ট্রাম্পের বিপক্ষে সটান দাঁড়াতে হবে

যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রচারণায় ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানে মানুষ যেমন ভয় পেয়েছিল, তেমনি তাঁর প্রতি আকৃষ্টও হয়েছিল। তাঁর প্রচারণা নিয়ে একসময় মানুষ উপহাস করলেও তাতে সফলতা মিলছে, সম্প্রতি মিসিসিপি, মিশিগান ও হাওয়াইয়ের প্রাইমারি নির্বাচনেও তিনি জিতেছেন। ফলে পণ্ডিতেরা এই বিষয়টি বোঝার জন্য ঐতিহাসিক ও বিদেশি তুলনা খুঁজছেন। কোনো তুলনাই যথার্থ না হওয়ার পর দেখা গেল, ইতালীয় মিডিয়া মোগল সিলভিও বেরলুসকোনির সঙ্গেই তাঁর তুলনাটা যথার্থ হয়েছে, যে বেরলুসকোনি তিনবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এই মডেল দেখে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ট্রাম্প ও বেরলুসকোনির মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় ভাসা ভাসা মিল আছে, যেমন ধরুন একাধিক বিয়ে ও সাধারণভাবে অশ্লীল স্টাইল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেটা একই সঙ্গে সবচেয়ে উদ্বেগজনকও বটে, সাদৃশ্য হলো, তিনি নিজের বিক্রেতাসুলভ মনোভাব দিয়ে অন্তঃসারশূন্যতা ঢাকতে চান, প্রচারণা ও সুবিধা পাওয়ার জন্য মুখের ওপর মিথ্যা কথা বলেন, আর সমালোচকদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেন।
বেরলুসকোনি নীতিগত ও মূল আদর্শিক অবস্থানে কখনোই ধারাবাহিক ছিলেন না। নির্বাচনী প্রচারণায় যা বললে ভোট পাওয়া সম্ভব ছিল, তিনি ঠিক তা-ই বলেছেন। যে তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন জোট গঠন করার জন্যও তিনি তা-ই করেছেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা বা সেটার বাড়বাড়ন্ত করা।
এখন পর্যন্ত ট্রাম্পও ঠিক একই কাজ করেছেন, যা বললে আরেকটি ভোট পাওয়া যাবে, তিনি ঠিক তা-ই বলেছেন। এখন কথা হচ্ছে, হোয়াইট হাউসে গেলে তাঁর কী অবস্থা হবে। মার্কিন সংবিধানে যে ভারসাম্য রাখা হয়েছে, তাতে সরকারের একটি শাখার পক্ষে যা খুশি তা-ই করা সম্ভব নয়। কিন্তু গণতন্ত্রে জনমত প্রভাবিত করা খুবই শক্তিশালী অস্ত্র, আর এ কাজে তিনি বেরলুসকোনির মতোই সিদ্ধহস্ত, অন্যদের চেয়ে ভালো।
২০০১-০৬ ও ২০০৮-১১ সালে বেরলুসকোনির (১৯৯৪-৯৫ সালেও তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল গণমাধ্যম ও জনমত নিয়ন্ত্রণ করা। যদিও ইতালির মানুষ এমনিতেই সরকারের ওপর ভরসা করেন না, যাঁরা মনে করেন, সরকারের কাজই হচ্ছে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করা, সেই মানুষের অনুভূতিবোধ বেরলুসকোনি আরও ভোঁতা করে দিয়েছিলেন। তিনি কোনোভাবে ইতালীয়দের মনে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন যে তাঁদের সমাজ ও অর্থনীতি ঠিকঠাক চলছে, এমনকি ২০০৮ সালের মহামন্দার সময়ও তিনি এ কাজ করেছিলেন, যদিও বিষয়টা আদৌ সে রকম ছিল না। তাঁর নেতৃত্বে ইতালির অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, যখন তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা উচিত ছিল।
