শোকার্ত পিতার কান্না কি রাষ্ট্র শুনতে পায়?

অজয় রায় ও আবুল কাসেম ফজলুল হক
অজয় রায় ও আবুল কাসেম ফজলুল হক

গতকাল প্রথম আলোয় অধ্যাপক অজয় রায় ও অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকার দুটি পড়ে চোখে পানি এল। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে অভিজিৎ-দীপনেরা বাঁচতে পারেন না। রাষ্ট্র তাঁদের রক্ষা করতে পারে না। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার বহনকারী বাংলাদেশে কেন এমনটি ঘটল?
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শেখ সাবিহা আলমের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে আমরা যে ছবিটি পাই, তা হলো দুজন শোকার্ত পিতার। শিক্ষাবিদের নয়। তাঁদের প্রতিটি শব্দ ও উচ্চারণে সন্তানের প্রতি কী গভীর ভালোবাসা ও স্নেহ প্রকাশ পেয়েছে! প্রত্যেক পিতাই হয়তো চান সন্তান তাঁর অসমাপ্ত কাজ ও স্বপ্নকে এগিয়ে নেবে। মৃত্যুর পরও তিনি সন্তানের মাঝে নিজেকে দেখতে চান। আমরা কাছ থেকে এই দুই শিক্ষাব্রতীকে যতটুকু জানি, তাঁরা কখনোই ব্যক্তিগত সুবিধার কথা ভাবেননি। সন্তানদেরও সেভাবে গড়ে তোলেননি।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক জীবনভর জনগণের মুক্তির কথা বলেছেন। একসময় বামপন্থী রাজনীতি করতেন। এখন বাম-ডানের চেয়ে মানবতার কথাই বেশি বলেন। শুভবুদ্ধির চর্চা করেন। সত্যিকার অর্থে মানুষকে আলোকিত করার চেষ্টা করেন। তাঁর প্রথম বইয়ের নাম কালের যাত্রার ধ্বনি। সেই ধ্বনি ছিল মুক্তি ও মঙ্গলের, সত্য ও ন্যায়ের। কিন্তু আজ বাংলাদেশে নিয়ত অমঙ্গলের বার্তা শুনতে পাচ্ছি। একের পর এক পিতার কোল ও মায়ের বুক খালি হতে দেখছি। কোথাও ক্রন্দন নেই। প্রতিবাদে কাউকে জ্বলে উঠতে দেখি না। সবই যেন আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে!
যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে অজয় রায়কে দেখেছি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর প্রচণ্ড আঘাত এল, তিনি উপদ্রুত এলাকায় ছুটে গিয়েছেন। আক্রান্ত মানুষের হয়ে মামলা লড়েছেন। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করিয়েছেন। সহিংস সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবে উন্মুল-উদ্বাস্তু বহু মানুষকে ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। ভোলায় তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে দেখেছি, তিনি কীভাবে বিপন্ন ও অসহায় মানুষগুলোর সহায় হয়েছেন। এখনো তিনি তাদের খোঁজখবর রাখেন। সাধ্যমতো সাহায্য করেন।
এই দুজন মহান মানুষকে বাকি জীবন সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে, এর চেয়ে কষ্ট ও বেদনার কী হতে পারে! পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের চেয়েও ভারী তাঁর স্মৃতি। নিহত সন্তানের বাবা-মাকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াবে।
সভা-অনুষ্ঠানে যখনই এই দুই শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হয়, নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। লজ্জায় তাঁদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। তাঁরা যে সন্তানদ্বয়কে হারিয়েছেন; তাঁদেরও স্ত্রী-সন্তান আছে। সেই সন্তান যদি জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের বাবা কই?’ সেই স্ত্রী যদি জানতে চান, ‘আমার স্বামীকে কেন হত্যা করা হলো?’
