গণতন্ত্রই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সরকারব্যবস্থা

কৌশিক বসু, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক
কৌশিক বসু, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা তো করেছেনই, জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতার কথাও। বলেছেন দুর্নীতি, সুশাসন ও সরকারব্যবস্থা নিয়েও। জানিয়েছেন উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা। গণতন্ত্রকে ধরে রাখার পরামর্শও দিলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শওকত হোসেন

প্রথম আলো: অর্থনীতিবিদই হতে চেয়েছিলেন?

কৌশিক বসু: অর্থনীতিতে আমার আসাটা অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ, আমার বাবা আইনজীবী ছিলেন এবং ছোটবেলা থেকেই মানুষ হয়েছি যে বড় হয়ে আইনজীবী হব। আমাকে আইন পড়তে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল। কথা ছিল গোড়ায় একটু অর্থনীতি পড়ে তারপর আইন পড়ব। কিন্তু তখন আমার ওপর বিরাট একটা প্রভাব ফেলল অমর্ত্য সেনের লেকচার। তিনি তখন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে পড়াচ্ছেন। অভূতপূর্ব অমর্ত্যদার লেকচার। সেই লেকচার শুনে এত বেশি উৎসাহ পেলাম যে সিদ্ধান্ত নিলাম অর্থনীতিই পড়ব। সেই থেকে অর্থনীতিতেই আমার ক্যারিয়ার। গোড়ার দিকে দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসে অনেক বছর। এরপর আমেরিকায় চলে আসি। তারপর আবার ভারতে ফিরে এলাম। তখনকার দিনে কিন্তু পিএইচডি করে তেমন কেউ ফিরত না। আমি সেই স্বল্প কয়েকজনের একজন, দেশে ফিরে এসেছিলাম। এই হচ্ছে আমার অর্থনীতিতে আসার গল্প।

প্রথম আলো: একজন বাঙালি অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে আপনার কাজ করার অভিজ্ঞতাটি কেমন?

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকে খুবই ভালো অভিজ্ঞতা আমার। তিন বছর ধরে এখানে কাজ করছি। একটা হচ্ছে বৈশ্বিক সংযোগ, যেটা আমি খুব উপভোগ করি। বিভিন্ন দেশে যাওয়া, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে কথা বলা। আমি একবার লিখেছিলামও যে আমার ভেতরে অর্থনীতির সঙ্গে নৃতত্ত্বের একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। কারণ, একজন নৃতাত্ত্বিক গ্রামে গিয়ে বসে থাকে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এটা আমার সব সময়ই খুব ভালো লাগে। বিশ্বব্যাংকে এসে সেই অভিজ্ঞতাটি পাচ্ছি। বিভিন্ন দেশে গিয়ে তাদের নীতি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলা, গল্প করা—এসব তো মজাই। বাংলাদেশে আসাটা ভিন্ন কিছু না আমার জন্য, কারণ পাশের কলকাতায় মানুষ হয়েছি। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন ছোট্ট একটা দ্বীপরাষ্ট্রে চলে যাই, সাব-সাহারান আফ্রিকার কোনো দেশে যাই, সেটা একদম অন্য ধরনের পরিস্থিতি, তখনকার সেই অভিজ্ঞতা অন্য রকম। এর সঙ্গে দৈনন্দিন প্রশাসনিক চাপ তো আছেই। এটা হচ্ছে এসব সুবিধা পাওয়ার একটা মূল্য।

কৌশিক বসু
কৌশিক বসু
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। এর আগে পড়িয়েছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৫২ সালে কলকাতায় তাঁর জন্ম।

প্রথম আলো: আপনি যখন অর্থনীতিবিদ ছিলেন, তখন একরকমভাবে বিশ্বব্যাংককে দেখেছেন, হয়তো সমালোচনাও করেছেন। আবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার সময় আরেকভাবে দেখেছেন। এখন আপনি নিজেই বিশ্বব্যাংকে কাজ করছেন। অভিজ্ঞতাগুলো কী রকম?

