আতঙ্কের পরিবেশ ও নাগরিক নিরাপত্তা

.
.

তাঁর এই অকাল ও অপঘাতে মৃত্যুর বেদনা কেবল তাঁর পরিবারের নয়, তাঁর প্রিয়জনদের নয়, তাঁর সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদেরই নয়, যাঁরা তাঁর সঙ্গে বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন তাঁদেরও। আমি এ-ও মনে করি, একজন সফল জ্ঞানী শিক্ষকের মৃত্যুর ক্ষতি যারা ভবিষ্যতে তাঁর শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো তাদেরও। অধ্যাপক সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব এসব কারণের পাশাপাশি আরও একটি কারণে; হাসান আজিজুল হক আমাদের সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘প্রত্যেক মানুষ তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে’ (প্রথম আলো, ২৪ এপ্রিল ২০১৬)। অধ্যাপক সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ড সে কারণেই আমাদের সবার জন্য উদ্বেগের বিষয়।

সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়া এবং সমাজে আতঙ্কের বিস্তার যে স্বাভাবিক ঘটনা নয় তা আমরা জানি। যেকোনো সমাজে, যেকোনো সময়ে আতঙ্ক হচ্ছে তৈরি করা বিষয়। যদি কোনো সমাজে আতঙ্ক সর্বব্যাপ্ত রূপ নেয়, তাহলে বুঝতে হবে সেই সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন আমার গ্রন্থ, ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি, ঢাকা: প্রথমা, ২০১৪)। আতঙ্ক যারা তৈরি করে, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে ভীত করা, নিঃসঙ্গ করা, প্রতিরোধের শক্তিকে দুর্বল করা। একইভাবে, এই আতঙ্ক থেকে যারা রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করতে তৎপর থাকে, তারাও এই আতঙ্ককে নির্মূলে অংশত হলেও অনীহ থাকে। বিরাজমান আতঙ্কের স্রষ্টারাই কি কেবল ভয়ের সংস্কৃতি থেকে সুবিধা লাভ করে? ইতিহাস বলে যে কথিত প্রতিপক্ষের আতঙ্কের নামে রাজনৈতিক স্বার্থ লাভের চেষ্টা মোটেই বিরল নয়।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যেমন আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইন অগ্রাহ্য করেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নাগরিকের অধিকারগুলোও সংকুচিত করা হয়েছে। ইউরোপে, বিশেষত যুক্তরাজ্যে, গত দেড় দশকে প্রণীত বিভিন্ন আইন অভিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের পথ উন্মুক্ত করেছে। অভিযোগ আছে যে এগুলো এ ধরনের আচরণকে বৈধতা দিয়েছে (বিস্তারিত আলোচনা দেখুন আমার গ্রন্থে, ইসলাম অ্যান্ড আইডেনটিটি পলিটিকস এমাঙ্গ ব্রিটিশ বাংলাদেশিস: এ লিপ অব ফেইথ’, ম্যানচেস্টার; ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৩)। বিভিন্ন দেশের, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর স্বৈরাচারী শাসকেরা তাঁদের ক্ষমতাকে সুসংহত করার পক্ষে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’কে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা এই সুযোগে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছেন এবং তা অধিকাংশ ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন-পীড়নে। ফলে যেকোনো ধরনের আতঙ্কের বিস্তারকে বিবেচনায় নিলে, সেই আতঙ্কের উৎস, তার প্রণেতা এবং তা থেকে সুবিধা লাভকারী সব দিকই মনে রাখতে হবে।

