প্রণোদনার লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন

মানুষ ও সমাজের প্রয়োজনে মানুষই অর্থনীতি সৃষ্টি করে। অর্থনীতির প্রয়োজনে মানুষ নয়। তবু কোনো কোনো সময় মানুষকে এবং মানুষের জীবনকে অর্থনীতির প্রয়োজনে বলি দেওয়া হয়। যে সমাজ ও অর্থনীতিতে তা করা হয় তা মানুষের অর্থনীতি নয়, ওটি উদ্বৃত্ত শোষণকারীদের অর্থনীতি ও সমাজ। ইতিহাসে তার ভুরি ভুরি ঘটনা রয়েছে। সামগ্রিক শিল্পায়ন, শিল্প বিকাশ ও শিল্প ব্যবস্থাপনায় পুঁজি, সংগঠনসহ সব উদ্যোগ-দক্ষতার সঙ্গে মানুষ তথা শ্রমশক্তির সংযোগকে গৌণ করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। সুস্থ, সন্তুষ্ট, দক্ষ ও সুশৃঙ্খল শ্রমশক্তির অনুপস্থিতিতে সুস্থ শিল্প বিকাশ সম্ভব হয় না।

আমাদের শিল্প উদ্যোক্তারা দেশে বেকার জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে কম ব্যয়ে অধিক শ্রমের জোগান পাওয়ায় শ্রমশক্তির সংকটটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করছেন না। তাই কোনো কোনো ‘শিল্পপতি’ শ্রমিকদের সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে মজুরি ও অন্যান্য প্রণোদনা দেওয়াকে শ্রমিকের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য মনে করেন। শ্রমের সঠিক মজুরি না দিয়ে লাভের অঙ্ক বাড়াতে উৎসাহিত হন, অতি মুনাফা অর্জন করে তা অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করে বা কোনো কোনো দুর্জন বিদেশে অর্থ পাচার করেন। যাঁরা এ জাতীয় মানসিকতা থেকে থেকে মিল-কারখানা চালান, তাঁরা আসলে শিল্পবান্ধব উদ্যোক্তা নন। তাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে দেশে শিল্প ও অর্থনীতি বিকাশের শত্রু। শ্রমিক অসন্তোষ ও রুগ্‌ণ শ্রমিক নিয়ে সুস্থ শিল্প পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে শ্রমঘন শিল্পের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সত্য। তেমনি রুগ্‌ণ, অসহায় ও অভুক্ত মানুষ নিয়ে করা যায় না সুস্থ ও স্থিতিশীল সমাজ।

বর্তমান করোনা মহাসংকটকাল আমাদের অর্থনীতি চিন্তক ও শিল্প বাণিজ্যের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি অ্যাসিড টেস্টের সময়। যাঁরা দশ-বিশ বছর ধরে পোশাকসহ নানা শিল্প ও অন্যান্য শিল্প-বাণিজ্য চালাচ্ছেন, তাঁরা সংকটকালে দুই বা তিন মাস শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিনা শ্রমে মজুরি পরিশোধ অব্যাহত রাখতে পারেন না, তাতে দেউলিয়া হয়ে শিল্প-বাণিজ্য কাঠামো ভেঙে পড়বে বা কলকারখানা ‘লে-অফ’ করতে হবে, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তাহলে এত দিনের মুনাফা কোথায় গেল? প্রশ্নটি শুনতে স্বাভাবিকভাবে কারও ভালো লাগার কথা নয়। শিল্প ও শ্রমিক বাঁচানোর জন্য এখনই সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা জরুরি ও অত্যাবশ্যক, তা অন্তত আমি মনে করি না।

এখনকার সংকটটা শুধু শিল্পের বা শ্রমিকের নয়। সংকট বিশ্বব্যাপী মানব অস্তিত্বের। সংকট ও শঙ্কা জীবনের। সংকটের কেন্দ্রবিন্দু স্বাস্থ্য ও জীবনঝুঁকি। তাই সরকার ও সমাজ নিবেদিত হবে জীবন সংকট ও স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায়। শুধু শিল্প নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সার্বিক জীবনযাত্রা সংকটাপন্ন। সামগ্রিক অর্থনীতি বিপদাপন্ন। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজনীন। তাই এ সংকট মোকাবিলার অগ্রাধিকার তালিকা করলে প্রথমে কিন্তু আসবে মানুষের জীবনের প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ। অর্থনীতির প্রশ্ন হবে দ্বিতীয়। শিল্প তা পোশাক, চামড়া, যা–ই হোক আসবে তৃতীয় স্থানে। আমাদের জিডিপির কত শতাংশ পোশাকশিল্প থেকে আসে, সর্বাধিক প্রায় ৬ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক সেবা খাত, কৃষি, অপ্রাতিষ্ঠানিক মাঝারি ও ছোট শিল্প, ব্যবসা এবং সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী অভিবাসী শ্রমিক; তাঁদের বিষয়টি কীভাবে ভাবা হবে। শিল্প-বাণিজ্যের প্রণোদনা প্যাকেজের ফোকাস দেখে বিষয়টি ভাবতে হলো।

