প্রধান বিচারপতি বেছে নেওয়া

অলংকরণ:  মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ অবসরে যাওয়ার কারণে আরেকজন নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সামনে এসেছে। এই পদে নিয়োগে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তা নিয়ে তেমন আলোচনা কখনো হয়নি। দ্বাদশ সংশোধনী প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ রদ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে।
বর্তমান প্রধান বিচারপতির টানা তিন বছর এই পদে থাকা বিরল ঘটনা। গত ২০ বছরে ভারত ১৬ জন প্রধান বিচারপতি পেয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারজন দুই বছরের বেশি মেয়াদ পেয়েছেন। বাংলাদেশ আপিল বিভাগের বিচারকদের জ্যেষ্ঠতার বর্তমান ক্রম এ রকম: এস কে সিনহা, অবসর নেবেন ৩১ জানুয়ারি ২০১৮। মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, অবসর নেবেন ১০ নভেম্বর ২০১৮। নাজমুন আরা সুলতানা, অবসর নেবেন ৭ জুলাই ২০১৭। সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, অবসর নেবেন ৩০ ডিসেম্বর ২০২১। মো. ইমান আলী, অবসর নেবেন ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩। হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, অবসর নেবেন ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩। এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী, অবসর নেবেন ১ অক্টোবর ২০১৫। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে (১৯৯৬-২০০১) তাঁরা সবাই নিয়োগ পান।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া কেন অন্যান্য বিচারক নিয়োগ থেকে আলাদা হবে? আমরা ঠিক বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। এ জন্য যুক্তি ধার করার অপেক্ষায় ছিলাম। সেটা পেলামও। তবে তাতে আনন্দ ও বেদনা দুটোই যুক্ত হলো।
ভি আর কৃষ্ণা আয়ার ভারতের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত-বিচারক। তাঁর অনেক অভিমত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করেছেন। আমাদের আলোচিত ১০ বিচারকের (এখন তাঁদের দুজন আপিল বিভাগে, বিএনপি সরকার ১০ বিচারককে বাদ দিয়েছিল) মামলায় বৃহত্তর বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ বিচারকের আপিল করার অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল। ওই ১০ বিচারককে নতুন করে নিয়োগ দিতে বৃহত্তর বেঞ্চের রায়ের সমর্থনে ২০০৯ সালে আপিল বিভাগ দ্য হিন্দুতে আয়ারের লেখা একটি নিবন্ধকেও অবলম্বন করেছিলেন। তাই প্রধান বিচারপতি নিয়োগে গত ১১ মে দ্য হিন্দুতে আয়ারের একটি নিবন্ধ ছাপা দেখে আনন্দিত হলাম। আর বেদনার কারণ হলো, তিনি ৪ ডিসেম্বর মারা গেছেন। আমি আমার লেখায় তাঁর বহু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি। তাঁর মৃত্যু বিশ্ববিচারিক জ্ঞানের জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
দ্য হিন্দু পত্রিকায় ৫ মে ২০১৪ এই বঙ্গের সন্তান অর্ঘ্য সেনগুপ্তর ‘চুজিং দ্য চিফ জাস্টিস’ শীর্ষক নিবন্ধ ছাপা হয়। অর্ঘে৵র আদিনিবাস মুন্সিগঞ্জে, মামাবাড়ি বরিশালে। তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আইনের প্রভাষক ছিলেন। বিচারক নিয়োগ নিয়েই অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করেছেন। এখন দিল্লিতে আইনি থিংকট্যাংক ‘বিধি’-র গবেষণা পরিচালক। বাংলাদেশ ও ভারত প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার নীতি অনেকটা যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করে আসছে। যদিও আওয়ামী লীগ গত ছয় বছরে জ্যেষ্ঠতার নীতি এড়িয়ে দুজনের প্রধান বিচারপতি হওয়ার পথ রুদ্ধ করেছে। এতে অগ্রহণযোগ্য দলীয় বিবেচনার ছাপ পড়েছিল। অর্ঘ্য মনে করেন, প্রধান বিচারপতি হতে জ্যেষ্ঠ বিচারকদের আইনগত বৈধ আকাঙ্ক্ষা থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। এ জন্য নিরপেক্ষ মানদণ্ড থাকা দরকার। দিল্লিতে ড. অর্ঘ্যের সঙ্গে ১৩ ডিসেম্বর টেলিফোনে আলাপ হলো। বললেন, তিনি যখন ওই নিবন্ধ লেখেন, সেই থেকে পরিস্থিতি বদলেছে। নরেন্দ্র মোদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। এখন জ্যেষ্ঠতার নীতির বাইরের কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করার বিষয়টি তাঁর মতে ‘আরও জটিল’ রূপ নিয়েছে। তবে তিনি আমার সঙ্গে একমত হন যে বিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা হচ্ছে সরকারি ও বিরোধী দলের মতামতসংবলিত একটি প্রকাশ্য শুনানির মধ্য দিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা। বিলম্ব হলেও বাংলাদেশ ও ভারতকে এই পথে যেতে হবে।
উল্লেখ্য, ইন্দিরা গান্ধী বিচারপতি অজিত নাথ রায়কে ভারতের প্রধান বিচারপতি করতে তিন জ্যেষ্ঠ বিচারককে ডিঙিয়েছিলেন। তবে এটা ভারতের একমাত্র ব্যতিক্রম। সেই থেকে জ্যেষ্ঠতম বিচারকই প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন। তবে ইতিহাসে এই প্রথম লোকসভা ২০১৪ সালে পাস করা তার বিচারক নিয়োগ কমিশন বিলে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে আলাদা বিধান রেখেছে। এক অর্থে ২৩ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ ও ভারত প্রধান বিচারপতি নিয়োগে অস্পষ্ট বিধান আনার ক্ষেত্রে একই অবস্থায় পড়েছে। বাংলাদেশ সংবিধান প্রধান বিচারপতির জন্য যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণে নীরব। ভারতের ওই বিলও নীরব। কারণ, বিলের ৫(১) দফা বলেছে, ‘কমিশন জ্যেষ্ঠতমকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সুপারিশ করবে, যদি তিনি যোগ্য হন।’ অর্ঘ্য ই-মেইলে আমাকে লিখেছেন, ‘সেই যোগ্যতা কী, তা আইনে লেখা নেই।’
ভারতের বিদায়ী প্রধান বিচারপতি আর এম লোধা তাঁর সাম্প্রতিক এক রায়ে লিখেছেন, ‘বৃহত্তর জনস্বার্থ বিবেচনায় নেওয়ার ফল ভিন্নতর হলে বৈধ আকাঙ্ক্ষার কোনো জায়গা থাকতে পারে না।’ এর সরল অর্থ দাঁড়ায়, প্রধান বিচারপতি হতে কারও ব্যক্তিগত সুবিধা জনস্বার্থের দাবিকে খাটো করতে পারে না। অর্ঘ্য দ্য হিন্দুতে লিখেছেন: ‘কারও প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তিগতভাবে বিরাট সম্মানজনক। কিন্তু সেটা এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। তাই অবশ্যই জনস্বার্থ সংরক্ষিত হতে হবে। জনস্বার্থের কাছে জ্যেষ্ঠতার রেওয়াজ রক্ষার কোনো স্থান নেই।’ মোহন কুমারামাঙ্গালাম ১৯৭১-৭২ সালে লোকসভার সদস্য ছিলেন। তিনি তখন কেবল জ্যেষ্ঠতার পরিবর্তে প্রধান বিচারপতি পদপ্রার্থীর ‘সামাজিক এবং সাংবিধানিক দর্শন বিবেচনায়’ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অর্ঘ্য বলেন, জ্যেষ্ঠতমকে প্রধান বিচারপতি করার সুবিধাও আছে। প্রথমত, এতে দুর্নীতি হয় না। দ্বিতীয়ত, স্বজনপ্রীতি হয় না। তৃতীয়ত, বার ও বেঞ্চের প্রাত্যহিক কার্যক্রমের প্রতি পদে পদে জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণ করা হয়। এটা ভেঙে বেরিয়ে আসা কঠিন। তাঁর কথায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় জ্যেষ্ঠতার ব্যত্যয় ঘটানোর ফল ভয়ংকর হতে পারে।
বাংলাদেশের আপিল বিভাগের উল্লিখিত সাতজনের মধ্যে চারজনেরই অবসর গ্রহণের তারিখ কাছাকাছি। তাঁরা ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অবসর নেবেন। এর মধ্যে অতিরিক্ত বিচারক থেকে দুজন (মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া ও নাজমুন আরা সুলতানা) বিএনপি আমলে স্থায়ীভাবে হাইকোর্টের বিচারক হন। এর আগে বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামকে প্রধান বিচারপতি করা হয় জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে। কয়েক সপ্তাহ দায়িত্ব পালন শেষে তিনি অবসর নিলে ফজলুল করিম প্রধান বিচারপতি হন। অবশ্য এম এ মতিনকে প্রধান বিচারপতি করা হলেও এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হতে পারতেন। কিন্তু সেটা ঘটেনি। এবারে প্রচলিত নিয়ম মেনে জ্যেষ্ঠতা, নাকি অন্য কোনো মানদণ্ড বেছে নেওয়া হবে, তা আঁচ করা কঠিন। কারণ, কোনো নিয়মরীতি নেই। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাই নিয়ামক। সংসদ রেখে নির্বাচন করার জন্য লোকসভার দৃষ্টান্ত হাজির করা হয়েছিল। এবারে জ্যেষ্ঠতার নীতি মানলে ভারতই দৃষ্টান্ত হতে পারে। অবশ্য জ্যেষ্ঠতা যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রধান বিচারপতি রবার্টসকে নিম্ন আদালত থেকে আনা হয়েছে। দেশটির আরও অনেক প্রধান বিচারপতি তাঁদের নিয়োগকালে সুপ্রিম কোর্টেরই বিচারক ছিলেন না। আর্ল ওয়ারেন ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর।
আমাদের নিম্ন আদালত বা বাইরে থেকে উপযুক্ত কাউকে প্রধান বিচারপতি করলে সংবিধান বাধা দেবে না। যোগ্যতর হলেও কখনো জ্যেষ্ঠতমের সততা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। সৎ হলেও কেউ মধ্যম মানের হতে পারেন। এই দুটোই পরিত্যাজ্য। আমরা যোগ্যতমকে বেছে নেওয়ার পক্ষে। আমাদের একজন সৃজনশীল জুডিশিয়াল স্টেটসম্যান দরকার। মুম্বাই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এম সি চাগলাকে (নেহরুর শিক্ষামন্ত্রী ও ব্রিটেনে হাইকমিশনার ছিলেন) প্রধান বিচারপতি করার উদ্যোগ সঠিক ছিল। সেটা ভেস্তে যায়, কারণ সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা গণপদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন। ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মারকান্ডে কাটজুর সঙ্গে আমরা একমত। তিনি মনে করেন, ওই হুমকি অগ্রাহ্য করা উচিত ছিল। কারণ, ‘কেউ অপরিহার্য’ নয়।
দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত অর্ঘ্য সেনগুপ্তর ওই নিবন্ধের প্রতি সমর্থনসূচক প্রতিক্রিয়ায় ভি আর কৃষ্ণা আয়ার ১১ মে ২০১৪ দ্য হিন্দুতে লিখেছিলেন, কেমন প্রধান বিচারপতি চাই। আমরা বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে তাঁর বেঁধে দেওয়া সুরেরই অবিকল প্রতিধ্বনি তুলতে চাই।
‘প্রধান বিচারপতি সংবিধানকে ন্যায়বিচারের একটি প্রকৃত হাতিয়ারে পরিণত করবেন।...তাঁর হৃদয়ে এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন থাকবে, যাতে জাতীয় সংস্কৃতির বিস্ময়গুলো সামনে এগিয়ে যাবে।...তিনি লন্ডন বা ওয়াশিংটনের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি করবেন না। টেমস কিংবা পোটোমেক নয়, গঙ্গা ও যমুনার মতো হয়ে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারিক কার্যক্রম প্রবহমান থাকবে।...সংবিধান একটি সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের জন্য দাঁড়িয়ে আছে, রয়েছে এমন একটি গণতন্ত্রের জন্য, যেখানে প্রত্যেক ক্ষুদ্র ব্যক্তিকেও গণনায় নেওয়া হবে।...সুতরাং, আমাদের এমনই একজন প্রধান বিচারপতি বাছাই করা দরকার, যিনি তাঁর পারিবারিক জীবনে, তাঁর নিজের অতীতে সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত ধ্যানধারণার সঙ্গে নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন। আর এটাই হলো সেই সর্বোচ্চ বিচারালয়, যা কিনা সংবিধানকে নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে নির্বাহী বিভাগ এবং আইনসভা বাস্তবতায় রূপ নিতে পারে। এর অন্যথা ঘটানো হলে প্রধান বিচারপতি একটি ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবেন।...প্রধান বিচারপতি বাছাইয়ে জ্যেষ্ঠতা যেমনি, তেমনি নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের মতামতকে বিবেচনায় নিতে হবে।...প্রধান বিচারপতি হতে গিয়ে তিনি কারও করুণা এবং অনুগ্রহের পাত্র হবেন না। সবশেষ নাগরিক তিনি নারী বা পুরুষ যা-ই হোন, তিনি ভাববেন, সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আসনে যিনি আসীন হবেন, তাঁকে বেছে নিতে অবশ্যই তাঁর কণ্ঠ রয়েছে। প্রধান বিচারপতির ধ্যানজ্ঞান হবে সমগ্র বিচারব্যবস্থাকে একটি অর্থপূর্ণ বাস্তবতায় রূপ দেওয়া, যাতে করে সর্বহারা তার নিজের বাড়িতে ঘুমাতে যেতে পারেন।...’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]