কৌশিক বসু: আমি জানি, বিশ্বব্যাংক বিশাল একটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান। এর ভেতরে তার একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। আমি যখন ভারতে কাজ করি, তখন কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমার অনেক কথাই হতো। আমি অনেক কিছু জানতে চাইতাম। ব্রাজিলে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা কীভাবে হয়েছে, সেটা জানতে চাইতাম। এ ব্যাপারে আমার পরিষ্কার ধারণা ছিল যে এটা একটা অনেক বড় কার্যকরী প্রতিষ্ঠান এবং আমি তাদের সঙ্গে সেই সম্পর্কটাই রাখব।

প্রথম আলো: ক্যারিয়ারের শুরুতে কখনো বিশ্বব্যাংকে কাজ করতে চাননি?

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কিন্তু আমার প্রথম কথাবার্তা হয়েছিল আরও আগে, যখন আমি পিএইচডি শেষ করি। বিশ্বব্যাংকে ইয়াং প্রফেশনাল নামে একটি কর্মসূচি আছে, সেখানে গেলে সারা জীবনের জন্য চাকরি হয়ে যায়। আমি আবেদন করলাম। ইন্টারভিউতে ডাকল। শেষ রাউন্ডের ইন্টারভিউ হলো প্যারিসে। বিশ্বব্যাংকের চাকরি বলে আমার বাবা-মা খুব উত্তেজনার মধ্যে ছিলেন। আমি যদিও খুব বেশি উত্তেজনার মধ্যে ছিলাম না। পেলে ভালো, না পেলে না। চাকরি কিন্তু পেলাম না। পাস করতে পারলাম না শেষ ইন্টারভিউতে। আমি এখন সত্যি মনে করি, জীবনের কিছু কিছু ব্যর্থতা আশীর্বাদও হয়।

আমি আপাদমস্তক একজন গবেষক। যদি বিশ্বব্যাংকের ওই চাকরিতে চলে যেতাম, তাহলে এটা আর হতো না। তাহলে পুরো চাকরিজীবন আমার আরেক ধরনের হতো। আমি যা করেছি সত্যিই আমি উপভোগ করতাম। আমার কাছে পেপার লেখা বা ক্লাসরুম লেকচার দেওয়া সত্যি দারুণ আনন্দদায়ক। আমি আমার নিজে ছেলেমেয়েদেরও বলি যে আমি ভাগ্যবান। কারণ, আমি যা করতে ভালোবাসি, তা করতে পেরেছি। একটা চাকরি ভাগ্যে পাইনি, আর আইনটা যদি পড়তাম, তাহলে কলকাতাতেই থেকে যেতাম, পৈতৃক আইন পেশারই হয়তো চর্চা করতাম।

প্রথম আলো: একাধিকবার আপনার লেখায়, বক্তৃতায় বলেছেন আপনি গবেষণাকেই বেশি পছন্দ করেন। আর গবেষণা হচ্ছে একটা খেলার মতো, অনেকে হয়তো একই বিষয় নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু সবার আগে যিনি কাজটা শেষ করতে পারবেন তিনিই বিজয়ী। এটা কি এখন মিস করেন?

কৌশিক বসু: আমার কাছে গবেষণাটা মনে হয়, এটা একটি লজিক। আমি এতে আগ্রহ পাই। অমর্ত্যদার গোড়ার কাজ ছিল পুরোপুরি লজিকনির্ভর। তিনি গাণিতিক লজিক ব্যবহার করতেন অর্থনীতিতে। এটা আমার প্যাশন। সেটা আমি উপভোগ করতাম এবং এখন মিস করি। তবে ভাগ্য ভালো যে বিশ্বব্যাংকে একটা বড় গবেষণা বিভাগ আছে। তারা আমার অধীনে। যদিও এমন নয় যে আমি তাদের সঙ্গে বসে গবেষণা করতে পারছি। আবার কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁদের সঙ্গে কিন্তু আমি এখন কাজ করতে পারছি। এ জন্য ওয়াশিংটনকে ধন্যবাদ দেব। সম্প্রতি আমি জোসেফ স্টিগলিজের সঙ্গে কাজ করেছি। ইউরো জোন-সংকট কীভাবে ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়, তার একটি অংশ নিয়ে একটা পেপার লিখেছি। এখানেও আমরা আবার ‘গেম থিউরি’ ও গেম থিউরির লজিক ব্যবহার করেছি। তারপরেও বলব, গবেষণাকে আমি অনেক মিস করি এটাই সত্য।

প্রথম আলো: শুনেছি, আপনার কাজ প্রসঙ্গে আপনার মাকে নিয়েএকটা মজাদার স্মৃতি আছে?

