আমার দ্বিতীয় বাড়ির কথা

এবিএম মূসা
এবিএম মূসা

প্রথমা প্রকাশন এবিএম মূসার আত্মজীবনীর কাজ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসে, তখনই তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। ফলে তাঁর জীবদ্দশায় এটি প্রকাশিত হতে পারেনি। এবিএম মূসার প্রকাশিতব্য আত্মজীবনীর নির্বাচিত অংশ প্রথম আলোয় প্রকাশিত হবে। আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব।

ঢাকা শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম, তারপর নিজের বাড়ি হলো। বাড়ির নাম ‘রিমঝিম’। সেই বাড়ির বয়স ৪১ বছর। আমার একটি দ্বিতীয় বাড়ি আছে। তারও একটি নাম আছে। নামটি হচ্ছে প্রেসক্লাব। সেই বাড়িটির, দালানটির নয়, বয়স হয়ে গেল ৫১ বছর। সেই পঞ্চাশের দশকের শেষ বা ষাটের দশকের প্রথম থেকে আমরা যারা সাংবাদিকতা করছি, এখনো আল্লাহ হায়াত দারাজ করায় বেঁচে আছি এবং পরবর্তীকালে যারা এসেছে, তাদেরও সবারই দ্বিতীয় বাড়ি এই প্রেসক্লাব। হিসাব করে বলতে পারব না এই সেকেন্ড হোমে ৫১ বছরের কতখানি সময় কাটিয়েছি, আর কতখানি থেকেছি নিজের বাড়িতে কিংবা আপন দপ্তরে। নিজের বাড়ির প্রতিদিনের ক্ষণগুলোর সঙ্গে মিশে আছে প্রেসক্লাবে কাটানো সময়ের অনেক হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আমোদ-বিবাদের ঘটনাবলি।

প্রথমে চুয়ান্ন সালে যখন সংবাদ-এর সম্পাদক, আমাদের অনেকেরই শিক্ষাগুরু, খায়রুল কবির ঢাকায় সাংবাদিকদের জন্য একটি ক্লাবের কথা বললেন। আমরা প্রথমে তাঁর ধারণার সবটুকু বুঝতে পারিনি। তারপর যখন তাঁর উদ্যোগে একটি লাল সুরকির বাড়িতে প্রথম মিলিত হলাম, তখনো বুঝিনি এই দালানটিই শেষ পর্যন্ত আমাদের মিলনস্থান হয়ে যাবে! খায়রুল কবির মাসিক ১০০ টাকা ভাড়ায় এই বাড়িটি নিলেন। সেই ভাড়াও কখনো দেওয়া হয়নি। অবশ্য অনেক স্মৃতিবিজড়িত সেই লাল ইটের দালানটি নেই। পরবর্তীকালে অবিমৃষ্যকারী কোনো ক্লাব কর্তৃপক্ষ সেটি ভেঙে তথাকথিত আধুনিক কংক্রিটের বাক্স বানিয়েছে। তবু কল্পনায় ভেসে ওঠে কাঠের গেটটি পার হয়ে গোলাকার চত্বরটি ঘুরে একটি ছোট হলঘরে ঢোকার ছবিটি। আমরা অনেকেই তখন সদ্য সাংবাদিকতা পেশায় ঢুকেছি। সেই যুগে বড়দের সঙ্গে পেশাদারি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলারই সাহস ছিল না। তাই সেই হলঘরকে এড়িয়ে চলে যেতাম পেছনের উঠানে অথবা দোতলায়। সেই হলঘরে তখন বসে থাকতেন সাংবাদিক জগতের কিংবদন্তির মহাপুরুষেরা। অবজারভার-এর আবদুস সালাম, ইত্তেফাক-এর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আজাদ-এর আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং তাঁদের চেয়ে একটুখানি বয়ঃকনিষ্ঠ কিন্তু ঘনিষ্ঠ দৈনিক সংবাদ-এর জহুর হোসেন চৌধুরী ও মর্নিং নিউজ-এর এস জি এম বদরুদ্দিন। তুমুল তর্ক চলত সেই ঘরটিতে, যার আওয়াজ আমরা বাইরে বসে পেতাম। মাঝেমধ্যে উঁকি মেরে দেখতাম বর্ষীয়ানদের উত্তেজিত আচরণগুলো। পরে ভাবতাম লঙ্কাকাণ্ড ঘটছে, কিছুক্ষণ পরই দেখতাম একে একে বা জোড়ায় জোড়ায়, কখনো একসঙ্গে প্রায় গলাগলি করে তাঁরা বেরিয়ে যাচ্ছেন।