বেরলুসকোনি কীভাবে এটা করলেন? মূলত, তিনি রসিকতা, মিথ্যা ও হাসি কাজে লাগাতেন। যখন এটা কাজ করত না, তখন তিনি জোর করতেন, যার মধ্যে মানহানির মামলাও আছে। কথা হচ্ছে, খুব কম গণমাধ্যম ব্যবসায়ীই সাংবাদিকসহ অন্য সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার লক্ষ্যে এত মানহানির মামলা করেছেন। জানিয়ে রাখা ভালো, ইতালির প্রধান টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মালিকানা বেরলুসকোনির, একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি পত্রিকাও আছে তাঁর (এগুলো হয় তাঁর সরাসরি মালিকানাধীন, না হলে তাঁর আত্মীয়দের মালিকানাধীন)। প্রখ্যাত ইতালীয় মাফিয়াবিরোধী লেখক রবার্তো স্যাভিয়ানো বেরলুসকোনির ‘কাঁদা যন্ত্রের’ কথা উল্লেখ করেছেন, যেটা দিয়ে তিনি তাঁদের মুখে কালি লেপে দিতেন, যাঁরা তাঁর পথের বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতেন (একটু ঝেড়ে কাশি: দ্য ইকোনমিস্ট-এর সম্পাদক হিসেবে বেরলুসকোনি আমার বিরুদ্ধে দুটি মানহানির মামলা করেছিলেন)।
ট্রাম্পের তূণে এসব অস্ত্রই আছে, তিনি বিরোধীদের ব্যাপারে আক্রমণাত্মক, বিশেষ করে গণমাধ্যমের ব্যাপারে। নিজের ব্যবসায়ী ক্যারিয়ারে তিনি বারবার মানহানির আইনের দ্বারস্থ হয়েছেন। তিনি বলেও দিয়েছেন, নির্বাচনে জিতলে গণমাধ্যমের সমালোচনার কণ্ঠও রুদ্ধ করবেন। তবে তাঁর মূল বার্তায় কিন্তু আশাবাদ আছে, যেটা তিনি দিয়েছিলেন রসিকতার ছলে, প্রশস্ত একটি হাসি দিয়ে। বেরলুসকোনি এটা দেখিয়ে গেছেন, মানুষ যখন রুষ্ট ও মোহমুক্ত হয়ে পড়ে, তখন দীর্ঘ সময়ের জন্য এ কৌশল বেশ কার্যকর।
যে পণ্ডিতেরা ট্রাম্পের সঙ্গে বেরলুসকোনির তুলনা করেছেন, তাঁরা এই দুই ধুমধাড়াক্কা ধনকুবেরের মধ্যে একটি পার্থক্য দেখিয়েছেন: বেরলুসকোনির আকর্ষণ বেশি, তিনি অধিকতর ব্যবসাবান্ধব। এই তুলনা বেরলুসকোনির প্রতি শুধু বেশি উদার নয়, এর মধ্যে একটা ঝুঁকিও আছে, সেটা হলো ট্রাম্প তাঁর ইতালীয় সমকক্ষের মতো অতটা বিপজ্জনক নন।
বাস্তবতা হলো, বেরলুসকোনির আকর্ষণ আছে তা সত্য, তবে ট্রাম্পের সমর্থন বাড়ার ঘটনা থেকে বোঝা যায়, তাঁরও আকর্ষণ আছে, যদিও তা হয়তো অতটা প্রলুব্ধকর নয়। তবে বেরলুসকোনির সঙ্গে ইতালির বিভিন্ন মাফিয়া গোষ্ঠীর যোগাযোগ আছে, তার তো জোরালো প্রমাণ আছেই।
কিন্তু আজ যুক্তরাষ্ট্রে তাৎপর্যের দিক থেকে এর কোনোটিই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হলো, তাঁরা দুজনেই নির্মম, নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে যেকোনো কিছু করতেই তাঁরা প্রস্তুত। এই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পকে খাটো করা হবে বড় ধরনের ভুল। প্রমাণ হবে, আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও তিনি শক্তিশালী, বেশি পিচ্ছিল ও সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। ফলে বেরলুসকোনির শাসনে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, সে রকম কিছু এড়াতে তাঁকে ক্রমাগত সমালোচনা করতে হবে, তাঁর মিথ্যাচার উন্মোচন করতে হবে, আর তাঁর প্রতিটি কাজ ও শব্দের জবাবদিহি চাইতে হবে। সে তিনি আমাদের যতই হুমকি দিন না কেন, অবজ্ঞা করুন না কেন।
বহু ইতালীয়ই বেরলুসকোনির মিথ্যা ও ব্যর্থতাকে পাত্তা দেননি। তাঁরা মনে করতেন, বেরলুসকোনি সামান্য ক্ষতি করে তাড়াতাড়ি বিদায় নেবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই ভুল করতে পারে না। মার্কিনরা একটা কথা বলে, স্বাধীনতার মূল্য চোকাতে হয় চিরন্তন সতর্কতা দিয়ে, অর্থাৎ স্বাধীনতা ধরে রাখতে হলে তাকে সব সময় পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। ট্রাম্পের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে ছাড় দেওয়া চলবে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
বিল এমট: দ্য ইকোনমিস্টের সাবেক সম্পাদক।