কৌশিক বসু: এই অংশটা মজাদার। আমি লিখেছিও। আমার মা মারা যান ৯১ বছর বয়সে। শেষ দুই বছর মা শব্দ একটু গুলিয়ে ফেলতেন। একবার আমি কলকাতায় এসে মাকে বললাম যে একটা কনফারেন্সে যাচ্ছি। আর মাকে যেমন বাড়িয়ে-টাড়িয়ে বলতে হয় সে রকমভাবে খুশি করতে বললাম, সারা বিশ্বের বড় বড় ইকোনমিস্ট আসছেন। আমাকেও যেতে হবে। তারপর শুনি, মা কাকে যেন বলছে আমার ছেলে খুব ভালো করছে, একটা কনফারেন্সে যাচ্ছে, যেখানে সারা পৃথিবীর কমিউনিস্টরা আসবে।

প্রথম আলো: এবার একটু বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি। আপনি ২২ বছর পর বাংলাদেশে এলেন। এসে অনেক প্রশংসাও করছেন। আপনার এত প্রশংসার ভিত্তি কী?

কৌশিক বসু: একটা বিষয় আছে যে নিজেদের লোকেরা অনেক বেশি সমালোচনা করেন। ভারতেও সেটা দেখি। এর মাধ্যমে সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য হন। এটা ভালো। তবে এখানে এসে আমার নিজের যা মনে হয়েছে সেটাই বলেছি। কেবল একজন বাঙালি বলে নয়, আমি ওয়াশিংটনে বসে পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখেছি। আমার ওখানে প্রসপ্রেক্টস গ্রুপ নামে একটি বিভাগ আছে। তাদের ডেকে আমি বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটছিলাম। তারাও আমাকে জানাল যে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এখন খুব কম জায়গায়ই হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকায় প্রবৃদ্ধি এখন ১ শতাংশেরও কম। ব্রাজিলে মাইনাস ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ভেনেজুয়েলাতেও নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি। জাপানে তৃতীয় প্রান্তিকে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফিনল্যান্ডে আমি ছিলাম, তারই ভেতরে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধির খবর এল। বিশ্বব্যাপী এ রকম এক মন্দার সময়ে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অবশ্যই উল্লেখ করার মতো। এটা এখানকার লোকদেরও বোঝা দরকার। তাদেরও প্রশংসা করা উচিত। কার জন্য হচ্ছে সেটা জানি না, কিন্তু এটা অবশ্যই বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি।

আমাদের নিজস্ব প্রাক্কলন হচ্ছে আগামীবার বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা হবে চীনের প্রবৃদ্ধির সমান। পাঁচ বা সাত বছর আগেও ভাবা যেত না যে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেবে বাংলাদেশ। ভারতের প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে। বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্র কিন্তু অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের মানুষের আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে। আবার একটা কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আশাবাদটা আমি দিতেও চাই। কারণ, এটা একসঙ্গে কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায়, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ্রহ জন্ম দেয়।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতির বাধা প্রসঙ্গে আপনি জঙ্গিবাদ নিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন। রাজনৈতিক কিছু সমস্যার কথাও বলেছেন। একটু ব্যাখ্যা করবেন?