আমরা ছোটরা তখন কী করতাম? ভাবতে অবাক লাগছে। নিজেদের তখন বয়স ও পেশাগত জীবনের কালসীমার বিচারে কত কনিষ্ঠই না ভাবতাম! চুপচাপ দোতলায় উঠে যেতাম, যেখানে গিয়ে তাস খেলতাম অথবা পেছনের উঠানে আমগাছের নিচে কাঠের চেয়ারে বসে গুলতানি মারতাম। শতাব্দীপ্রাচীন সেই আমগাছগুলো, বিশেষ করে একটি পেয়ারাগাছের জন্য এখনো মায়া জাগে। আমাদের মধ্যেও নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক হতো। দেদার চা খাওয়া হতো।

প্রথম থেকেই ক্লাবের ক্যানটিনটি চালু করেছিলেন অবাঙালি পিটিআইয়ের প্রতিনিধি বালান সাহেব। এক আনায়, মানে ছয় পয়সায় চা, দুই পিসের বাটার টোস্ট একখানা। তখনই চালু হয়েছিল প্রেসক্লাবের ঐতিহ্যবাহী আন্ডাপুরি। ঢাকায় তখন এই খাবারটির নতুনত্ব এতই প্রচার লাভ করেছিল যে বাইরের বন্ধুবান্ধব আবদার ধরতেন, ‘দোস্ত, তোদের ক্লাবের আন্ডাপুরি খাওয়াবি?’ দুপুরে ভাত-ডাল-মাছ, সঙ্গে ভাজি। দিতে হতো আট আনা। ৫০ পয়সায় পেটপুরে খাওয়া। রোববারে ফিস্ট, বিশেষ খাওয়া। সবাই আসতাম সপরিবারে, মানে যাদের পরিবার ছিল। বিশেষ খাওয়াদাওয়া মানে পোলাও, মুরগি, ডিম এবং পুডিং—মূল্য এক টাকা ২৫ পয়সা মাত্র। মজার ব্যাপার, এখনো এবং তখনো প্রেসক্লাবে যাওয়া মানেই খাওয়া আর অবসরের আড্ডা।

চমৎকার এসব খাদ্য যারা রাঁধত, তাদের মধ্যে ছিলেন রোজারিও। তখনকার দিনে ভালো বাবুর্চিদের সবাই ছিল খ্রিষ্টান। এই রোজারিওকে নিয়ে আমার জীবনে মজার একটা ঘটনা ঘটেছিল। প্রায় ২৭ বছর পর আমি কমনওয়েলথ প্রেস সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে গিয়েছিলাম। থাকতাম ইন্টারকন্টিনেন্টালে, খেতাম অখাদ্য সব পাশ্চাত্য খাবার। একদিন ডাইনিং রুমে খেতে বসেছি, এমন সময় সাদা চামড়ার একজন বেয়ারা ঢেকে-ঢুকে একটি ট্রে আমার সামনে রেখে গেল। ঢাকনা খুলে দেখি এক প্লেট সাদা ভাত, সঙ্গে গরুর গোস্তের কারি আর এক বাটি একেবারে খাঁটি মসুরের ডাল। অবাক হয়ে বেয়ারার দিকে তাকাতেই সে হেসে দূরে দাঁড়ানো একজনের দিকে ইশারা করল। কালো চামড়ার সাদা অ্যাপ্রোন পরা ব্যক্তিটি হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন, ‘স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি এখানকার হেড শেফ। আপনাদের প্রেসক্লাবে বাবুর্চি ছিলাম। আমি রোজারিও। যেদিন হোটেলে আপনি ঢুকেছেন, সেদিনই দেখেছি। হেড বাবুর্চি হলেও মাঝেমধ্যে ডাইনিং রুমে এসে গেস্টদের খাওয়া-দাওয়া দেখি। আপনাকে চিনতে পেরে, আপনার কিছুই না খেয়ে উঠে যাওয়া দেখে ভাবলাম, স্যারের কষ্ট দূর করতে হবে। এখন থেকে রোজ রাতে আপনি ভাত-ডাল-মাছ বা মাংস পাবেন। আমি নিজে আলাদা করে রান্না করব।’ আবেগাপ্লুত হয়ে একঘর সাদা চামড়ার লোকজনকে অবাক করে দিয়ে রোজারিওকে জড়িয়ে ধরলাম।

