তরুণদের স্বপ্ন ধ্বংস করে যে রাজনীতি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দৃশ্যপট: এক
পুলিশ গত বুধবার ভোরে মিরপুর এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে খোরশেদ আলম রুবেল নামের ২৩ বছরের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রুবেল ছিনতাইকারী নন, জেএমবি নামের জঙ্গি সংগঠনটির সদস্য। তিনি সহযোগীদের নিয়ে মিরপুরে যাচ্ছিলেন তাঁর ভাষায় দুজন ‘নাস্তিক’ কলেজশিক্ষককে হত্যা করতে। চেকপোস্টে পুলিশ সন্দেহবশত তাঁদের বহন করা সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি থামালে রুবেল ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে রুবেল আহত হন। তাঁর কাছ থেকে একটি পিস্তল ও দুই বোতল বিষ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের অভিযানে রুবেল গ্রেপ্তার হলেও তাঁর সহযোগীরা পালিয়ে যান। পুলিশের মতে, রুবেল জেএমবির স্লিপার শেল বা কিলার গ্রুপের সদস্য।

দৃশ্যপট-দুই
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সামনে ককটেল ফাটিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন সংগঠনটির পদবঞ্চিত নেতা–কর্মীরা। তাঁদের দাবি, ‘অযোগ্যদের দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ নয়াপল্টনে ককটেল নিক্ষেপকালে তিনজন কর্মী আটক হন পুলিশের হাতে। একই দিন মহানগর বিএনপির কমিটি পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের গাড়িবহরে যাঁরা হামলা চালিয়েছেন, তাঁরাও দলের তরুণ সমর্থক। তাঁরা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সাইদ খান খোকনের মাইক্রোবাসসহ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন দেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে।


