হিসাবে না ধরা বাংলাদেশ

জয়ের এই ছবি স্থায়ী হোক, এটাই আমাদের আশাবাদ
জয়ের এই ছবি স্থায়ী হোক, এটাই আমাদের আশাবাদ

ঢাকায় এশিয়া কাপের ফাইনালের আগের দিন প্রথম আলোয় ‘বাংলাদেশকে হিসাবেই ধরেনি আইসিসি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি পড়ার পর আমার একজন অর্থনীতিবিদ বন্ধু যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, আমাকে ফোনে বললেন, দেখলেন তো বিশ্বের মোড়লরা বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব মূল্যায়ন করে তা কতটা বাস্তবতাবিবর্জিত। খুবই যুক্তির কথা। ৯ তারিখে ভারতের ধর্মশালায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের প্রথম খেলা। বাংলাদেশ ছাড়া আইসিসির সহযোগী সদস্যদের সঙ্গে অন্য যে পূর্ণ সদস্যের এই বাছাইপর্বে খেলার কথা সেটি ছিল জিম্বাবুয়ে। সোজা কথায় বাংলাদেশ এখনো আইসিসির কাছে একটি মিনো বা ছোট দল। যে এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা আছে, তার ফাইনালে বাংলাদেশের মতো ছোট দলের খেলার সম্ভাবনা আইসিসির কর্তাব্যক্তিদের মাথাতেই আসেনি। ফলে শিিডউল–জটে ৫ মার্চ ধর্মশালায় হংকংয়ের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচটাও আর বাংলাদেশের খেলা হলো না। এশিয়া কাপে তার সাফল্যের খেসারত হচ্ছে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে অন্যরা সবাই প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও বাংলাদেশ সেই সুযোগ পেল না। অথচ প্রস্তুতি ছাড়াই বাংলাদেশ সুপার টেনে উঠে আইসিসির অবহেলার জবাব দিয়ে দিয়েছে।
আইসিসির কাছে এই সূচিবিভ্রাট ও অবহেলার জন্য বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের কোনো ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ আছে কি না জানি না। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের হেলাফেলা বন্ধ করার দাবিটা আমাদের জানানো উচিত। আমাদের ক্রিকেটে যে গুণগত উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে সেটি আইসিসির কর্তারা একেবারেই জানবেন না, সেটা কীভাবে সম্ভব—এ প্রশ্ন অনেকেরই। অবশ্য শুধু আইসিসিকেই বা দুষব কেন? ওই একই দিনে বিবিসির খেলার খবরের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ফাইনালে একটা আপসেটের অপেক্ষায় এখন বাংলাদেশ’। অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশিদের কাছে ভারতকে হারানো আপসেট হিসেবে বিবেচিত হবে কেন। আমি তার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। নাকি বিবিসির কার্যক্রমেও অন্য কিছুর প্রভাব এটি?
আইসিসির কোনো সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে আমাদের অনেকেই ভারতের প্রতি সন্দেহের আঙুল তোলেন। এই যেমন তাসকিন আহমেদ ও আরাফাত সানির বোলিং নিয়ে আইসিসির আম্পায়ারদের সন্দেহ জানানোকে অনেকেই পক্ষপাতমূলক বলতে চান। ভারতের বুমারাহ ও অশ্বিনের সঙ্গে তুলনাও এসেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। আমি অবশ্য সেদিকে যাব না। আমি বরং সবার নজর টানতে চাই বহুজাতিক ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কথিত আঞ্চলিক কৌশল বা রিজিওনাল স্ট্র্যাটেজির দিকে। এসব আঞ্চলিক নীতিকৌশলে দক্ষিণ এশিয়ায় সব সময়ই ভারতের গুরুত্ব আলাদা। বৃহত্তম বাজার, ভৌগোলিক বিশালত্ব ও উদীয়মান বিশ্বশক্তি হিসেবে ভারত অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে আছে। পশ্চিমা দেশের ভিসা অফিস কিংবা বহুজাতিক কোম্পানির আঞ্চলিক দপ্তরগুলোর অধিকাংশই এখন তাই দিল্লিতে।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মেয়ে সওগাত নাজবিন খান তাই কমনওয়েলথ যুব পুরস্কার পেয়ে লন্ডনে আমন্ত্রিত হলেও ব্রিটিশ ইমিগ্রেশনের দিল্লির ভিসা অফিসার তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণে টাকা আছে কি না অথবা কোন মহৎ কাজের জন্য তিনি পুরস্কৃত হলেন—সেসব প্রশ্নের জবাব ওই ভিসা অফিসারের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। অথচ ভিসা অফিসারটির বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থাকলে তাঁর জানা থাকত যে এই দেশে নাজবিনের বয়সী মেয়েদের অধিকাংশেরই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই বা থাকার কথা নয়, জমা থাকা টাকা যথেষ্ট কি না, সেই প্রশ্ন তো পরের কথা। নাজবিন যে কাজের জন্য পুরস্কার পেলেন, সেই কাজটা সম্পর্কেও তাঁর স্বাধীনভাবে তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকত। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার ১৪ মার্চ কমনওয়েলথ দিবসের এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন যে তাঁর হাইকমিশনের উদ্যোগে নাজবিনের ভিসার ব্যবস্থা হচ্ছে, যাতে করে তিনি ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। নাজবিনের পুরস্কার পেয়েও ভিসা না পাওয়ার খবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকার হাইকমিশনারের হস্তক্ষেপই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের ভিসার কাজটি ঢাকাতে হওয়াই যৌক্তিক।