যে ঘটনাটির উল্লেখ করলাম, তখনকার দিনে ক্লাবের সদস্য আর কর্মীদের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের একটি উদাহরণ মাত্র। যার উষ্ণতার ছোঁয়া বিদেশে গিয়েও পেয়েছি। উমিদ খান, আবদুল হক, ফরমান আলী—সব বেয়ারা সিডনির রোজারিওর মতোই এ রকম দরদ দিয়ে চায়ের কাপটি টেবিলে রাখত। বেয়ারা কুদ্দুস সবার ফুটফরমাশ খাটতে খাটতে হয়রান হয়ে যেত। সর্বক্ষণ দৌড়াত বাইরে থেকে সিগারেট আর খিলি পান আনার জন্য। বলছিলাম সেকেন্ড হোম অর্থাৎ দ্বিতীয় বাড়ির কথা, এরা সবাই ছিল সেই বাড়ির অন্য বাসিন্দা, মালিক ও সদস্যদের একান্ত আপনজন।

আরেকটি উদাহরণ দেব। পঞ্চান্নর বন্যায় ঢাকা শহর ভেসে গিয়েছিল। আমার শ্বশুর আবদুস সালাম পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে অন্তঃসত্ত্বা আমার স্ত্রীকে নিয়ে প্রেসক্লাবের দোতলায় আশ্রিত হলেন। সেখানে একদিন আমার বড় মেয়ের জন্ম হলো। সেই মেয়েকে উমিদ খান কাঁথায় মুড়িয়ে বুকে জড়িয়ে বারান্দায় পায়চারি করে কান্না থামাত। কাঁথার ময়লা পরিষ্কার করে ধুয়ে দিত। এখন প্রেসক্লাবের অডিটোরিয়ামে অনেক বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। প্রেসক্লাবের জীবনের প্রথম বিয়ের আসরটিও হয়েছিল আমার মেয়ে রুমার বিয়ের অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে। মানিক মিয়া ও সালাম সাহেবরা এলে আবদুল হক দৌড়ে গিয়ে সোফায় তাঁদের বসিয়ে তাঁদের পায়ের জুতা খুলে মুছে দিত। আর কত নাম বলব, সবার কথা মনে পড়ছে না। এখন যখন সদ্য পেশায় আগত নতুন কোনো সদস্যকে বাচ্চা বেয়ারাদের ওপর হম্বিতম্বি করতে দেখি, তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, কোথায় গেল সেই মধুর সম্পর্কের দিনগুলো!

শুধু সাংবাদিকদের বিনোদনকেন্দ্র নয়, এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গেও আমাদের ক্লাবটির একটি ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। এই দেশের ইতিহাসের অনেক অধ্যায় এ ক্লাবেই লিখিত হয়েছে। সে-সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ কেউ লিপিবিদ্ধ করেছেন কি না, জানি না। রাজনৈতিক নেতারা এ ক্লাবে সভা করে মিছিল নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন নেভাতে গিয়েছেন বিভিন্ন এলাকায়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নয়জন রাজনৈতিক নেতা প্রথম একটি যুক্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন। বাষট্টিতে। সেই বিবৃতিটির খসড়া করেছিলেন তাঁরা এই ক্লাবের দোতলায় বসে, এক গোপন সভায় মিলিত হয়ে। ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, নুরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিব থেকে শুরু করে আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়।

রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাতও এই প্রেসক্লাব থেকেই। সেই সময় প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এই ক্লাবের মিলনায়তনেই প্রথম মিলিত হয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, আজকে সাংবাদিক সমাজের নিজেদের চরম সংকটকালে যখন তাদের প্রাণ ও পেশা হুমকির মুখে, প্রেসক্লাবের সদস্যদের কোনো প্রতিরোধী ভূমিকা নেই। এখানে আমন্ত্রিত হয়ে আসতেন আগা খান, জেনারেল আজম খান, উপমহাদেশের বিখ্যাত নেতারা। রাজনীতির উত্তাল দিনগুলোতে এই ক্লাব ছিল সবার অভয়াশ্রম, সেফ জোন।

অতীত ও সাম্প্রতিক কালে, অর্থাৎ কয়েক বছর আগেও পুলিশের মার খেয়ে রাজনৈতিক নেতারা এখানে এসে আশ্রয় নিতেন। এখন অবশ্য এর ব্যতিক্রমী কিছু ঘটছে। বাইরের রাজনৈতিক ঝাপটা যাতে ক্লাবের গায়ে না লাগে, বিদ্যমান সংকটকালে রাজনীতিবিদদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য, তাঁরা যেন পুলিশের ধাওয়া খেয়ে এর চত্বরে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য প্রধান গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর বন্ধ না করলেই বা কী? পুলিশ ক্লাবের ভেতরে ঢুকে যায়। টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। এমনকি সাংবাদিকও পিটিয়েছে। আইয়ুব, মোনায়েম বা এরশাদের আমলেও ক্লাব ছিল দুর্ভেদ্য দুর্গ। এখন আর তা নেই। সাংবাদিক সমাজের অনৈক্য আজ ক্লাবের নিরাপত্তার পরিবেশটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, ঐতিহ্য বিনষ্ট করেছে। রাজনীতির ইতিহাসে অবদান রাখার চেয়েও প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের অধিকার আদায় ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এনেছে অনেক বেশি। এখান থেকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে সব মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক আইয়ুব খানের প্রেস অর্ডিন্যান্সের প্রতিবাদে মিছিল করেছেন। আমার ছাদ-খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে মওলানা সাহেব সারা ঢাকা ঘুরেছেন, সেই গাড়িটি চালানোর সুখময় স্মৃতি এখনো আমাকে রোমাঞ্চিত করে।

সাংবাদিকদের ঐক্যের প্রতীক ছিল এই ক্লাব। চারবার সভাপতি ও তিনবার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক সমাজের ইউনিয়ন ছিল এই দালানে। এখনো আছে, তবে দ্বিধাবিভক্ত, কর্মকাণ্ডের ঐক্যটি আর নেই। আমি ক্ষোভে-দুঃখে জ্বালা অনুভব করি যখন দেখি আমার সেই ইউনিয়নটি, আমি এককালে যার সভাপতি ও সম্পাদক ছিলাম, ক্লাব কর্তৃপক্ষ তার মাঝ বরাবর বিভক্তির দেয়াল তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। অথচ ক্লাবে ইউনিয়নের জন্য একটি ঘর পেতে আমাকে মালিক ও সম্পাদকের সঙ্গে একসময় রীতিমতো ঝগড়া করতে হয়েছে। তাঁদের যুক্তি ছিল, ক্লাবটি শুধু পেশাদার সাংবাদিকদের নয়, তাঁদেরও বটে। এ ক্লাব থেকেই পাকিস্তানে প্রথম সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড গঠনের দাবি উঠেছিল। সেই বোর্ডের প্রথম সভাও হয়েছিল বিচারপতি সাজ্জাদ আহমদ জানের সভাপতিত্বে এ ক্লাবেরই দোতলার হলঘরে। সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ইউনিয়নের তখনকার সভাপতি, পরবর্তীকালে ডেইলি স্টার-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বন্ধু এস এম আলী, আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক।

এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।