কৌশিক বসু: পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই এখন রাজনৈতিক ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে দেখছি যে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম আরও কমে গেলে এর কিছু প্রভাব পড়বে। চীনের অর্থনীতির গতি শ্লথ হলে এর ফলাফল হবে। কিন্তু এখন রাজনৈতিক ঝুঁকিটাকেই উচ্চমাত্রায় বিবেচনা করা হচ্ছে। এই ঝুঁকি সব দেশের জন্যই। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আলাদা কোনো জায়গায় নেই। কিন্তু অবশ্যই অনেক সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে যেতে পারে, যদি সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি থাকে। ভারতকে এ জন্য চিন্তা করতে হবে, বাংলাদেশকেও চিন্তা করতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। তবে ভাগ্য ভালো, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তা অত্যন্ত স্থিতিশীল। হ্যাঁ, কিছু ঘটনা তো ঘটেছেই। সব দেশেই তা হয়। তবে অবশ্যই যতটা সম্ভব তা কমানো যায়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। তবে আমি বলব, সাধারণ মানুষদের বুঝতে হবে যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের যুদ্ধ কেবল সরকারকে দিয়ে হয় না। সাধারণ মানুষেরা যদি অনুভব করে যে সমাজ আগালেও সন্ত্রাসবাদ তা নষ্ট করে দিতে পারে,তাহলে সাধারণ মানুষদেরও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধে যুক্ত হতে হবে। তাহলেই এর ঝুঁকি কমবে। সাধারণ মানুষের প্রতি আমার এটাই পরামর্শ। আর হ্যাঁ, দুর্নীতির মাত্রা নিয়ে মানুষেরা অনেক রেগে যায়। রাগার কথাও। তাই বলে পুরো দেশটাই যে নষ্ট হয়ে গেছে তা নয়। দুর্নীতিবাজদের ধরতে হবে, ব্যবস্থাও নিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধের যুদ্ধটাও চালিয়ে যেতে হবে।

প্রথম আলো: গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্কটা তাহলে আপনি কীভাবে দেখেন?

কৌশিক বসু: আমার মতামত অমর্ত্যদার কাছাকাছি, তবে একদমই এক নয়। একনায়ক বা ‘ডিকটেটরিয়াল কন্ট্রোল’ যেসব দেশে আছে, সেখানে অভিজ্ঞতাটা বিভিন্ন রকমের দেখা গেছে। কোনো কোনো দেশ খুবই ভালো করছে, আবার পুরোপুরি বিপর্যয়ও হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি ও বিপদ দুটোই।

এ ক্ষেত্রে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আমার এই চাকরির একটা আনন্দ যে অনেক চমকপ্রদ মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। নিকারাগুয়ার বিপ্লবী নেতা ও প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওর্তেগার সঙ্গে মানাগুয়াতে দেখা করেছিলাম। আমিই তাঁর সাক্ষাৎ চেয়েছিলাম। বলেছিলাম সামোজা সরকারের বিরুদ্ধে সান্দানিস্তাদের সংগ্রাম নিয়ে ছাত্রজীবনে আমার খুব আগ্রহ ছিল। এ কারণে সান্দানিস্তার সেই বিপ্লবী নেতার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারপর তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। নিকারাগুয়ায় একনায়ক সামোজা সরকারের সময়ে কিন্তু বিপর্যয় ঘটেছিল। পুরো দেশ বড় সংকটে পড়ে গিয়েছিল। এ রকম প্রচুর উদাহরণ আছে।

আবার কিছু কিছু দেশ আছে, যাদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শক্ত এবং তারা ভালো করছে। চীন এ রকম একটি বড় উদাহরণ। তাদের সরকার অনেক শক্তিশালী এবং করছেও অনেক ভালো। আরেকটি উদাহরণ সিঙ্গাপুর। কিন্তু যদি বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে বেছে নেওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। সেটা ঠিক হবে না। কারণ, বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, গণতন্ত্র ছাড়া শক্ত নিয়ন্ত্রণ পুরো দেশকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। ১৯৬০ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার প্রবৃদ্ধি মন্দ ছিল না। তারপরে তা বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেল।

আমি এ ব্যাপারে খুবই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই যে গণতন্ত্রই একমাত্র কাঙ্ক্ষিত বিষয়। উন্নয়নের জন্য সরকার ও মানুষকে অবশ্যই গণতন্ত্রকে ধরে রাখতে হবে। গণতন্ত্রে অনেক সমস্যা আছে। প্রথমত, নীতি সংস্কার ঝটপট করা যায় না। ভারতে কাজ করে দেখেছি, সবারই একটা মতামত আছে। একটা নীতি বদল করতে গেলে চারদিক থেকে বিভিন্ন মতামত আসে। কিন্তু আমি তখন সরকারকে বলতাম, এটা একটা সমস্যা বটে কিন্তু এর মধ্যেই থাকতে হবে। আর মানুষকেও বলা, তাদেরও দায়িত্বপূর্ণ হতে হবে। সবকিছুতে বাধা দিয়ে সরকারকে থামিয়ে দিলে দেশ অচল হয়ে যাবে। গণতন্ত্র এমনই একটা জিনিস, যা আস্তে আস্তে পরিপক্ব হয়। আমি যখন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর দিকে তাকাই, তখন মনে হয় অনেক দিক থেকেই তাদের গণতন্ত্র অনেক পরিপক্ব। সেখানেও অনেক বিতর্ক হয়, সমালোচনা হয়। কিন্তু তারপরেও পুরো সমাজ তাতে অংশ নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। সুতরাং কোনো প্রশ্নই নেই যে গণতন্ত্রই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সরকারব্যবস্থা।

