করোনার কাগুজে হিসাব দেখে লাভ নেই

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

আমাদের দেশে খুব প্রচলিত একটা ধারণা হচ্ছে, আমরা প্রতিদিন এত বেশি ভেজালের মধ্যে থাকি যে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবেই অনেক বেশি। বাতাসে সিসা, মাছে ফরমালিন, ফলে কার্বাইড, চাল আর ডিম নাকি প্লাস্টিকের পাওয়া যায় আজকাল, এমনকি মসলাতেও ভেজালের শেষ নেই। সেই একই যুক্তি ব্যবহার করে এই করোনাকালেও মানুষ বলাবলি করছে, করোনা আমাদের কিছু করতে পারবে না। আর কেউ কেউ তো আরেক কাঠি সরেস-‘আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী’। করোনা নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্‌ভ্রান্ত, এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রতিনিয়ত তাদের গাইডলাইন পরিবর্তন করছে। করোনা যতটা না সিস্টেমকে ভেঙে ফেলেছে, তার চেয়ে বেশি সিস্টেমের অব্যবস্থাপনাকে সবার সামনে তুলে এনেছে। এই সময়ে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত যেমন অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে, তেমনি একটা ভুল সিদ্ধান্ত হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে।

করোনা নিয়ে সারা পৃথিবীতে যেসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে তার মধ্যে ‘কী পরিমাণ টেস্ট করা উচিত’ এবং ‘বিভিন্ন দেশে মৃত্যুহারের অস্বাভাবিক পার্থক্য’—এই দুটি বিষয় বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নত দেশগুলোতে মৃত্যুহার অস্বাভাবিক বেশি। আমরা যদি ইতালি, ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর তুলনা করি, তাহলে এটা খুব বেশি চোখে পড়ে। কেউ কেউ বলেন, দরিদ্র দেশের মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। কেউ কেউ ধারণা করেন, এই উপমহাদেশে ভাইরাসের যে মিউটেশনগুলো এসেছে, সেটা ইউরোপ, আমেরিকার মতো ভয়ংকর না, আবার কেউ কেউ বলেন, আমাদের ব্যবস্থাপনা এতটাই ভালো যে আমরা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছি। আসলেই কি ব্যাপারটা তাই?

প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, যদিও পৃথিবীতে এই ভাইরাসের অনেকগুলো মিউটেশন হয়েছে, কিন্তু এ রকম কোনো তথ্য এখনো আসেনি যে কোনো একটা বিশেষ মিউটেশনের ভাইরাস অনেক বেশি ক্ষতিকর আর বাকিগুলো তেমন ক্ষতিকর নয়। যেমন আমাদের দেশের কথাই যদি ধরি, আমাদের দেশে এই ভাইরাস এসেছে মূলত ইউরোপ থেকে। যে ভাইরাসে পুরো ইউরোপ নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে, সেই ভাইরাস ১০ ঘণ্টার প্লেন ভ্রমণ করে এই উপমহাদেশে এসে একদম রূপ বদলে ফেলেছে, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব না হলেও খুবই অসংগত। আমরা যদি বিভিন্ন দেশের টেস্ট সংখ্যা এবং সরকারি মৃত্যুহার নিয়ে বিশ্লেষণ করি, তাহলে সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অনেক তথ্য দেখতে পাই।