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে অবস্থা তো আরও গুরুতর। এরা বাংলাদেশের সংস্কৃতি, রুচিবোধ, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছিটেফোঁটাও জানার চেষ্টা করে না। তাদের পণ্য বিপণন কৌশলের কেন্দ্রে তাই বলিউড ও ভারতীয় নির্মাতাদের দাপট। শুধু হিন্দি সংলাপের বাংলা ভয়েস-ওভার ব্যবহার করে তারা তাদের বিজ্ঞাপনচিত্রগুলোর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান কিংবা অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনের মুখ নাড়ানোর সঙ্গে ভিন্ন কণ্ঠস্বরে বাংলা উচ্চারণের বিরক্তিকর অসংগতির যন্ত্রণা আমাদের মতো দর্শকদের দিনের পর দিন সহ্য করতে হচ্ছে। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এসব বিজ্ঞাপন পেয়েই ধন্য—এগুলো কোথায় তৈরি, সেই প্রশ্ন তারা তুলবে না এই ভয়ে যে শেষ পর্যন্ত না বিজ্ঞাপনটা তার চ্যানেল থেকে অন্য কোথাও চলে যায়। আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক-নির্মাতারাও এ ব্যাপারে নির্বিকার। তাতে দেশে সৃজনশীল শিল্পের ভবিষ্যৎ শিকেয় উঠলেও তাঁদের কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না।
অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলো, তা সে গবেষণা প্রতিষ্ঠান হোক, এনজিও অথবা সংবাদ সংস্থাও চলছে একই ধারায়। ফলে দেখা যায় তারা বার্ষিক কার্যসূচি তৈরির সময় দুসেরা কিংবা দিওয়ালির দিনটিকে ছুটির দিন হিসাব করছে, কিন্তু বাংলা নববর্ষ কিংবা শহীদ দিবসকে কাজের দিন হিসাবে তালিকায় রাখছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই খরচ কমানোর কথা বলে দক্ষিণ এশিয়ার কার্যক্রম লন্ডন বা নিউইয়র্ক থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করে। আর দিল্লিতে আঞ্চলিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ফলে সংস্থাগুলোর কার্যক্রম অনেকটাই সেখানকার স্থানীয় বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাতে অপেক্ষাকৃত ছোট বাজার বা জনগোষ্ঠীর নানা ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো উপেক্ষিত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
এ ধরনের বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য অবশ্য সুবিধা হচ্ছে আমাদের জনগোষ্ঠীর আকার কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে আমরা একটু পিছিয়ে থাকলেও পরিস্থিতি এখন বদলাচ্ছে। নানা ধরনের বিলাসসামগ্রী ও ভোগ্যপণ্য আমাদের দেশে এখন যে সংখ্যায় বা পরিমাণে বিক্রি হয়, তা ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে বেশি। আবার আমাদের ১৬ কোটি মানুষের ভাষাও এক (নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাদে)। যে কারণে প্রযুক্তি শিল্প ও বাণিজ্যে বাংলার স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিতে হয়েছে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি বাংলা কি–বোর্ডযুক্ত মোবাইল ফোন বানাচ্ছে, গুগল বা ফেসবুকও বাংলায় সেবা দিচ্ছে। অনেকের নিশ্চয়ই মনে থাকবে প্রথম প্রথম ইন্টারনেটে বাংলা ব্যবহারের সময় আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। কেননা, আমাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাংলার যে ফারাক, তার একটা প্রভাব ছিল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সেবাব্যবস্থায়। সেই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের বাংলা শক্ত ভিত গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশকে হিসাবে না ধরার জবাব যে দেওয়া সম্ভব তা একটি প্রমাণিত সত্য। তাহলে আমরা কেন অন্যদের এই বার্তাটি দিতে পারব না? আমাদের গণমাধ্যম ও সৃজনশীল শিল্পের সবাই কি একটু ঘুরে দাঁড়াবেন?
শেষ করব অবহেলার জবাবে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার এক সাম্প্রতিক সামাজিক আন্দোলনের খবর দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় ফরসা ত্বকের একটা আলাদা কদর আছে। আর সে কারণেই শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদের জন্যও এখানে ফরসা হওয়ার প্রসাধনসামগ্রী বিক্রি হয় এবং তার বিজ্ঞাপনে ‘ফেয়ার’ কথাটি খুব জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী দুই বোন মিরুশা ইয়োগারাজা ও ইয়ানুশা ইয়োগারাজা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি প্রচারাভিযান শুরু করেছেন, যার নাম দিয়েছেন আনফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। হ্যাশট্যাগ আনফেয়ার অ্যান্ড লাভলি এখন একটি বৈশ্বিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে এবং এক হাজারেরও বেশি শ্যামলা বা কালো মেয়ে তাঁদের সৌন্দর্যের প্রমাণ হিসেবে নানা ধরনের ছবি ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমে তাঁরা শিরোনামে উঠে এসেছেন (#আনফেয়ারঅ্যান্ডলাভলি: এ নিউ সোশ্যাল ক্যাম্পেইন সেলিব্রেটস ডার্ক স্কিন, বিবিসি, ১২ মার্চ)।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।