প্রথম আলো: আবার বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসঙ্গে আসি। আপনি বাংলাদেশের বিনিয়োগ হারের প্রশংসা করেছেন। অথচ দেখছি বেসরকারি বিনিয়োগ ১০ বছর ধরেই এক জায়গায়, ২২ শতাংশে স্থির হয়ে আছে। সরকার নিজের বিনিয়োগ বাড়িয়ে সেটিকে জিডিপির ২৯ শতাংশে নিয়ে গেছে। যদিও এই বিনিয়োগের গুণগত মান নিয়ে বিশ্বব্যাংকেরই বড় ধরনের অভিযোগ আছে।

কৌশিক বসু: দেখুন, সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কিন্তু যথেষ্ট ভালো। এটাও সত্যি, বাংলাদেশের পক্ষে ৮ শতাংশে যাওয়া সম্ভব। আমার তো ধারণা, বিনিয়োগের হার ৩২-৩৩ শতাংশে এসে গেলে প্রবৃদ্ধিও বেড়ে যাবে। এর মধ্যে যদিও বিশ্ব অর্থনীতির ওঠানামার সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকবেই। তবে দীর্ঘ মেয়াদে তা বাড়বে। আর সরকারি বিনিয়োগের কথা যা বললেন, ভারতেও কিন্তু তাই হয়েছে। ভারত বিনিয়োগের হার ৩০ শতাংশ অতিক্রম করল ২০০৩ সালে। তার চার-পাঁচ বছর আগ পর্যন্ত তা ২২-২৩ শতাংশে আটকে ছিল। এরপর চরচর করেগোটা কয়েক বছরে তা বেড়ে গেল। তখন সরকার সঞ্চয়ের ভূমিকায় চলে গেল, যা তারা আগে ছিল না। বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা কিন্তু মোটামুটি ভালো হচ্ছে। সরকার সঞ্চয় না করে বিনিয়োগকারীর ভূমিকায়। বেশির ভাগ দেশও তাই করে। তবে এখানে যে জায়গায় মনোযোগ দিতে হবে, তা হচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ আরও আনতে হবে। এখন জিডিপির ১ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, তা খুব খারাপ নয়। কিন্তু এই হার আরও বাড়িয়ে ২ বা ৩ শতাংশে আনা যেতে পারে। এ জন্য অবশ্যই অবকাঠামোকে আরও ভালো করতে হবে। বাইরে থেকে যারা আসছে তারা বিদ্যুৎ চায়, রাস্তা চায়, পথটা দিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে চায়, ব্যবসার পরিবেশ অনেক ভালো চায়। যাতে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো আরও দ্রুত হয়।

