নেতিবাচক ভোটই বিএনপির ভরসা

কার্টূন তূলি
কার্টূন তূলি

আগামী সংসদ নির্বাচন বিএনপির পক্ষে ক্রমেই অনুকূল হয়ে ওঠার পটভূমিতে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘নির্বাচিত হলে তাঁরা নতুনধারার সরকার পরিচালনা করার পরিকল্পনা করছেন।’ খুবই প্রশংসাযোগ্য ও ইতিবাচক চিন্তা সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ‘নতুনধারা’ কী রকম হবে, তা ব্যাখ্যা না করা পর্যন্ত আমরা এ সম্পর্কে খুব আশাবাদী হতে পারি না। গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। তাদের সরকারের আমল নানা কারণে সমালোচিত হয়েছিল। সেই সমালোচনা শুধু আওয়ামী লীগের ‘অপপ্রচার’ ছিল না। বিএনপি এখনো তার বহুল সমালোচিত শাসনকালের প্রকাশ্য মূল্যায়ন করেনি। কাদের কারণে সরকার ও দল নিন্দিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা চিহ্নিত করেনি। তাদের দলীয়ভাবে শাস্তিও দেয়নি। দলের দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের সঙ্গে নিয়ে ‘নতুনধারার সরকার’ করার কথা বললে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
পাঁচ পাঁচটি সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করায় রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সরকারের কাছে নিপীড়িত, নির্যাতিত ও নানাভাবে আক্রান্ত বিএনপি প্রায় বিপর্যস্ত দলে পরিণত হয়েছিল। নানা কারণে বা দলের নানা কৌশলের জন্য বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে দেশব্যাপী তেমন জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সরকারও এমন দমননীতি চালিয়েছে যে বিএনপি ঢাকায়ও অনেক দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে এমন একটা ধারণা হয়েছিল, এই যাত্রায় বিএনপি আর সুবিধা করতে পারবে না। গণজাগরণ মঞ্চ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায়, হেফাজতের বিশাল জমায়েত পণ্ড করে দেওয়া ইত্যাদি কারণে রাজনৈতিক মহলে এমন ধারণাই হয়েছিল, বিএনপি আগামী নির্বাচনে আর জয়লাভ করতে পারবে না। কিন্তু পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে (এর আগেও তিনটি সিটি নির্বাচনে) আওয়ামী লীগ-সমর্থিত জনপ্রিয় ও যোগ্য প্রার্থীরা যখন বিপুল ভোটে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন, তখন বিএনপি যেমন নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক মহলও আবার নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ শুরু করেছে। কয়েক সপ্তাহ যাবৎ দেশের নানা গণমাধ্যমে যত বিশ্লেষণ হয়েছে, প্রায় সবখানেই এ রকম ধারণাই দেওয়া হয়েছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা কম। একজন ভাষ্যকার তো এমনও লিখেছেন, আওয়ামী লীগ যেন ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্য নিয়ে এখন পরিকল্পনা শুরু করেন। (ঢাকা ট্রিবিউন)
বিএনপিকে একটু অতিরিক্ত আশাবাদী মনে হচ্ছে। বিএনপির এখনই এত খুশি হওয়া উচিত নয়। রাজনীতি ও ভোট অনেক জটিল ব্যাপার। খুব সহজে তার অঙ্ক মেলানো যায় না। আওয়ামী লীগ এত সহজে দান ছেড়ে দেবে, বিএনপির এটা ভাবা উচিত নয়। বিএনপি আরও একটা কথা ভুলে গেছে। তা হলো, নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, সেটাই এখনো স্থির হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার যদি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ শেষ পর্যন্ত না মানে, তাহলে বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে? বিএনপি যদি নির্বাচনই না করে, তাহলে সরকার গঠন করার স্বপ্ন দেখে লাভ কী?
সবকিছু দেখে মনে হয়, বর্তমান সরকার কোনো অবস্থাতেই ‘তত্ত্বাবধায়ক’ পদ্ধতি দেবে না। কারণ, এখন তত্ত্বাবধায়ক দেওয়ার অর্থ হবে নির্বাচনের আগেই পরাজয় মেনে নেওয়া। তা কি আওয়ামী লীগ করতে রাজি হবে? অনেকের আশঙ্কা, তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে শেষ মুহূর্তে একটা বড় রকম রক্তাক্ত সংঘর্ষ হতে পারে। সেই সংঘর্ষের জের ধরে অসাংবিধানিক শক্তি ঢুকে পড়তে পারে। কোনো কোনো ভাষ্যকার মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির জয়লাভের চেয়ে অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ অনেক শ্রেয়।’ এটা একটা ধারণা। আমরা মনে করি, এই ধারণা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ একটি পরীক্ষিত গণতান্ত্রিক দল। তারা যেকেনো মূল্যে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত রাখবে। তবে আওয়ামী লীগকে বোঝা মুশকিল। এক-এগারোর সরকার নিয়ে শেখ হাসিনা এখন এত সমালোচনামুখর, অথচ তাদের সম্পর্কে তিনি শুরুতে বলেছিলেন, ‘এই সরকার (এক-এগারো) আমাদের আন্দোলনের ফসল।’ শেখ হাসিনা তখন এক-এগারোর সরকারের সব কাজকে আগাম অনুমোদনও দিয়ে রেখেছিলেন। এক-এগারোর একজন সামরিক কুশীলবকে (অন্যতম নীতিনির্ধারক) বর্তমান মহাজোট সরকার সসম্মানে রাষ্ট্রদূতের চাকরি দিয়ে রেখেছে! কথা ও কাজে আওয়ামী লীগেরে সব সময় মিল থাকে না।