সংকট যেহেতু বৈশ্বিক, তাই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো দেখা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো কট্টর বাজারবাদী দেশ জিডিপির ১০ শতাংশ অর্থাৎ, দুই ট্রিলিয়ন ডলার করোনা সংকটে বরাদ্দ দিয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত জিডিপির ১ শতাংশ অর্থাৎ, ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি রুপি এ খাতে বরাদ্দ করেছে। কোরিয়া, জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের বিষয় খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নয়। এ ছয়টি দেশের কারও সঙ্গেই আমাদের তুলনা হয় না। কারণ, তাদের অর্থনীতি বিশেষ করে স্বাস্থ্য অবকাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী।

আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভীষণ রকম ভঙ্গুর। গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা শহরের আড়াই শ শয্যার হাসপাতাল এবং ঢাকার হাতে গোনা কটি বাদে দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এ সংকট মোকাবিলার জন্য কতটুকু উপযোগী। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ ভবন–সংশ্লিষ্ট এবং রাজস্ব ব্যয়ের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হয়। এখানে চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন কতটুকু মেটানো সম্ভব। স্বাভাবিক সময়ে টেনেটুনে নেওয়া গেলেও এ জাতীয় সংকটে তা শুধু অপ্রতুলই নয়, অথই সমুদ্রে সুরক্ষাবিহীন সাঁতার।

এ পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা, যাঁরা সারা বিশ্বে নন্দিত, তাঁরা ভারত সরকারকে যে পরামর্শ দিচ্ছেন, তার দিকে একটু তাকানো যেতে পারে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অভিজিৎ ব্যানার্জি, ভারত সরকারের সাবেক অর্থবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়াম (যিনি এখন অক্সফোর্ডের অধ্যাপক), দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের কৌশিক বসু (যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে), স্ট্যানফোর্ডের অমিত সারু, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান রজনীশ কুমার সবার একটি টেলিকনফারেন্স দেখলাম ড. প্রণয় রায়ের সঞ্চালনায়। এ কনফারেন্স থেকে ভারত সরকারের প্রতি তাঁদের পরামর্শ হলো, অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প ও মুদ্রানীতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ মুহূর্তের প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয়। সামনের তিন–চার মাসের একক বিবেচনা হবে মানুষের জীবন রক্ষা।

এ সংকট সফলভাবে উতরানো সম্ভব হলে তার পরের ছয় থেকে এক বছরের মধ্যে অর্থনীতির পুনর্জাগরণ (Economic Recovery) সম্ভব। কিন্তু করোনা সংকট মোকাবিলায় বিলম্ব বা কমতি হলে তা সহজে পূরণ হবে না। তাই তাঁরা ভারত সরকারকে করোনা বরাদ্দ বর্তমান বরাদ্দের তিন গুণ অর্থাৎ ছয় লাখ কোটি তথা জিডিপির ৪ থেকে ৫ শতাংশ করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ বরাদ্দ ব্যয়ের প্রধান দুটি খাত হবে, (১) স্বাস্থ্য খাত (২) উদ্বৃত্তবিহীন মানুষের দোরগোড়ায় খাদ্য সরবরাহ।

আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদেরা এ মুহূর্তে সরকারকে কোনো পরামর্শ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন কি না জানি না। একজন অ-অর্থনীতিবিদ হয়েও আমার ধারণা, সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ফোকাস অর্থনীতি, এ ফোকাসটি আরও বেশি মানবকেন্দ্রিক হওয়া উচিত ছিল। করোনাকালীন ও করোনা–পরবর্তী সংকট সামনে রেখে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকে এ আপৎকালে তিন গুণ বাড়িয়ে আগামী অন্তত দুটি বাজেটে অগ্রাধিকার খাত হিসাবে স্বাস্থ্য খাতকে বিবেচনায় রাখা উচিত। বিনিয়োগ বরাদ্দ ‘ভবন’ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে কম খরচ করে আধুনিক চিকিৎসাসেবাসামগ্রী এবং রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে বেতনের সমপরিমাণ অর্থ সেবায় ব্যয় হওয়া উচিত।

ওষুধ শিল্প ও ওষুধের ব্যবহারে ওষুধনীতির কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। প্রয়োজন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা ও অতি মুনাফার প্রবণতার ওপর কঠোর নজরদারি। দেশের স্বাস্থ্য প্রফেশনাল এবং অর্থনীতিবিদেরা যৌথভাবে এ লক্ষ্যে কাজ করতে পারেন। বিএমএ, স্বাচিব, ড্যাব, অন্যান্য স্বাস্থ্য প্রফেশনালদের সংগঠনসমূহ এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি একযোগে এগিয়ে এসে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কিছু বরাদ্দ কাটছাঁট করে এবং সর্বত্র কৃচ্ছ্রতার মাধ্যমে সাশ্রয় করে তা স্বাস্থ্য খাতে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টাও অন্তর্বর্তী সময়ে কাজে লাগানো যায়।

সবশেষে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ এবং করোনা মোকাবিলা বরাদ্দের পুনর্বিবেচনার আকুল আহ্বান জানাই। এটিকে অর্থ ও শিল্প-বাণিজ্যকেন্দ্রিক না করে দুর্যোগের সময়কে বিবেচনায় নিয়ে মানবকেন্দ্রিক করার বিষয়টিও বিবেচনার আহ্বান থাকল।

তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ, স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ও কুমিল্লায় অবস্থিত ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটির উপাচার্য।