আমি যখন ভারতে কাজ করতাম, তখন আগে উপনিবেশ হিসেবে ছিল, এ রকম দেশগুলোর সঙ্গে অনেক কথা বলেছি। মনে আছে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে অনেক সময় কাটাতাম। সবাই উত্তরাধিকারসূত্রে একই ব্যবস্থা পেয়েছি। বাংলাদেশও পেয়েছে। কিন্তু ব্রিটেন নিজে সংস্কার করেছে। ওদের ফাইল চলার গতি অনেক দ্রুত। অস্ট্রেলিয়াও প্রচুর সংস্কার করেছে। অথচ আমরা সেই ঔপনিবেশিক চর্চা বদলাতে পারিনি। সুতরাং আমাদের এদিক থেকে দ্রুত আগাতে হবে, যাতে ফাইল দ্রুত আগায়। নীতি বদল করে এটা করা যায়। আবার আমাদের আমলাদের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে, যাতে তারাও দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শামিল হয়। সুতরাং বলতে পারি, অবকাঠামোর যদি আরও উন্নতি করা যায়, আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ, এখানে সস্তা শ্রমের বড় আকর্ষণ আছে। চীনের সেই সুবিধা কিন্তু চলে গেছে। সেখানে মজুরি বেড়ে যাচ্ছে। ভারতে মজুরি বাংলাদেশের চেয়ে কিছু বেশি হলেও ভারত আরও কয়েক বছর এই সুবিধা পেতে থাকবে। চীন যে জায়গাটা ছাড়বে সেটি এত বড় যে ভারত তো খুব ভালোভাবেই পাবে, বাংলাদেশও পাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিযোগিতা হবে না। দুই দেশই বিশ্বকে দিয়ে যেতে পারবে।

প্রথম আলো: আপনি আমলাতন্ত্র বা দুর্নীতির যে কথা বলছেন তা সুশাসনের অংশ। আগে বিশ্বব্যাংক এ নিয়ে অনেক সোচ্চার ছিল। কিন্তু এখন আর তেমন শোনা যায় না। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বদলের পরে। আপনারা কি নীতির পরিবর্তন এনেছেন?

কৌশিক বসু: আমি তো তিন বছর ধরে বিশ্বব্যাংকে আছি। এমন তো মনে হয় না। আমরা যে ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করি, তার পরেরটা বের হচ্ছে ‘ডিজিটাল টেকনোলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামে। এটি বের হবে আগামী জানুয়ারিতে। পরেরটি বের হবে ‘গভর্ন্যান্স অ্যান্ড রুল অব ল’ শিরোনামে। আমরা জানি, এটা নিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিতর্ক তৈরি হবে। এখানে দুর্নীতির ওপর আলোচনা থাকবে, সরকার পরিচালনা নিয়ে আলোচনা থাকবে। আর আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা যখন সরকার পরিচালনা ও দুর্নীতি নিয়ে করা হয়, তখন বুঝতে হবে এ নিয়ে যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছি।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চায়। ৭ বা ৮ শতাংশে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চায়। এ ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

কৌশিক বসু: ভালোভাবে শাসন পরিচালনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর প্রবৃদ্ধির কথা বলতে পারি, এটা কম-বেশি ‘অটো পাইলটের’ মতো করে চলবে। আর যেটা বললাম, অবকাঠামো আর আমলাতন্ত্র কমালে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ হতে পারবে। কিন্তু সুশাসন এমন একটা বিষয়, যেখানে সাধারণ মানুষ অনেক স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু কাজটা অত্যন্ত কঠিন। আমরা যে বলি সুশাসন বাড়াও, এটা আসলে খুবই জটিল প্রক্রিয়া। চাইলেও অনেক সময় করা যায় না। আমি যখন ভারতে কাজ করতাম, দেখতাম অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী কাজটা করতে চায়। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে, সেটাই বুঝতেন না। আমরা আশা করছি, কীভাবে সরকার পরিচালনার মান বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আমাদের পরবর্তী রিপোর্টে অনেক আইডিয়া দিতে পারব।

প্রথম আলো: একটু প্রসঙ্গ বদল করি। প্রশ্নটা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ট্রানজিট নিয়ে। এটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু একটি সাধারণ ধারণা হচ্ছে, ভারত যা চায় তাই পাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তি কম। এ ধারণা থেকে সাধারণ মানুষদের বের করার উপায় কী?