অধ্যাপক সিদ্দিকীকে হত্যার পর এর দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। গত কিছুদিন যাবৎ বাংলাদেশে নতুন করে জঙ্গি তৎপরতার প্রেক্ষাপটে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মতৎপরতা, পদ্ধতি ও কৌশল বিশেষভাবে বিশ্লেষণ দাবি করে। ২০১৩ সাল থেকে আল-কায়েদার স্বঘোষিত বাংলাদেশ শাখা আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, এখন যা আনসার উল ইসলাম বলে পরিচিত, ব্লগারদের হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করে আসছে। ২০১৫ সাল থেকে ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে তারা জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি তৈরি করেছে এবং তারা বিদেশি হত্যা ও শিয়া জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার দায় স্বীকার করেছে। ইসলামিক স্টেটের মুখপত্র দাবিক-এ সম্প্রতি বাংলাদেশে তাদের প্রধানের একটি সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে অতীতে যা-ই বলা হোক না কেন, এখন সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে দেশে এ দুই সংগঠনের কোনো উপস্থিতি নেই। গত তিন বছরে এ দুই সংগঠনের নামে পরিচালিত কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে লক্ষ্যের বিবেচনায় তাদের অভিন্নতা সত্ত্বেও কৌশল ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে তাদের ভিন্নতা রয়েছে। আমরা এ-ও জানি যে পৃথিবীর অন্যত্র এ দুই সংগঠনের মধ্যে রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সাধারণত প্রতিটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের কর্মপদ্ধতি, আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, আক্রমণের পদ্ধতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা এগুলোকেই সংশ্লিষ্ট সংগঠনের ‘সিগনেচার’ বা ‘হলমার্ক’ বলে বর্ণনা করে থাকেন।

আনসার উল ইসলামের কার্যক্রম থেকে প্রতীয়মান যে তারা তাদের ভাষায় ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের লক্ষ্যবস্তু বলে চিহ্নিত করেছে এবং এযাবৎ ব্লগারদের কুপিয়ে হত্যার পদ্ধতি অনুসরণ করে এসেছে। অন্য পক্ষে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা কথিত ব্লগারদের বিষয়ে কখনোই কোনো বক্তব্য প্রকাশ করেনি। সম্প্রতি দাবিক-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে আইএসের কথিত বাংলাদেশ শাখার প্রধান শায়েখ আবু ইবরাহিম আল-হানিফ শত্রু হিসেবে বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কথা বলেছেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে দাবিক-এ প্রকাশিত এক লেখায় জামায়াতে ইসলামীকে ‘ধর্মত্যাগী’ বলেই বর্ণনা করেছিল। এই সাক্ষাৎকারে আল-হানিফ বড় আকারে চিহ্নিত করেছেন ধর্মীয় প্রথাবিরোধী সম্প্রদায় ও মুরতাদ দলগুলোকে। সুনির্দিষ্টভাবে শিয়া, আহমদিয়া, ধর্মত্যাগী, সুফি ও পীরদেরই শত্রু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তা ছাড়া খ্রিষ্টান মিশনারি ও এনজিওগুলোর বিষয়ে তাদের বিরূপ মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামিক স্টেট এযাবৎ যেসব হামলার কথা স্বীকার করেছে, তার সঙ্গে তাদের এই বক্তব্য সংগতিপূর্ণ।

অধ্যাপক সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ড সুস্পষ্টভাবেই অতীতে আনসার আল ইসলামের ব্যবহৃত কৌশলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, কিন্তু অতীতে আনসার আল ইসলামের নির্মমতার শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের একধরনের অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগে উপস্থিতি রয়েছে। অধ্যাপক সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে তার কোনো প্রমাণ আমরা দেখতে পাই না, তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর সহকর্মীরা এমন কিছু উল্লেখ করেছেন বলে গণমাধ্যমে আসেনি।

অন্য পক্ষে ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে হত্যার দাবি সত্ত্বেও কৌশল ও লক্ষ্যবস্তুর বিবেচনায় একে ভিন্ন বলেই মনে হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন ওঠে, অধ্যাপক সিদ্দিকীর এই হত্যাকাণ্ড কি আইএসের কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তনের সূচক? এটি কি কৌশল ও লক্ষ্যবস্তুর দিক থেকে এ দুই জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে ওঠার লক্ষণ? বিপরীতক্রমে এখন কি অন্য কোনো গোষ্ঠী আনসার আল ইসলামের কৌশলে হত্যাকাণ্ডের সূচনা করছে? কৌশলের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য সত্ত্বেও একে অতীতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড থেকে আলাদা করে বিবেচনা করাই কি শ্রেয়? পুলিশের বক্তব্য যে এই হামলার সঙ্গে ‘ধর্মীয় উগ্রপন্থী’দের যোগাযোগ আছে, সেটা কি প্রশ্নসাপেক্ষ? আশা করি তদন্তকারী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গণমাধ্যম এসব প্রশ্ন বিবেচনা করে দেখবেন।