বিএনপির মতো সৌভাগ্যবান দল আর হয় না। বিরোধী দল হিসেবে পার্লামেন্টে না গিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ব্যর্থতার কারণে দিব্যি এখন ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অন্তত এখন এটুকু বলা যায়, পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে। অনেকে আশা করছেন, পাঁচ সিটির (্আগের তিনসহ আট সিটি) মতো সারা দেশের বিক্ষুব্ধ ভোটাররা সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ ভোটের মাধ্যমে প্রকাশ করবেন। বিএনপির ভাগ্য সত্যি ভালো। নইলে তাদের আমলের (২০০১-০৬) এত দুর্নীতি, দুর্নাম, হাওয়া ভবন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা, দলীয়করণ ইত্যাদি ভুলে গিয়ে সবাই প্রায় বাধ্য হয়ে তাদের বাক্সে ভোট দিচ্ছেন। সংসদ নির্বাচনেও হয়তো দেবেন। আওয়ামী লীগের শাসনকাল সম্পর্কে ক্ষোভ এত বেশি যে মানুষ এখন বিএনপিকেও আনতে দ্বিধা করছে না। অন্তত সে রকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকে ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর হবে না। হেফাজত ও জামায়াত তাদের দাবি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। নাস্তিক ব্লগারদের কী হবে? কয়েকটি টিভি চ্যানেলের কী হবে? পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার, হল-মার্ক ও ডেসটিনির নায়কদের কী হবে? ইত্যাদি প্রশ্নে অনেকে আতঙ্কিত। উৎকণ্ঠিত। দেশের জনগণ যা চায়, তার বাইরে গিয়ে বিএনপির পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে না। দেশের জনগণ যদি বিভিন্ন বিষয়ে ১৮-দলীয় জোটকে ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে তা বাস্তবায়ন না করাও তো সম্ভব নয়। এসব ম্যান্ডেট অনেকের পছন্দ না-ও হতে পারে। সবার ওপরে জনগণ।
তবে বিএনপি জিতলে মহাজোট আমলে যাঁরা বড় মাপের দুর্নীতি করেছেন, বড় মাপের অন্যায় করেছেন, সে ধরনের লোকদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে, এটা সাধারণ মানুষ নিশ্চয় প্রত্যাশা করবে। এই বিচার ও শাস্তিকে নিশ্চয় আওয়ামী লীগ মহল প্রতিহিংসা বলে রটাবে না।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে বা জঙ্গিবাদে দেশ আচ্ছন্ন হয়ে যাবে বলে যাঁরা এখন রব তুলেছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগ সরকারকে ঠিক সময়ে সমালোচনা করেননি কেন? আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল পদক্ষেপ ও ভুল নীতি চিহ্নিত করেননি কেন? আওয়ামী লীগে বেশির ভাগ নেতা, কর্মী, সমর্থক ও বুদ্ধিজীবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুণগান করতেই ব্যস্ত ছিলেন। যাঁরা দেখার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সমালোচনা করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ ও টিভির টক শো নিয়ে খোদ শেখ হাসিনা নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছেন। সরকারের মন্ত্রীদের বাগাড়ম্বর, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, বিরোধী দলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, জাতীয় সংসদে স্থূল বক্তৃতা দেওয়া, দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়, সম্মানী লোকদের অপমান করা ও সরকারের আরও নানা অপকর্ম আওয়ামী লীগের নেতারা না দেখলেও সিটি নির্বাচনের সাধারণ ভোটাররা কিন্তু দেখেছেন। দেখে দেখে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অপেক্ষা করেছেন সেই ক্ষোভ প্রকাশের জন্য। আজ যে বিনাশ্রমে, বিনা অঙ্গীকারে বিএনপি আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তা শুধু আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার জন্যই, বিএনপির জনপ্রিয়তার জন্য নয়।
আগেই বলেছি, বিএনপির জয়লাভের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে ভোট পর্যন্ত সেই পরিস্থিতি অক্ষুণ্ন থাকবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বিএনপি এবার ভোট চাওয়ার আগে তাদের আগের সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতার কী জবাব দেবে? হাওয়া ভবন সম্পর্কে কী বলবে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় সম্পর্কে কী বলবে? জামায়াতের সঙ্গ সম্পর্কে কী বলবে? হেফাজত ও তাদের ১৩ দফা সম্পর্কে কী বলবে? আগামী দিনে সরকার গঠন করলে কী কী করবে? দুর্নীতি দমন, দুদক, প্রশাসন দলীয়করণ, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, সংবিধান সংস্কার, পদ্মা সেতু, নারীনীতি, স্থানীয় সরকার, গ্রামীণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ইত্যাদি কয়েকটি বড় ইস্যুতে (আরও কয়েকটি ইস্যু থাকতে পারে) তাদের নীতি বা অঙ্গীকার কী হবে, তা জাতি জানতে চায়। বিএনপি এবার অনেক নেতিবাচক ভোট পাবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি অনেক সচেতন ভোটার বিএনপির নানা নীতি বা নির্বাচনী অঙ্গীকারও দেখতে চাইবে, বিশেষ করে নারী ও তরুণ সমাজ। নারী ও তরুণ সমাজ এখন অনেক সচেতন। তারা শুধু নেতিবাচক ভোট দিতে চাইবে না, তারা সব জেনে-শুনে ভোট দিতে চাইবে। বিএনপি যদি ভাবে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ের মতো সব ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখবে, ভোটের বাজারে তা কিন্তু গ্রহণযোগ্য হবে না। গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে বিএনপিকে কথা বলতে হবে। রাজনীতি করতে হলে বড় বড় ইস্যুতে একটা অবস্থান নিতেই হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।