কৌশিক বসু: দেখুন, এটা হতে বাধ্য। একটা বড় দেশের সঙ্গে যখন লেনদেন হয়, তখন মনেই হয় যে বড় দেশটিই বেশি পাচ্ছে। ভারত যখন আমেরিকার সঙ্গে কোনো চুক্তি করে, তখন ভারতেও বলা হয় আমেরিকা বড় অংশটাই পেল, ভারত পেল না। একটা কথা অবশ্যই বলব যে নিজের স্বার্থ নিজেকেই দেখতে হবে। যখন আরেক দেশের সঙ্গে একটা ডিল বা চুক্তি করা হয়, তখন সে নিজের স্বার্থ দেখছে, বাংলাদেশ দেখছে তারটা। তবে দুটো দিকই ভুল আছে। লোকেরা ধরে নেয়, যাকে আমরা অর্থনীতির ভাষায় বলি ‘জিরো সাম গেম’, ওর লাভ হওয়া মানে আমার ক্ষতি হচ্ছে। সুতরাং যে-ই দেখা গেল একটা ডিল হওয়ার পর ভারতে সবাই উৎসব করছে, তখন তুলনামূলক আরেকটি ছোট দেশের মনে হবে ওরা উৎসব করছে মানে তাদের ক্ষতি হয়ে গেল। এটা ঠিক নয়। অর্থনীতিতে এমন অনেক ডিল আছে, যা থেকে উভয় দেশই লাভবান হয়েছে। সত্যি কথা বলতে, ভালোভাবে চুক্তি করতে পারলে তা উভয়ের জন্য ভালো হয়। ভারত যখন আরেক দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে যাবে, তখন প্রধানত দেখা হয় কী লাভ হবে। কারণ, কেউ তো চ্যারিটি করতে যায় না। বাংলাদেশও দেখবে তাদের জন্য কী লাভ থাকবে। এই যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বা ট্রানজিট—এ থেকে কারোরই ক্ষতি নেই। মেধাভিত্তিক সামর্থ্য দুটো দেশেরই যথেষ্ট আছে। আমি সত্যিই মনে করি, ভারতের সঙ্গে খুব ভালোভাবে আলোচনা করার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। এই পরামর্শ আমি সবাইকে দিই না, বিশেষ করে যাদের সেই সক্ষমতা নেই। বরং তাদের বলি, বহুজাতিক কারও সঙ্গে ডিল করবে খুব সাবধানে। একটা খারাপ চুক্তি করলে সারা জীবন পস্তাতে হবে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা নয়। দুই দেশেরই সামর্থ্য আছে। আর সম্প্রতি যে চুক্তিগুলো হয়েছে, আমি তো মনে করি, তা থেকে উভয় দেশের জন্যই সুবিধা পাওয়ার অনেক সুযোগ আছে, সুবিধা পাবেও।

প্রথম আলো: পদ্মা সেতুর পুরো ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাংক কী শিক্ষা পেল?

কৌশিক বসু: কী শিক্ষা পেলাম জানি না। তবে এইটুকু জানি, ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, হতে পারে ওই ইতিহাসটির কারণেই ফল যেটা এসেছে, সেটি খুবই ভালো হয়েছে। এই ফল হয়তো হতো না, যদি ওই ঘটনা না ঘটত। আমি বলছি না যে আবার ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক, তবে নিজে থেকে পদ্মা সেতু করার কথা কিন্তু সাত-আট বছর আগে ভাবাও যেত না। এটা হচ্ছে শেষ পাঁচ-ছয় বছরের ব্যাপার। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ, ২০০৯-এ ছিল ৮ বিলিয়ন। এখন ২৭ বিলিয়ন। সুতরাং বাংলাদেশ এখন যা পারে, তা সাত-আট বছর আগেও ভাবতে পারত না। আমার কাছে মনে হয়, একটা দেশ করতে পারে এবং করে দেখাচ্ছে। আর আমি আশা করছি, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও ভালো সংযোগ তৈরি হবে এবং সেটি হবে পার্টনারশিপের ভিত্তিতে। আর আশা করি, আমি অন্তত যত দিন এখানে আছি, আমি সাহায্য করব যাতে পার্টনারশিপ আরও ভালো হয়।

প্রথম আলো: কিন্তু পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ তুলেছিল, তার তো সুরাহা হয়নি। দুর্নীতির ইচ্ছার অভিযোগটা থেকেই গেল। এতে কি দেশের ভাবমূর্তির সংকট হবে?

কৌশিক বসু: ভবিষ্যতে ভাবমূর্তির কোনো ক্ষতি আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে দুর্নীতি এমনই একটা বিষয়, যা প্রতিটা দেশকেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্নীতি কমানোর পরামর্শ তো আমি সব উন্নয়নশীল দেশকেই দেব।

প্রথম আলো: সব দেশ মিলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি গ্রহণ করেছে। এর লক্ষ্যগুলো উচ্চাভিলাষী এবং বাস্তবায়নে অর্থায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের কী ভূমিকা থাকবে?