কী জবাব দেব আমরা? কী জবাব দেবে সরকার? কী জবাব দেবে সমাজ? সরকারের উচ্চাসনে বসা ব্যক্তিরা অপরাধীদের ধরা হবে, খুন করে কেউ পার পাবে না বলে প্রায়ই বুলন্দ আওয়াজ তোলেন, কিন্তু বাস্তবে খুব কম অপরাধীই ধরা পড়ে। কোনো অঘটনের পর কিছুদিন হইচই হয়, তদন্তের নামে নানা তৎপরতা চলে। তারপর নতুন কোনো হত্যার ঘটনা পুরোনো হত্যার স্মৃতিকে আড়াল করে দেয়।
কয়েক দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই যে একের পর এক খুন হচ্ছে, খুনিরা ধরা পড়ছে না কেন? তিনি বললেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। এ কারণে আমরা ১০০ শতাংশ না পারলেও ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ঘটনা বের করে ফেলেছি। এটাই কি নব্বই ভাগ রহস্য উদ্ঘাটনের নমুনা!
তবে তিনি স্বীকার করেছেন, অপরাধীরা যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, সেই তুলনায় পুলিশের প্রশিক্ষণের ও প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে, দক্ষতার অভাব রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী পুলিশ অনেক তৎপর হলেও আমরা তার ফল দেখি না। মাসের পর মাস তদন্ত ঝুলে আছে।
এ কারণেই অভিজিৎ হত্যার ১৪ মাস পর অধ্যাপক অজয় রায় সংক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের সরকার, গোয়েন্দা বাহিনী একটা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে আছে। ওদের খুনি ধরার ইচ্ছে নেই, সক্ষমতাও নেই। প্রতিটি খুনের পর ওরা যেভাবে কথা বলছে, তাতে করে খুনিরা আশকারা পাচ্ছে। এত দিন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বলে আসছিল, সাত-আটজন সন্দেহভাজনকে তারা রিমান্ডে নিয়েছে। ওরা বোধ হয় কিছু স্বীকার করেনি। পরে শুনলাম, প্রকৃত হত্যাকারী তিনজন। ডিবির ওই যে ছেলেটা, কী যেন নাম ওর, বলল, মূল খুনি তিনজন। আমরা নজরদারিতে রেখেছি।” আমি জানতে চাইলাম, নজরদারির অর্থ কি গ্রেপ্তার? ভাবলাম, তদন্তের স্বার্থে কিছু বলছে না। আমি আমার আশঙ্কার কথা বললাম, ওরা পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। ঠিকই তা-ই হলো। আজ এত দিন পর বলছে, ওরা পালিয়ে গেছে। তাহলে তোমরা এত দিন কী করেছ?’ (প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬)
তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, অল্প কজন মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না কেন? জঙ্গিবাদীরা যাঁদের টার্গেট করেছে বা হুমকি দিয়েছে, তাঁদের সংখ্যা পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আঠারো শ। এই আঠারো শ ব্যক্তিকে কেন রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে পারবে না? অন্তত তাঁদের মধ্য থেকে প্রথম ৫০ জনকে দিক। রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকদের নিরাপত্তা না দেয় কে দেবে?