একটা দেশ কতটা উন্নত, তার সরকারব্যবস্থা কেমন, কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত, ওই দেশের পরিসংখ্যান কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেটা বোঝার জন্য বিশ্বের দেশগুলোকে (১৫৬টি) কয়েকটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে র‍্যাঙ্কিং করা যায়। যেমন ১) জিডিপি পার ক্যাপিটা (সহজ কথায় দেশটা কতটা উন্নত/ধনী) ২) ডেমোক্রেসি পারসেপশন ইনডেক্স (অর্থাৎ ওই দেশে গণতন্ত্রের আসল অবস্থা কী, সেটা কি নামমাত্র গণতন্ত্র নাকি কাজেও গণতন্ত্র) ৩) করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (ওই দেশে দুর্নীতির পরিমাণ কেমন)। প্রতিটা ক্ষেত্রে আলাদাভাবে দেশগুলোর র‍্যাঙ্কিং করে সবগুলো যোগ করলে দেশগুলোর একটা সামগ্রিক অবস্থান বোঝা যায়। যেমন নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক একদম ওপরের দিকে, আবার কঙ্গোর অবস্থান একদম শেষে, আর বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬তম। অর্থাৎ যে দেশ যত ওপরের দিকে, সেই দেশ তত বেশি উন্নত, বেশি গণতান্ত্রিক এবং কম দুর্নীতিগ্রস্ত। এবার এই র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী দেশগুলোকে সাজিয়ে, প্রতিটি দেশের টেস্টের বিপরীতে পজিটিভ রোগী এবং পজিটিভ রোগীর বিপরীতে মৃত্যুহারকে একটা গ্রাফে সাজালে দেখা যাবে যে উন্নত এবং কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে যে পরিমাণ টেস্ট করা হয়েছে, সেখানে শতকরা পজিটিভ কম, কিন্তু শতকরা মৃত্যুহার বেশি। আর যে দেশ যত গরিব, যত দুর্নীতিগ্রস্ত, সেখানে টেস্টের তুলনায় শতকরা পজিটিভ অনেক বেশি, কিন্তু শতকরা মৃত্যুহার অনেক কম। অর্থাৎ অনুন্নত, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে টেস্টের পজিটিভের শতাংশ অনেক বেশি হলেও মৃত্যুহারের শতাংশ অনেক কম, যা হওয়ার কথা ঠিক তার উল্টো।

এই অপ্রত্যাশিত উল্টো ফলাফলের কী কারণ হতে পারে?
আসলে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনুন্নত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে টেস্ট করার সামর্থ্য কম, কন্টাক্ট ট্রেসিং করা দুরূহ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, এই সব কারণে তাই টেস্টগুলোর মধ্যে বেশি পজিটিভ আসে। উদাহরণ দিলে বলা যায়, কানাডার অন্টারিও প্রদেশের জনসংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ আর সেখানে এখন দৈনিক ২০ হাজারের মতো টেস্ট করা হয়, যার মধ্যে পজিটিভ আসে ২ শতাংশের কম, আর বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৬–১৭ কোটি, আর দৈনিক টেস্ট করা হয় মাত্র ১৩–১৪ হাজার, ফলে পজিটিভ আসে ২০ শতাংশের বেশি।

মৃত্যুহারের ব্যাপারটা খুব সাবধানে ব্যাখ্যা করতে হবে, কারণ এখানে কয়েকটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, উন্নত দেশগুলোতে এমনিতে টেস্ট করুক বা না করুক, কারও করোনায় মৃত্যু হলে সেটা অবশ্যই ধরা পড়বে। পক্ষান্তরে অনুন্নত দেশগুলোতে গ্রামেগঞ্জে, বস্তিতে কে কখন মারা যায়, তার খবর কে রাখে? আমাদের মতো দেশে তো এমনিতেই ডেথ সার্টিফিকেটের কোনো বালাই নেই, সেখানে এখন হঠাৎ করে সারা দেশে কে কী কারণে মারা যাচ্ছে, সেটা কে খবর রাখবে? নিজের আশপাশেই দেখুন না, আপনার সেই রকম প্রভাব প্রতিপত্তি না থাকলে তো আপনি টেস্টই করাতে পারবেন না, সেখানে একজন দিনমজুর, একজন রিকশাওয়ালা, একজন শ্রমিক কীভাবে টেস্ট করাবেন?