কৌশিক বসু: এটা এখনো একটি ওপেন কোশ্চেন হয়ে আছে। যেটাতে আমাদের সামর্থ্য সেটা হলো, এসডিজির গোটা কতক লক্ষ্য আমরা পরিসংখ্যানের দিক থেকে নিয়মিত নজর রাখব। এই কাজে বিশ্বব্যাংক খুবই ভালো। এই যে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে আমরা প্রচুর সমালোচনা পাই বটে, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের যে গ্রুপ এ নিয়ে কাজ করে, তারা অত্যন্ত দক্ষ। এটা আগে আমি জানতাম না, এখানে এসে দেখি, এ কাজে তারা আসলেই অনেক দক্ষ। কাজটা অত্যন্ত জটিল। এখন সারা পৃথিবীর দারিদ্র্য হার গণনা করা হচ্ছে, যেটাকে আমরা ‘পভক্যালনেট’ বলি, এটা খুব ভালোভাবে করা হয়। আমি আশাবাদী যে এসডিজির বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে গোটা কয়েকের ক্ষেত্রে এর তথ্য ও উপাত্ত ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাংক কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্ব নেবে। তবে এটাতে রাজনৈতিক একটা ব্যাপার এসেই যায়। কারণ, কিছু উপাত্ত নিয়ে লোকজন এদিক-সেদিক করতে চায়। আশা করছি বিশ্বব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আর আমি একটা কমিশন গঠন করেছি। আমাদের যে দারিদ্র্য নিরূপণ হয় সেটিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে এই কমিশন। সেটার প্রধান হচ্ছেন খুব বড় একজন অর্থনীতিবিদ, টনি অ্যাটকিনসন। কমিটির উপদেষ্টাদের মধ্যে অমর্ত্য সেন আছেন। আমরা যে এখন কেবল দারিদ্র্য হার পরিমাপ করি, সেখান থেকে আরও বৃহত্তর জায়গা থেকে কী করতে পারি, তা নিয়ে কমিশন আমাদের সুপারিশ করবে। দেখেন, ভারতের দারিদ্র্য হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। অথচ অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। দারিদ্র্য হার তো শুধু টাকা দিয়ে পরিমাপ করার বিষয় নয়। দারিদ্র্যকে আরও বহুমাত্রিক জায়গা থেকে দেখতে হবে। দারিদ্র্য কেবল ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে পরিমাপ করা উচিত নয়। এ কমিশন এসব নিয়েই কাজ করছে। রিপোর্টটি পেতে মে-জুন হয়ে যাবে। রিপোর্টটি পেলে এটা আমরা এসডিজির সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করব এবং আমাদের কাজটা কী হবে, তাও ঠিক করব তখন।

প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংকে ধনী দেশগুলোর কণ্ঠ অনেক বেশি জোরালো, তাদের ভোটাধিকারও বেশি। আপনি আমাদের মতো একটি দেশ থেকে বিশ্বব্যাংকে আছেন। এ বিষয়ে কিছু কি করার আছে আপনার?

কৌশিক বসু: এটা সত্যি যে ধনী দেশগুলোর কণ্ঠ এখানে অনেক বেশি। কিন্তু যেসব দেশের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা কিছুটা ভালো, সে দেশের অনেক মানুষ এখন বিশ্বব্যাংকে কাজ করে। এটা ঠিক যে এসব দেশের ভোটের ক্ষমতা খুবই কম। কিন্তু এখন বিশ্বব্যাংকে কাজ করে প্রচুর ভারতীয়, প্রচুর বাংলাদেশি। এদের উপস্থিতির মাধ্যমে কিন্তু ওই দেশগুলো তাদের কণ্ঠ বাড়াতে পারছে। কারণ, তাদের নিজের দেশের প্রতি একধরনের সম্পৃক্ততা কিন্তু তাদের ভেতর থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে। এই সুবিধা কিন্তু সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর নেই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

কৌশিক বসু: আপনাকেও ধন্যবাদ।