উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে বলে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, তা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। সংস্থাটির মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ। গত বুধবার প্রকাশিত ২০১৯ সালের এডিবি ডেভেলপমেন্ট আউটলুক আপডেটে এ পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এডিবির হিসাব অনুযায়ী ভারত, চীনসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যখন প্রবৃদ্ধি কমছে, তখন বাংলাদেশ অগ্রগতির ধারায় রয়েছে। এডিবির আউটলুক অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ছাড়া মাত্র দুটি দেশ ৭ বা এর বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এর মধ্যে ভারত ৭ দশমিক ২ এবং তাজিকিস্তান ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এ ছাড়া ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে মোট ১০টি দেশ; যে তালিকায় আছে চীন, মঙ্গোলিয়া, উজবেকিস্তান, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার ও ফিলিপাইন।

 অতীতে সরকারি হিসাবের সঙ্গে উন্নয়ন–সহযোগীদের হিসাবে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যেত এবং এ নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। আশার কথা, সেই
অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশকালে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ফলে বাংলাদেশ সরকার ও এডিবির হিসাবে গরমিল খুবই কম; যদিও বিশ্বব্যাংক কিছুটা রক্ষণশীল হিসাব দিয়ে বলেছে, প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের নিচে থাকবে।

বাংলাদেশে এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি মনমোহন প্রকাশ বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের প্রশংসা করলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে শিল্পের প্রসারণ, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমানো ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। আমাদের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ছে। কিন্তু রপ্তানিকে বহুমুখী করতে না পারলে কিংবা বিদেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে না পারলে এই ধারা ধরে রাখা কঠিন হবে। আমাদের দারিদ্র্যের হার কমলেও এখনো ২১–২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কঠোর দারিদ্র্যের কারণে আমরা এখনো যেমন সব শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করতে পারিনি, তেমনি অনেকে বিদ্যালয়ে গেলেও প্রাথমিক স্তর শেষ হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাজস্ব খাতে সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান বাড়বে, সেখানে শিল্পেরও প্রসার ঘটবে। সরকার শিল্পায়নের লক্ষ্যে সারা দেশে যে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল করেছে, তার সুফল ইতিমধ্যে অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। তবে সরকারি উন্নয়নকাজে যে বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে, সেটি অস্বীকার করা যাবে না। সরকারের সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সেই দুর্নীতির কিছু কিছু চিত্রও প্রকাশিত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে এবং এর সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হলে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করার বিকল্প নেই।

আমাদের উন্নয়ন অনেকটাই শহরমুখী। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে ঢাকামুখী। এ জন্য অর্থনীতির উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে এবং এর সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হলে গ্রাম ও শহরের দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মুখে গ্রামে শহরের সুযোগ দেওয়ার কথা বললেও তাঁদের উন্নয়ন পরিকল্পনা মূলত শহরমুখী। উন্নয়নে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমিয়ে আনতে হলে স্থানীয় সরকার সংস্থার ক্ষমতায়ন অপরিহার্য। এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি ব্যাংকিং খাতে সরকারের গৃহীত সংস্কার কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যথেষ্ট নয়। আরও সংস্কার দরকার। কেননা, ব্যাংকিং খাতকে নড়বড়ে রেখে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুদৃঢ় করা সম্ভব নয়। আশা করি, নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি আমলে নেবেন।