মোয়াজ্জেম হোসেন

শহীদ বুদ্ধিজীবী, নৌ কমান্ডার, পিরোজপুর, বরিশাল

মোয়াজ্জেম হোসেন

বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরিকালে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অযৌক্তিক বৈষম্য লক্ষ করে তিনি ক্ষুব্ধ হন।

একপর্যায়ে বাঙালি অফিসার ও সেনাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন।

এর ফলে তিনি পাকিস্তানি, বিশেষত পাঞ্জাবিদের বিরাগভাজন হন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করে ১৯৬৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয়।

তিনি ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২ নম্বর আসামি। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের চাপে বঙ্গবন্ধু ও তাঁকেসহ সব আসামিকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

তখন তিনি লে. কমান্ডার ছিলেন। তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি।

একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে শুরু করে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড।

সেনাবাহিনীর অন্যতম টার্গেট ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। অকুতোভয় বিচক্ষণ এই বাঙালি বীরসেনানীকে ২৬ মার্চ ভোরে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা তাঁর ৩৬ এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

তাঁকে প্রথমে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জ করা হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ স্বাধীন চাই’।

তাঁর মরদেহ পাকিস্তানি সেনারা সঙ্গে করে নিয়ে যায়। শোনা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর টিক্কা খান নিজে তাঁর মরদেহ দেখে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।


এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর স্ত্রী কোহিনূর হোসেনের বয়ান থেকে। তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ বিকেল থেকেই আমার স্বামী চঞ্চল ছিলেন।

রাত সাড়ে নয়টা-দশটার দিকে আমার এক কাজিন তাঁকে ফোন করে। তিনি তাঁর সঙ্গে কথা বলে শার্ট গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

আমাদের বাড়ি ছিল তিনতলা। আমরা নিচতলায় থাকতাম। দেখলাম রাস্তায় অনেক লোক দাঁড়িয়ে।

রাত পৌনে বারোটা হবে, এমন সময় দূরে ফায়ারিংয়ের আওয়াজ হলো। তখন লোকজন মেইন রাস্তা থেকে ভেতরের দিকে চলে গেল।

এ সময় তিনি আমাকে বাচ্চাদের নিয়ে দোতলায় যেতে বলেন। আমি বাচ্চাদের নিয়ে দোতলায় যাই। আমার স্বামী নিচেই থাকলেন।

‘রাত একটার দিকে তিনি দোতলায় আসেন। এর আগেই ব্ল্যাক আউট হয়ে গেছে। রাত বারোটার পর থেকে ট্যাংক চলার ও গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সারা রাতই এভাবে কাটল। ভীষণ ফায়ারিং ও চারদিকে আগুন। খুব ভোরবেলা অন্ধকার থাকতেই উনি ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসলেন।

তাঁর খুব ক্ষিধে পেয়েছিল। কাজের লোক নাশতা তৈরি করছিল। এমন সময় কতগুলো জিপ গাড়ি ও বুটের আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অনেক আর্মি অস্ত্র তাক করে আমাদের বাসার সামনে দাঁড়ানো।

শব্দ শুনে আমার স্বামীর তন্দ্রাভাব কেটে গেল। আমি তাঁকে বললাম, আর্মি ঘিরে ফেলেছে আমাদের বাসা।

তিনি ড্রয়িংরুম থেকে চলে গেলেন অন্যদিকে। কিন্তু পালানোর তো পথ নাই। চারদিকে আর্মি ঘিরে ফেলেছে।


‘তিনি কোথাও লুকিয়ে ছিলেন। আর আর্মিরা তাঁকে খুঁজছিল। তাঁকে না পেয়ে তারা চেঁচিয়ে বলে, মিসেস মোয়াজ্জেম কোথায়?

এটা তিনি শুনেছিলেন আর বোধহয় ভেবেছিলেন, আর্মি আমাকে টর্চার করতে পারে। তখন তিনি বেরিয়ে নিচে গিয়ে বলেন, আমিই কমান্ডার মোয়াজ্জেম।

আর্মি প্রথমে তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। ওরা তাঁকে উর্দুতে কয়েকবার বলেছে, “বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ”। তিনি বলেছেন, “না আমি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলব না।

আমার এক দফা, বাংলাদেশ স্বাধীন চাই।” তখন ওরা গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়েও বলেছেন বাংলাদেশ স্বাধীন চাই। এটা আমি নিজ চোখে দেখিনি। পরে প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি।


‘এদিকে এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দোতলার জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন।

এ সময় কয়েকজন আর্মি এল। তারা তাঁকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর দুই পা ও হাত ধরেছে। মাথাটা ঝুলছে। গোটা শরীর রক্তে একদম ভরা।

এ দৃশ্য দেখে আমি চিৎকার দিয়ে উঠি।


‘আমি আমার স্বামীর ডেডবডি পাইনি। পরে শুনেছি পাকিস্তানি আর্মিরা আমার স্বামীর লাশ তখনকার গভর্নর হাউস, এখন যেটা বঙ্গভবন, সেখানে নিয়ে গিয়েছিল টিক্কা খানকে দেখানোর জন্য।

তারপর তাঁর লাশ কী করেছে জানি না।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, নারী, প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারীর বিবরণ, তৃতীয় খণ্ড, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, প্রকাশ ২০০৭)।

মোয়াজ্জেম হোসেনের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, পিরোজপুর জেলার ডুমুরতলা গ্রামে।

বাবা মোফাজ্জেল হোসেন, মা লুৎফননেছা। বরিশাল বিএম (ব্রজমোহন) কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ১৯৫০ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন।

নৈপুণ্য ও দক্ষতা প্রদর্শন করায় ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডে নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির জন্য পাঠানো হয়।

রয়াল নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সব পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৯ সালে মেরিন বিশেষজ্ঞ কোর্সে ম্যানভিন রয়াল কলেজে অধ্যয়ন ও প্রথম স্থান অধিকার করেন।

তিনি দুই ছেলে ওয়ালি নোমান ও ওয়াসি নোমান (চার বছর আগে মারা গেছেন) এবং এক মেয়ে ওয়াদিয়া নোমানের জনক।

প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৩) থেকে।


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]