দ্বিতীয়ত, একটা কথা অনেকে বলেন, যদি আসলেই এ রকম অনেক মানুষ মারা যেত, তাহলে রাস্তাঘাটে লাশ পড়ে থাকত। এ ব্যাপারে প্রথমে যেটা বুঝতে হবে করোনায় আসলে মৃত্যুহার কত? আমেরিকার সিডিসির মতে, তাদের বেস্ট অ্যাজাম্পশান হচ্ছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, অর্থাৎ ১ হাজার জন আক্রান্ত হলে (শনাক্ত নয় কিন্তু), ৪ জন মানুষ মারা যাবে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে ইতালি (১৪ দশমিক ৪ শতাংশ), স্পেন (৯ দশমিক ৪ শতাংশ), ফ্রান্সে (১৮ দশমিক ৯ শতাংশ) মৃত্যুহার এত বেশি কেন? এর কারণ হচ্ছে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হলেও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, এমনি এমনিই ভালো হয়ে যায়, তাই এই সংখ্যাগুলো হচ্ছে শনাক্তের কত শতাংশ মারা গেছে তার হিসাব, প্রকৃত আক্রান্তের নয়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই কথার পক্ষে আর কোনো যুক্তি আছে কি না? আছে। আমাদের এমন কিছু উন্নত দেশ দেখতে হবে যেখানে রোগীর সংখ্যা কম, যেমন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর। রোগীর সংখ্যা কম হলে তারা লক্ষণযুক্ত রোগী এবং তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে তাদের সংস্পর্শে আসা মানুষজনের টেস্ট করতে পারে, ফলে সেখানে শনাক্ত এবং আক্রান্ত খুব কাছাকাছি। যেমন অস্ট্রেলিয়াতে ৭ হাজারের মতো রোগী আর মৃত্যুহার ১ দশমিক ৪ শতাংশ, নিউজিল্যান্ডে ১ হাজার ৫০০–এর মতো রোগী আর মৃত্যুহার ১ দশমিক ৫ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৩৪ হাজারের মতো রোগী আর মৃত্যুহার মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। এসব দেশের পরিসংখ্যান কিন্তু নর্থ কোরিয়ার মতো ভুয়া না, অনেক বিশ্বাসযোগ্য। তাহলে বাকি দেশ, মানে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সের পরিসংখ্যান কি ভুয়া? না, ভুয়া না, আসলে এত বেশি রোগী হয়ে গেছে যে এখন আর যাদের লক্ষণ নেই, তাদের আর টেস্ট করার মতো সামর্থ্য নেই। এ জন্য দেখা যাচ্ছে এত বেশি মৃত্যুহার।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের কথা যদি বলি, আমাদের দেশে প্রতি ১ হাজার মানুষে ৫ দশমিক ৪ জন মানুষ মারা যায় ২০১৮–এর হিসাব অনুযায়ী। এটা সারা বছর যত মানুষ বিভিন্ন কারণে মারা যায় তার সর্বমোট হিসাব। তার মানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরলে প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়, অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৫০০ মানুষ মারা যায়। এখন করোনায় মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ধরলে, যদি মনে করি বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে, তাহলে মোট মারা যাওয়ার কথা প্রায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ। ব্যাপারটা যদি এভাবে বোঝাই, আপনি এমনই সময়ে বছরে হয়তো ৫ জন আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত মানুষের মৃত্যু সংবাদ শোনেন, এ বছর হয়তো ৭–৮ জনের মৃত্যু সংবাদ শুনবেন। আর শেষ কথা হিসেবে বলি, গত কয়েক দিনে আপনার আশপাশের মানুষের মধ্যে কতজনের শুনছেন করোনার মতো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে? নিজেই বুঝতে পারবেন সংক্রমণ কী পরিমাণে ছড়িয়েছে।

মোদ্দা কথা হলো, সরকারিভাবে যত জন মানুষ শনাক্ত হয়েছে, আক্রান্ত তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সুতরাং আপনার এলাকায় মাত্র অল্প কয়েকজন করোনা পজিটিভ, এই চিন্তা করে যদি বিনা কারণে বাইরে বের হন, তাহলে আপনি নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবেন, সেই সঙ্গে আপনার পরিবার এবং আশপাশের মানুষকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন। তাই নিজে সাবধান থাকতে হবে, সরকারকে সাহায্য করতে হবে, যাতে সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। সরকার লকডাউন বললে সবাই যদি বাইরে বের হই, পৃথিবীর কোনো সরকারের ক্ষমতা নেই সেই জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার। দেশে পুলিশ মাত্র কয়েক লাখ, সেনা লাখখানেক, ডাক্তার ৯০ হাজার, কিন্তু ১৭ কোটি মানুষ যদি, ‘করোনা আমার কী করবে, মরলে মরলাম বাঁচলে বাঁচলাম’ বলে অপ্রয়োজনে রাস্তায় বের হয়, বিনা প্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করে, মাস্ক পকেটে নিয়ে ঘোরে, পৃথিবীর কারও সাধ্য নেই সেই জাতিকে বাঁচানোর!

রুবায়েত আল মারুফ: কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলুর পিএইচডি গবেষক