সাক্ষাৎকার শেষে অজয় রায় সাবিহার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘এরপর কোথায় যাবে।’ সাবিহা যখন বললেন, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের বাসায় যাবেন, তখন তিনি মন্তব্য করলেন, ‘ওহ্। আরেক বিপর্যস্ত মানুষের কাছে? ঠিক আছে তাহলে। ভালো থেকো তোমরা সবাই।’
কী করুণ ও অসহায় উক্তি। আরেক বিপর্যস্ত মানুষ! প্রতিদিন এ রকম বিপর্যস্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অথচ আমাদের বিবেক ঘুমিয়ে আছে। অাঘাতটা নিজের ওপর না আসা পর্যন্ত সজাগ হচ্ছি না। কিন্তু দেশে সুনামি বা মহামারি এলে কাউকেই ছাড়ে না। যখন আমরা সজাগ হব, তখন হয়তো কিছুই করার থাকবে না।
আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রথম থেকেই বলে আসছেন, এগুলোকে সাধারণ অপরাধমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়। এর পেছনে আদর্শগত, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক কারণ আছে। হঠাৎ করে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। সব দিকেই অনুসন্ধান করা দরকার। তাঁর মতে, এর পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মদদ আছে। এই হত্যাকাণ্ডগুলো বৃহৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে।
কিন্তু যারা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন, তাঁরা গৎ বাঁধা কথা বলে যাচ্ছেন, জঙ্গি–সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক, ছাড় দেওয়া হবে না। জঙ্গি–সংকটের যে বৈশ্বিক দিকটি আছে, সেটি সরকার আমলেই নিতে চাইছে না। মন্ত্রীরা মুখস্থ বলে যাচ্ছেন, দেশে আইএস নেই। আইএস না থাকলে কারা এমন ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হচ্ছে, সে কথাও তো সরকারকে বলতে হবে। অপরাধীদের ধরতে হবে। কোনো তথ্য–প্রমাণ ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপালে প্রকৃত অপরাধীরাই পার পেয়ে যায়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট যে কথাটি স্পষ্ট করে বলেছেন। আমরা চাই না আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো দেশ নাক গলাক। কিন্তু সেই সুযোগটি তো সরকারই করে দিচ্ছে।

>এই দুজন মহান মানুষকে বাকি জীবন সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে, এর চেয়ে কষ্ট ও বেদনার কী হতে পারে! পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের চেয়েও ভারী তাঁর স্মৃতি। নিহত সন্তানের বাবা-মাকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াবে

বাইরে পরিকল্পনা সম্পর্কে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে রুশদের বিরুদ্ধে তালেবানদের উত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আল-কায়েদা, আইএস ইত্যাদি জঙ্গি সংগঠন তৈরি হয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এখন এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু দেশে ইসলামের নামে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল থাকার চুক্তিতে আবদ্ধ। এর ফলে তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস জঙ্গিরা বাংলাদেশ ও ভারতকে তাদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই বাস্তবতার মধ্যে পরিপূর্ণ সততার সঙ্গে আমাদের সমাধানের পথ ভাবতে হবে।’ (প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬)
বিচার প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হলো, ‘আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য বিচার করা দরকার, সেটা সরকারের কর্তব্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি হিংসা-প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি না। বিচারে কারও কারও ফাঁসি হলে, কারাদণ্ড হলে আমি কি দীপনকে ফিরে পাব? দীপনের কি তাতে কোনো উপকার হবে? যে রাজনীতির কারণে দীপন-অভিজিৎসহ আরও কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে, আমি সেই রাজনীতির অবসান চাই। এক হাতে তালি বাজে না। আমি চাই সকল মহলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’
তাঁর এই বিশ্লেষণের সঙ্গে অনেকে একমত হতে না–ও পারেন। কিন্তু ভেবে দেখেছেন, একজন মানুষ কতটা উদার ও মহৎ হলে বলতে পারেন, বিচারে কারও ফাঁসি হলে কিংবা কারাদণ্ড হলে আমি কী দীপনকে ফিরে পাব? সন্তান হত্যার বিচারের চেয়ে তিনি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন মানুষের শুভবুদ্ধির। সুস্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার, যেখানে হিংসা ও হানাহানি থাকবে না। সমাজে শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি বলেই তুচ্ছ ঘটনায় বা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে একে অপরের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার কথা সংবিধানের পাতায় লেখা থাকলেও রাজনীতিকদের কথা, চিন্তা ও আচরণে নেই।
এ কারণেই শোকার্ত দুই পিতা সমাজের সর্বস্তরে শুভবোধ জাগ্রত হওয়ার কথা বলেছেন। মানুষের নৈতিক শক্তির উদ্বোধনের ওপর জোর দিয়েছেন। গভীর হতাশার মাঝেও তাঁরা দেখতে চেয়েছেন যে, ভবিষ্যতে আর কোনো পিতার সন্তান যেন এভাবে হত্যার শিকার না হয়।
রাষ্ট্রের কানে তাঁদের এই আকুতি ও কান্না পৌঁছাবে কি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]