শেয়ারবাজারের মন্দ বছর

২০১৯ সালের শুরুতে শেয়ারবাজারে বেশ চাঙাভাব লক্ষ করা গেলেও বছরের শেষে দর তলানিতে এসে ঠেকেছে। গত ১১ মাসে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শেয়ারবাজারের দুরবস্থা কাটাতে একটিও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নীতিনির্ধারকেরা যতই শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনার কথা বলেন, ততই পরিস্থিতি আরও নাজুক হচ্ছে। এই ব্যর্থতার জবাব কী?

রাজনৈতিক মহলে একটি কথা প্রচলিত আছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজারে ধস নামে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে সরকারের যথেষ্ট সফলতা সত্ত্বেও এই বদনাম তারা এখন পর্যন্ত ঘোচাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালে একবার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়েছিল, ২০১০ সালেও আরেকবার শেয়ারবাজারের খেলোয়াড়েরা বাজার কারসাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এবং সর্বস্বান্ত হয়েছেন খুদে বিনিয়োগকারীরা। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। তাদের প্রথম সুপারিশ ছিল বাজার কারসাজি করে যাঁরা কোটি কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ ছাড়া ওই কমিশন অধিকতর তদন্তেরও সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, ওই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত কারও বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারেনি কিংবা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। অন্যায় করে যখন বাজার কারসাজির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা পার পেয়ে যান, তখন বাজারে স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না।

শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল এসইসির চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তনসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুনর্গঠন। কিন্তু এমন ব্যক্তিকে কমিশন প্রধানের পদে বসানো হয়েছে, যাঁর ওপর বাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তেমন আস্থা নেই। তিনি শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা না রেখে যাঁরা বাজার কারসাজি করছেন, তাঁদের হয়ে কাজ করছেন বলেও অনেকের অভিযোগ। এর ফলে শেয়ারবাজার থেকে ব্যাপক হারে পুঁজি প্রত্যাহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশের শেয়ারবাজারে কিছু না কিছু কারসাজি হয়। কিন্তু আমাদের শেয়ারবাজারের কোটারি গোষ্ঠী সেই কারসাজিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থা কোনোভাবে চলতে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে বাজারে নতুন করে ভালো কোনো কোম্পানি আসছে না বা আনার উদ্যোগও নেই। শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা দুর্বল কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসছেন, যাতে বিনিয়োগ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হচ্ছেন এবং লাভবান হচ্ছে কোটারি গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেট। তাই, শেয়ারবাজার চাঙা করতে ভালো কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসার বিকল্প নেই।

শেয়ারবাজার চাঙা করতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও প্রণোদনাও কাজে আসেনি কোটারি গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেটের কারণে। তাই শেয়ারবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এই কোটারি গোষ্ঠী ভেঙে দিতে হবে। শেয়ারবাজারে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধার করতে হলে এসইসির পুনর্গঠন জরুরি। বর্তমানে কমিশনে এমন সদস্যও আছেন, শেয়ারবাজার সম্পর্কে যাঁর ন্যূনতম ধারণা নেই। এই অনভিজ্ঞ সদস্যদের প্রভাবিত করে কোটারি গোষ্ঠী স্বার্থ হাসিল করে থাকে। চেয়ারম্যান পদে এমন ব্যক্তিকে বসাতে হবে, যিনি শুধু সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন না; অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নেবেন। বাজারের পরিধি বাড়াতে হলে দুই স্টক এক্সচেঞ্জে বর্তমান সদস্যদের বাইরে এ ব্যবসার সঙ্গে যাতে অন্যরাও জড়িত হতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করতে হবে।

অর্থনীতির সাধারণ সূত্র বলে, টেকসই অর্থনীতির দেশে শেয়ারবাজারও চাঙা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশেই ব্যতিক্রম। মন্ত্রী-আমলারা শেয়ারবাজার নিয়ে বিস্তর কথা বলেছেন। নতুন বছরে তাঁরা শুধু কথা না বলে বাস্তবে কিছু করে দেখাবেন, আশা করি।