অধ্যাপক সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের পর আমরা বিভিন্নভাবে তাঁর সম্পর্কে জানতে পারি। কিন্তু এসব পরিচিতির মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর কাজের যে দিকগুলো তুলে ধরা হয়, তা আমাদের সবার মনোযোগ দাবি করে। সংস্কৃতিমনা, লেখক ও সংগীত অনুরাগী অধ্যাপক সিদ্দিকীকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এমন ধারণা দেওয়ার প্রচেষ্টা খুব সহজেই চোখে পড়েছে যে তাঁকে এসব ‘কারণে’ ‘ধর্মীয় উগ্রপন্থী’রা হত্যা করেছে, কথিত ইসলামিক স্টেটের বিবৃতিতেও তাঁকে ‘নাস্তিক’ বলে বর্ণনার প্রয়াস দুর্নিরীক্ষ্য নয়। কিন্তু তাঁর পরিবার, সহকর্মী ও নিজ গ্রামের মানুষেরা জানান যে তিনি ছিলেন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবান মানুষ, ‘দরগামাড়িয়ার বহু বছরের ইসলামি তাফসির কোরআন মাহফিলের সহসভাপতি ছিলেন, আবার কোনো বছর পৃষ্ঠপোষকের দায়িত্ব পালন করেন। এমনকি দানও করেছেন’ (প্রথম আলো, ২৫ এপ্রিল ২০১৬; বিবিসি বাংলা ২৪ এপ্রিল ২০১৬) ; তিনি স্থানীয় মসজিদ সংস্কার ও মাদ্রাসা তৈরিতে অবদান রেখেছেন (ডেইলি স্টার, ২৩ ও ২৫ এপ্রিল ২০১৬)।

গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে চটজলদি উপসংহারে উপনীত হওয়ার এই প্রবণতা, পূর্বধারণার ছাঁচে ফেলে যেকোনো ঘটনাকে বিচার করা সমাজে বিরাজমান যে পরিস্থিতির সাক্ষ্য দেয় তা সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। অধ্যাপক সিদ্দিকীকে যারা হত্যা করেছে, তাদের লক্ষ্য যদি হয়ে থাকে ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে নিরাপদে বেঁচে থাকার শর্তে পরিণত করা, তবে এই হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমরা কে কী বলেছি, সেটাও তাদের সেই লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করছে কি না, সেটা ভাবা দরকার।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সমাজকে আস্তিক-নাস্তিকে বিভক্ত করে ফেলার যে প্রবণতা দৃশ্যমান, তা সমাজে কেবল অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়েছে তা-ই নয়, একই সঙ্গে মানুষের অধিকারকেও সংকুচিত করেছে। এই বিভক্তির রাজনীতি থেকে যাঁরা সুবিধা নিচ্ছেন, তাঁরা ভেবে দেখতে অনাগ্রহী ভবিষ্যতে দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কিন্তু তাঁদের আগ্রহ-অনাগ্রহ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করবে না, সেটা নিশ্চিত। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও বিশ্বাসহীনতা কোনোটিই নাগরিকের বেঁচে থাকার, ন্যায়বিচার পাওয়ার শর্ত হতে পারে না।অধ্যাপক সিদ্দিকীর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার উপায় সবার ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যবস্থার জন্য সরব ও সক্রিয় হওয়া। অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক সমাজে বিরাজমান আতঙ্কের কথা বলেছেন; সেই আতঙ্কের পরিবেশ, সেই ভয়ের সংস্কৃতিকে পরাস্ত না করে নাগরিকদের কেউই নিরাপদ হবেন—এমন আশা করার কারণ দেখি না।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।