দৃশ্যপট-তিন

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় কক্সবাজার-৪ আসনের সাংসদ আবদুর রহমান বদিকে গত রোববার কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকা মহানগর আদালত। এর প্রতিবাদে ওই দিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফ সড়কের অন্তত ২০টি স্থান অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বদির সমর্থক স্থানীয় নেতা-কর্মীরা, যাঁদের বেশির ভাগ তরুণ। তাঁরা সেখানে অঘোষিত হরতাল পালনে জনগণকে বাধ্য করেন। এর আগে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফরহাদ হোসেনকে লাঞ্ছিত করেন স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা। তিনি উপজেলার দায়িত্ব নেওয়ার আগে দপ্তরি ও নৈশপ্রহরী পদে লোক নিয়োগের নামে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মোটা অঙ্কের উৎকোচ নেন। পদায়িত ব্যক্তিরা বেতন না পাওয়ায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা এখন ইউএনওর ওপর চড়াও হয়েছেন।
তিনটি ঘটনায়ই হীন রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী স্বার্থে তরুণদের ব্যবহার করা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁদের বিপথে চালিত করছেন, ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়োজিত রাখছেন। কেউ তাগুতি শাসন অবসানের নামে, কেউ দলের ভেতরে কোটারি তৈরির নামে, কেউ বা দলীয় অপকর্ম আড়াল করতে। এখানে মৌলবাদী, জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলার রাজনীতির মধ্যে ফারাক খুব কম।
প্রথম ঘটনায় আমরা দেখি মিরপুরের একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে হত্যা করতে এই তরুণকে পাঠানো হয়েছিল। ওই শিক্ষকদ্বয় যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, আইনানুগভাবেই তার প্রতিকার ও প্রতিবাদ করা যেত। কিন্তু তা না করে তাঁদের হত্যার উদ্দেশ্যে বিষের বোতল ও পিস্তল নিয়ে লোক পাঠানো? এটি কিসের আলামত? সরকারের মন্ত্রীরা জোরগলায় বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে জঙ্গিরা নির্মূল হয়েছে। নির্মূল যে হয়নি মিরপুরের ঘটনা, এর আগে পুলিশভ্যানে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনাই তার প্রমাণ। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, সম্প্রতি বর্ধমানে যে দুই তরুণ বোমা বানাতে গিয়ে মারা যান, তাঁরাও জেএমবির সদস্য। বাংলাদেশ থেকে অনেক আগে তাঁরা চলে গেছেন। সেখানে বিয়ে করেছেন, ভোটার হয়েছেন।
আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়েও বহু বাংলাদেশি তরুণকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁদেরই একজন মুফতি আবদুল হান্নান, বাংলাদেশে সব বোমা ও গ্রেনেড হামলার মূল হোতা।
এই তরুণদের কীভাবে, কারা রিক্রুট করেছে, বিদেশে কারা অর্থ জুগিয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি রাজনৈতিক স্বার্থে জঙ্গিদের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। আর এখন আওয়ামী লীগ ভিন্ন মতের সবাইকে জঙ্গি বানাতে তৎপর রয়েছে। এতে জঙ্গিদেরই পোয়াবারো হয়েছে। এই ধর্মান্ধ ও পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা সমাজ থেকে সমূলে উচ্ছেদ করতে যে উন্নত রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রয়োজন, কথিত গণতান্ত্রিক দলগুলো কখনোই তার ধার ধারেনি।
দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। কবি হেলাল হাফিজের ভাষায়: ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ এই শ্রেষ্ঠ সময়ে আমরা তাঁদের সঠিক পথ দেখাতে পারিনি বলেই তাঁদের কেউ রাজনৈতিক দলের মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছেন, কেউ জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিচ্ছেন। এ জন্য এই অমিত সম্ভাবনাময় তরুণদের দায়ী করা যায় না। দায়ী হলো আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব। তারা ভুলে যান যে এই তরুণেরাই দেশের ভবিষ্যৎ। এই তরুণদের দিকেই তাকিয়ে আছেন তাঁদের বাবা-মা, সমাজ ও রাষ্ট্র। ন্যায়যুদ্ধের বদলে আমরা তাঁদের অন্যায় যুদ্ধে ধাবিত করছি। একসময় কড়া বামপন্থীরা যেমন নিজেদের সন্তানদের ইউরোপ-আমেরিকায় (প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা আবদুল হকের ছেলে আমেরিকায় পড়াশোনা করে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন) পাঠিয়ে কৃষক পরিবারের সন্তানদের গলাকাটা রাজনীতিতে নামিয়েছিলেন, তেমনি মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতির প্রবক্তারাও নিরাপদ দূরত্বে থেকে গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের হাতে জিহাদের নামে আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা তুলে দিচ্ছেন। এই তরুণদের কেউ বোমা বানাতে গিয়ে, কেউ বা মারতে গিয়ে জীবন দিচ্ছেন।
২৩ বছর বয়সের যে তরুণের কোনো উচ্চশিক্ষালয়ে বা কর্মস্থলে থাকার কথা, সেই তরুণ কেন দুজন শিক্ষককে মারতে গেলেন? এর দায় আমাদের রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজ কেউ এড়াতে পারে না। এই ঘটনা আমাদের গত বছরে মিরপুরেই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার হত্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কতিপয় তরুণ। কিন্তু তাঁদের পেছনে যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র আছে, তাদের নাম-পরিচয় সম্ভবত কখনোই জানা যাবে না।
দ্বিতীয় দৃশ্যপটে আমরা দেখি, ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে সংগঠনটির একাংশ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ হতে পারত। উত্তম হতো ছাত্রদলের কমিটি যদি ছাত্রদলের কর্মীরা সম্মেলন ডেকে ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচিত করতে পারতেন। তখন অযোগ্যদের দিয়ে কমিটি হয়েছে—নেতৃত্বকে এই অপবাদ শুনতে হতো না। এখন হয়তো বিএনপির নেতারা দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বিবৃতি দিয়ে বলবেন, সরকারের এজেন্টরাই এসব করেছেন। জিয়াউর রহমানের আদর্শে বিশ্বাসী কোনো কর্মী এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করতে পারেন না। আওয়ামী লীগের বা ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে এ রকম বোমাবাজি হলে তাদের নেতারাও সব দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপানোর চেষ্টা করতেন।
বিএনপির নগর কমিটির পদ যাঁরা পেয়েছেন, আর যাঁরা পাননি, তাঁদের কারও বয়স ৫০-৬০ বছরের নিচে নয়। তাহলে কেন তরুণদের নামানো হয়েছে গাড়ি পোড়াতে ও ভাঙচুর করতে? আর ছাত্রদলের কমিটিই গঠিত হয়েছে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে। জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করলেও দলের বা সহযোগী সংগঠনের কোনো পর্যায়েই তারা নির্বাচন করতে আগ্রহী নয়। দলটির গঠনতন্ত্র এমনভাবে করা হয়েছে যে ঈশ্বরের পরই চেয়ারপারসনের স্থান। মাঝেও কেউ নেই, শেষেও না।
তৃতীয় দৃশ্যপটটি আরও বিপজ্জনক। আওয়ামী লীগের একজন দুর্নীতিবাজ সাংসদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ করার কাজে তরুণদের নামিয়েছে কক্সবাজার আওয়ামী লীগ। তৃতীয় ঘটনায় নিয়মবহির্ভূতভাবে উৎকোচের বিনিময়ে চাকরি দিয়ে এখন বেতন দিতে না পারায় ইউএনওকে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। আর এ কাজে তারাও ব্যবহার করেছে তরুণদেরই। যে তরুণেরা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারত, সেই তরুণদের আমরা লাঠালাঠির কাজে ব্যবহার করছি। তাঁদের হাতে বোমা ও ককটেল তুলে দিচ্ছি।
গত ৪৩ বছরে বাংলাদেশ কৃষি, শিক্ষা, অর্থনীতি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি করেছে। এই উন্নতিটা আরও অনেক অনেক বেশি হতে পারত যদি আমাদের রাজনীতিটা একটু সুস্থ হতো। একটু নিয়মকানুনের ধার ধারত। নেতা–নেত্রীরা ভুলে যান যে তাঁদের বিভেদ ও বিদ্বেষের চোরাগলিতেই মৌলবাদী জঙ্গিবাদী রাজনীতি শিকড় গাড়ার সুযোগ পায়।
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে তরুণদের, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড দেখে দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছাত্ররাজনীতি সাময়িক বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। আর সবাই গেল গেল বলে রব তুললেন। এখন বোধ হয় সময় এসেছে তাঁর সেই বক্তব্যের পক্ষেই কঠোর অবস্থান নেওয়ার। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ না করুন, অন্তত ছাত্র-তরুণদের দলীয় মাস্তান হিসেবে ব্যবহারের বদভ্যাসটা ত্যাগ করুন। গত ১৫ বছরে দেশের ছাত্ররাজনীতি এক পা এগোয়নি। বরং ছাত্ররাজনীতির নামে অনেক তরুণ তাজা প্রাণ ঝরে গেছে, অনেক বাবা-মায়ের কোল খালি হয়েছে।
নেতা-নেত্রীরা যদি আর কোনো বাবা-মায়ের কোল খালি করতে না চান, তাহলে এখন ক্ষান্ত দিন। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে তরুণদের ব্যবহার করবেন না। যে রাজনীতি তরুণদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা ধ্বংস করে, সেই রাজনীতি পরিহার করুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]