নগরের গণপরিবহন

ঢাকা মহানগরের ভেতরে গণপরিবহনব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা অনেক আগেই গুরুতর রূপ ধারণ করেছে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে মানুষের দুর্ভোগ ও সময়ের অপচয় অস্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছেছে। যন্ত্রচালিত যানবাহনের গতি কমতে কমতে ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটারে নেমেছে, যা মানুষের হাঁটার গতির থেকে সামান্য বেশি। কিন্তু ১২ বছর আগে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। গত বছরের মার্চ মাসে একটি গবেষণার ফল থেকে জানা গিয়েছিল, যানজটের কারণে ঢাকা মহানগরে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টার অপচয় ঘটছে। এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তার পরের প্রায় দেড় বছরে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। রাজধানীর লোকসংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, প্রতি মাসে বিপুলসংখ্যক নতুন যানবাহন বিদ্যমান যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু সড়কের সংখ্যা বাড়ছে না। উপরন্তু মেট্রোরেল স্থাপনের কাজ চলমান থাকা অবস্থায় মহানগরের যানবাহন চলাচলে কোনো উন্নতির আশা করা যাচ্ছে না।

মেট্রোরেল চালু হলে এই পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি ঘটবে বলে অনেকে আশা করছেন। কিন্তু এমন সংশয়বাদী মানুষও আছেন, যাঁরা মনে করছেন, খুব বেশি উন্নতি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, গোটা মহানগরের গণপরিবহনব্যবস্থার সামগ্রিক পরিকল্পনা এখনো অনুপস্থিত; যা কিছু করা হচ্ছে, তা আংশিক এবং অ্যাডহকভিত্তিক। মহানগরীর যানবাহন চলাচলব্যবস্থায় পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা না হলে শুধু অবকাঠামোর সংখ্যা বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। ঢাকা মহানগরের গণপরিবহনের প্রায় পুরোটাই বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে; সরকারি বিআরটিসি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ অতি নগণ্য। বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশি যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় মহানগরের সড়কগুলোতে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে, অনেক মানুষ মারা যায় এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারায়। ঢাকা মহানগরের ভেতরে যানজটের কারণে যেখানে যানবাহনের গতি অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে, সেখানে এত উচ্চ হারে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো বিভিন্ন বাস কোম্পানির মধ্যে বেশি যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা থেকে সৃষ্ট ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা দূর করার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব মেট্রোপলিটন শহরে গণপরিবহন পরিচালনার জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। শহরের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোর চালকদের মধ্যে বেশি যাত্রী তোলার অসুস্থ প্রতিযোগিতার অবসান ঘটাতে একটি রুটের সব বাস একটি কোম্পানির অধীনে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একটি জোনে বা একটি লাইনে বিদ্যমান সব বাস কোম্পানি তাদের বাসগুলো পরিচালনার ভার তুলে দেবে একটি কোম্পানির হাতে এবং সেই কোম্পানি বাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে মুনাফা ভাগাভাগি করবে। ভিন্ন ভিন্ন জোন বা লাইনের বাসগুলোর রং হবে ভিন্ন ভিন্ন। পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশের মেট্রোপলিটন শহরগুলোর বাস সার্ভিস ফ্র্যাঞ্চাইজিং ব্যবস্থায়ই পরিচালিত হয়। ঢাকা মহানগরের জন্য এই ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। যত দ্রুত সম্ভব হাইকোর্টের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হোক। এ জন্য বড় সক্রিয় তৎপরতা প্রয়োজন; বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলোর মালিক ও শ্রমিকদের উচিত এই উদ্যোগের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো। যেভাবে চলছে সেভাবেই যদি কোনো মহলের কায়েমি স্বার্থ রক্ষিত হয়ে থাকে এবং তারা যদি এই অবস্থার পরিবর্তন না চায়, তাহলে তাদের উচিত হবে আদালতের নির্দেশনাটির যুক্তি ও জনস্বার্থে এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা।

শুধু ঢাকা মহানগরে নয়, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সব মেট্রোপলিটন শহরেই ফ্র্যাঞ্চাইজিং ব্যবস্থায় বাস সার্ভিস চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হোক। ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে বিআরটিসির দ্বিতল বাসগুলো গণপরিবহনের ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।