পুরান ঢাকা হোক নতুন পর্যটনকেন্দ্র

ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবনধারা আর শৈল্পিক স্থাপত্যের মেলবন্ধন পুরান ঢাকা। এখানে আছে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, বিরিয়ানি, বাকরখানিসহ রসনা তৃপ্তিকারী নানান খাবার; তামা, কাঁসা, শঙ্খের মতো হস্ত ও কুটিরশিল্প; নদীতে নৌযান এবং বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় বাহন রিকশা। এগুলো সবই নগরভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্র বিকাশের উপকরণ। এতসব ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সুব্যবস্থাপনার অভাবে পুরান ঢাকায় পর্যটকের আনাগোনা একেবারেই নগণ্য। অথচ স্থাপনা সংস্কার, সুশৃঙ্খল যাতায়াত ব্যবস্থা, আবাসন সুবিধা এবং নোংরা-আবর্জনা পরিষ্কার করে অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই পুরান ঢাকা হয়ে উঠতে পারে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র। পর্যটকদের পাশাপাশি আসবে বিদেশি বণিকশ্রেণি, যাদের মাধ্যমে এখানকার পণ্য বিশ্ববাজারে প্রবেশের সুযোগ পেতে পারে। তাতে যেমন সুফল পাবে এখানকার অধিবাসীরা, তেমনি সমৃদ্ধ হবে জাতীয় অর্থনীতি।
আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার একটি অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। বুড়িগঙ্গা নদীতীরের এই স্থাপনাকে ঘিরেই গড়ে উঠতে পারে উন্নয়নবলয়। বি কে দাস রোড, শাঁখারীবাজার, প্যারী দাস রোড পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের প্রাণকেন্দ্র বাংলাবাজারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্যারী দাস রোড। ঘরের সামনে বা ভেতরে খোলা প্রাঙ্গণ ছেড়ে অনেকটা বাংলো ধাঁচে তৈরি এখানকার বাড়িগুলো। স্থাপত্যশৈলীতে ব্রিটিশ ধারা সুস্পষ্ট; মোগল প্রভাবও দেখা যায় কিছু ভবনে। শাঁখারীবাজারে রয়েছে শত বছরের পুরোনো সব ভবন। উঠানভিত্তিক আবাসনব্যবস্থা এলাকাটির মৌলিকতা। বি কে দাস রোডে প্রায় পাঁচটি জমিদারবাড়ি রয়েছে। বড়বাড়ি, বাইজি বাড়ি, মঙ্গলালয়, বিবি কারউজা, বঙ্কুবিহারি জিউ মন্দিরসহ রয়েছে অনেক প্রাচীন স্থাপনা। এ ছাড়া পুরান ঢাকাজুড়েই রয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শন।
এসব নিদর্শন ও স্থাপনার নকশা পরিবর্তন করলেই নষ্ট হবে স্বকীয়তা। তাই পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য স্থাপনার কাঠামো, নকশা অপরিবর্তিত রেখে নতুনভাবে অলংকরণ করতে হবে। বাইরের নকশা পুরোনো মনে হলেও ভেতরে থাকবে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। জানালায় কাচ বা কাঠের ব্যবহার, শেডিং ডিভাইস, বারান্দা, বাড়ির রং, ভেন্টিলেশন সিস্টেম প্রভৃতি এমন হবে তা যেন ভবনের সৌন্দর্য বাধাগ্রস্ত না করে। নতুন বাড়িগুলোও পুরোনো আদলেই তৈরি হবে। একটি ভবনের কারণে আরেকটি ভবন যেন আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটাও থাকবে নকশায়।
পুরান ঢাকার সড়কগুলো সরু, তাই যানজট নিত্যসঙ্গী। সময়ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ বা টাইম জোনিংয়ের মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব। বাণিজ্যিক অঞ্চল হওয়ায় দিনের বদলে রাতে মালামাল পরিবহন করতে হবে। পর্যটকদের নির্বিঘ্নে চলাচলে থাকবে আলাদা লেন। রিকশা পর্যটন সহায়ক বলে দিনের সময়কে ভাগ করে একমুখী রিকশা চলাচল ব্যবস্থা করেও যানজট সমস্যা নিরসন করা যায়। বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস এবং পানির লাইন রাস্তার নিচে টানেলে থাকবে। যেসব রাস্তায় আগুন নেভানোর গাড়ি ঢুকতে পারে না, সেখানে হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা থাকবে। কিছু দূর পরপর মুখ থাকবে, যেখান থেকে পানি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে সামগ্রিক উন্নয়নে শুধু ভবন ও অবকাঠামো ছাড়াও প্রবহমান জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবকিছুকে সমন্বয় করতে হবে। যেমন, মানুষের চলাফেরা, আড্ডাবাজির ধরন, বসার জায়গা, উৎসব ও খেলাধুলা। এ ছাড়া সড়কবাতি, দোকানের সাইনবোর্ড, ফুল ও ফলের গাছ কোনো কিছুই উন্নয়নের বাইরে থাকবে না।

>এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ দীর্ঘদিন থেকে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে আসছে। তারা প্রতিটি বিষয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আলাদা সমাধান বের করেছে

পুরান ঢাকা শুধু পুরোনো বাড়িঘর নয়, এ এক জীবন্ত ইতিহাস। এই ইতিহাসের সঙ্গেই এখানকার মানুষের বসবাস। স্থাপনার অবয়ব যদি পরিবর্তন হয়, তাহলে জীবনের ছন্দই ভেঙে যাবে, এমনকি গোটা সমাজব্যবস্থাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। তা ছাড়া, প্রথাগত আচার, ব্যবহার, ভাষা, সংস্কৃতি ও স্থাপত্য পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। স্থানীয় লোকজনের অধিকাংশই আদি ঢাকাইয়া। তাদের জীবনযাপন কিছুটা রক্ষণশীল। তাই উন্নয়নে তাদের চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে। অর্থাৎ বর্তমান জীবনযাত্রায় তারা সন্তুষ্ট কি না বা কোন কোন বিষয়ে তারা পরিবর্তন চায়, আর কোথায় আপত্তি এসব জানতে হবে। জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না এমন কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। পুরান ঢাকার ভূমিবিন্যাস ও ভবন নির্মাণ–বিষয়ক জটিলতা সমাধান না করলে কখনোই এই এলাকাকে পর্যটন শহরে রূপায়িত করা যাবে না।
বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর কাঠামো, নকশা, কারুকাজ, টেকনিক ইত্যাদি ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং রাজউকের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে সম্পূর্ণভাবে স্থান পায়নি। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ এবং নতুন ভবন নির্মাণে সরকারের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনাও নেই। স্থাপনা সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল কিছু পদক্ষেপ নিলেও বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে সরকার ও জনগণের মাঝে ভুল-বোঝাবুঝি রয়ে গেছে।
কেউ পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন গড়েছে আবার বিভিন্ন সময়ে জারিকৃত নিষেধাজ্ঞার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস করছে অনেকেই। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ দীর্ঘদিন থেকে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে আসছে। তারা প্রতিটি বিষয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আলাদা সমাধান বের করেছে। এ প্রক্রিয়ায় পুরান ঢাকাকে ফ্লোর এরিয়া রেশিওর (এফএআর) আওতায় এনে ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ করতে হবে। ভবনমালিক যে ক্ষতি মেনে নেবেন, এ জন্য সরকার থেকে তাঁকে আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে, যাতে তিনি অন্য কোথাও ভবন নির্মাণ করে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন। আবার যাঁদের ভবন ঐতিহ্যবাহী নয়, সে ক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনাতিরিক্ত ফ্লোরগুলো বিক্রি করতে পারবেন। প্রয়োজনে বাড়ি তৈরি ও বিক্রির বিষয়টি দেখভাল করবে রাজউক। এভাবেই রক্ষা পাবে ইতিহাস, লাভবান হবে সবাই।
সরকারের আন্তরিকতা আর সবার প্রচেষ্টাই পারে পুরান ঢাকাকে তিলোত্তমা পর্যটন শহরে রূপায়ণে, যেখানে মানুষ বাস করবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে। আর পুরান ঢাকা হয়ে উঠবে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র।
ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ: অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
মাহফুজ ফারুক: পরিবেশ ও স্থাপত্যবিষয়ক সাংবাদিক।