশংস হতে পারে, দুই বছর আগে তারা সেটিই প্রমাণ দিয়েছিল গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে। সেদিন তাদের হাতে জীবন দেন ২২ জন মানুষ, যাঁদের মধ্যে ছিলেন নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয় এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজন বাংলাদেশি নাগরিক। তাঁদের স্বজনদের জানাই আন্তরিক সহমর্মিতা।

হোলি আর্টিজানের নারকীয় হত্যাকাণ্ড যেমন বাংলাদেশের মানুষকে বিচলিত করেছিল, তেমনি এর বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছিল সামাজিক জাগরণ। জঙ্গিবিরোধী অভিযান সফল করতে এই জাগরণ অব্যাহত রাখতে হবে। এটাই হোলি আর্টিজানের শিক্ষা।

জঙ্গিগোষ্ঠী এই হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। একই সঙ্গে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে। আশার কথা, তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। হোলি আর্টিজানের হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ সাময়িক ধাক্কা খেলেও সেসব কাটিয়ে উঠতেও সময় লাগেনি। টুইন টাওয়ার ট্র্যাজেডির পর একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, এক-এগারোর আগের ও পরের পৃথিবী এক থাকবে না। তাঁর কথার প্রতিধ্বনি তুলে আমরাও বলতে চাই, হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির আগের ও পরের বাংলাদেশও এক নয়। এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে যে গণজাগরণ তৈরি হয়েছিল, সেটাই প্রকৃত বাংলাদেশ।

হোলি আর্টিজানে তরুণ ফারাজ আইয়াজ হোসেন যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা শুধু আমাদের নয়, বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে থাকবে। পরিচয় জেনে জঙ্গিরা যখন তাঁকে ছেড়ে দিতে চাইল, তখন তিনি তাঁর সঙ্গে আসা দুই বিদেশি বন্ধুকে না নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর জঙ্গিরা অন্যদের সঙ্গে তাঁকেও হত্যা করে। ফারাজের এই আত্মদান জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শান্তি ও সম্প্রীতির চিরন্তন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির পর সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান জোরদার করায় তাদের তৎপরতা অনেকটাই কমেছে। বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে, অনেকে নিহত হয়েছে। অন্যদিকে বহির্বিশ্বেও জঙ্গিগোষ্ঠী অনেক স্থানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সিরিয়া ও ইরাক থেকে আইএস (ইসলামিক স্টেট) বিতাড়িত হয়েছে। কিন্তু এতে স্বস্তি বা আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কেননা, তারা আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে নতুন করে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে। গতকাল প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী জঙ্গিরা এখনো তৎপর এবং দেশে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জে একজন প্রকাশক হত্যার সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বোঝা যায়, অভিযানের মুখে বেকায়দায় পড়লেও এই গোষ্ঠী সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে অব্যাহত জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও এর বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই জারি রাখার বিকল্প নেই।

গত দুই বছরেও হোলি আর্টিজান হত্যা মামলার তদন্তকাজ শেষ করতে না পারা সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা বলেই বিবেচনা করতে হবে। ঢাকার পুলিশ কমিশনার আগামী সপ্তাহে চার্জশিট জমা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে শুধু তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া নয়, তা যেন শতভাগ নির্ভুল হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অস্পষ্ট বা ভুল তদন্তের কারণে অনেক সময় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। গত কয়েক বছরে জঙ্গিদের হাতে অভিজিৎ, দীপনসহ আরও অনেক মানুষ নিহত হলেও কোনো মামলার তদন্তকাজ শেষ না হওয়া দুঃখজনক।

হোলি আর্টিজানের ঘটনায় জঙ্গিদের হাতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের আমরা ফিরে পাব না। কিন্তু হত্যার নেপথ্যের হোতাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে পারলে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা এই সান্ত্বনাটুকু পাবেন যে অপরাধের বিচার হয়েছে। যেসব বিদেশি মারা গেছেন, তাঁদের স্বজনেরা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতিও আস্থাশীল হবেন।