হাসানকে যেমন দেখেছি

হাসানউজ্জামান খান
হাসানউজ্জামান খান

আজ ১৮ মে। ঠিক এক বছর আগে এই দিনটিতেই হাসান পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকেই আমি একা। এই একাকী জীবন বয়ে যাওয়া যে কী কষ্টকর, তা শুধু আমার মতো স্বামীহারা নারীরাই উপলব্ধি করতে পারবেন। দীর্ঘ ৫৭টি বছর একসঙ্গে কাটানোর পর ও চলে গেল আমাকে একা ফেলে। এখন সবকিছুই শূন্য মনে হয়। হাসান আমরণ মানুষের মঙ্গলের জন্য, দেশের ও দশের স্বার্থের জন্য সংগ্রাম করে গেছে। কী পেয়েছে, কী পায়নি, এই চিন্তা তাকে কোনো দিন করতে দেখিনি। ওর সুদীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে যাঁরা তার সংস্পর্শে এসেছিলেন, সহযোগিতা পেয়েছেন, তার কাছে কাজ শিখেছেন—তাঁরা সবাই হাসানের এই নিঃস্বার্থ চরিত্রের কথা একবাক্যে স্বীকার করবেন। সতীর্থদের কাছে হাসান একজন ভালো সাংবাদিক তো বটেই, সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিল। নানামুখী প্রতিভার অধিকারী হাসান একেবারেই প্রচারবিমুখ ছিল। হেন বিষয় নেই, যা সম্পর্কে তার জানা ছিল না, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় তার ছিল প্রচণ্ড দখল। বন্ধুরা ওকে ‘চলন্ত ডিকশনারি’ বলে অভিহিত করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্য অনেক দেশের মতো এ দেশেও তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। জীবিকার তাগিদে একপর্যায়ে কলকাতায় চাকরির সন্ধানে চলে যায় হাসান। সেখানে বিভিন্ন রকম কাজে তার হাতেখড়ি হয়। প্রথমেই এক রেশনিং অফিসে কাজ নেয় সে। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর এক বন্ধুর সহায়তায় একটি পত্রিকায় সে কাজ পায়। সেই থেকে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে সে। পার্টির নেতারা কাজের প্রতি হাসানের একনিষ্ঠতা আর একাগ্রতা দেখে ওকে পার্টির সদস্য করে নেন। তখন কমরেড মোজাফফর আহমদের অধীনে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। কমরেড মণি সিংহও কলকাতায় তখন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন।
১৯৫০ সালে পার্টির গোপন নথি নিয়ে এ দেশে আসার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে হাসান। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে ছিল। সে সময় জেলে তার সঙ্গে মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, সৈয়দ আলী আকসাদসহ অনেক বিখ্যাত লোকের পরিচয় হয়, তাঁদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রের নীতিবোধ ও আদর্শকে আপামর জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্য। সহধর্মিণী হিসেবে আমিও হাসানের কাছ থেকে এ ব্যাপারে বেশ দীক্ষা পেয়েছি, জেনেছি রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়ে কার্ল মার্ক্স, লেনিন, মাও সে–তুংসহ কমিউনিস্ট-গুরুদের ভাবনাচিন্তার কথা। তাঁদের লেখা বিভিন্ন বই থেকে চুম্বক অংশগুলো হাসান আমাকে পড়ে শুনিয়েছে, সেসবের ব্যাখ্যা দিয়েছে, আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শুনে গেছি।
১৯৫৫ সালে জেল থেকে ছাড়া পায় হাসান। ঢাকায় তখন তার একমাত্র নিকটাত্মীয় বলতে ছিলেন মামা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক (পরবর্তী সময়ে জাতীয় অধ্যাপক)। উনি হাসানকে তাঁর শান্তিনগরের বাসায় নিয়ে রাখেন। এরপর হাসান আবার সাংবাদিকতা শুরু করে। প্রথমে মিল্লাত, তারপর ইত্তেফাক, অবজারভার, আজাদ, মর্নিং নিউজ পত্রিকায় কাজ করে সে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মর্নিং নিউজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগ দেয় সে। ১৯৯০-এর দশকে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিল হাসান। মাঝে ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে ফয়েজ ভাই (‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’খ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহ্মদ) তাকে বঙ্গবার্তা পত্রিকায় নিয়ে যান। তবে বছর খানেক পর দুজনেই আবার বাসসে চলে আসেন। ফয়েজ ভাই তখন বাসসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন।
অবসর নেওয়ার পরও সাংবাদিকতা ছাড়তে পারেনি হাসান। বলা চলে, তাকে ছাড়তে দেওয়া হয়নি। ওর মতো দক্ষ, নিবেদিতপ্রাণ, বিশেষ করে ইংরেজি জানা সাংবাদিককে নিতে বিভিন্ন ইংরেজি পত্রিকা আগ্রহী হয়ে ওঠে। নিউ নেশন, বাংলাদেশ টুডেতে কয়েক বছর কাজ করার পর বাসসে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পায় হাসান। সেখানে বছর দু-এক কাজ করার পর ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এ চলে যায় এবং চাকরিজীবনের শেষ অবধি ওই পত্রিকাতেই ছিল সে। পরে অসুস্থতার কারণে পরিবারের চাপের মুখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় হাসান।
হাসানের শেষ জীবন কেটেছে তার মিরপুরের বাসায়। সেখানে আসার মাস তিনেক পরই মৃত্যু হয় তার। এই তিন মাসে তার বাক্শক্তি অনেকটাই লোপ পায়, যদিও মস্তিষ্ক ছিল তার সম্পূর্ণ সচল, সবই সে বুঝত। অনেক সময় আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বোঝাত তার মনের কথা। মেয়ে মনিদীপাকে একদিন ফোন করে খুব কষ্ট করে বলল, ‘মা, তোর জন্য আর অপেক্ষা করতে পারলাম না, আমি শিগগিরই চলে যাচ্ছি। তোর পিএইচডি শেষ করিস।’ ডাক্তার বড় ছেলে হাসান খান সাদেকীনই মূলত বাবার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। আর ছোট ছেলে আশেক খান আলেখীন ইত্তেফাক-এর সাংবাদিক।
হাসানের চলে যাওয়ার মুহূর্তটা এখনো আমাকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে। সংগ্রামী মানুষটা জীবনসায়াহ্নে এসেও মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি নিজেও খুবই অসুস্থ, হাসপাতালে ওর সঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার ছিল না। হাসপাতালে নেওয়ার সময় আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, ‘হাসান, আমাকে কিছু বলে যাও। তুমি এভাবে আমার কাছ থেকে বিদায় নেবে!’ কিছু বলার জন্য ওর সে যে কী আকুলতা, অনেক চেষ্টা করেও কিছুই বলতে পারল না সে। গলা দিয়ে কোনো স্বরই বের হচ্ছিল না। শুধু হাত নেড়ে ওর অপারগতার কথা প্রকাশ করছিল। আর মুখটা কাছে এনে আমার গালে ছুঁইয়ে দিয়ে গেল। এই আমাদের শেষ দেখা। সবাই প্রার্থনা করবেন এই মহৎ মানুষটির আত্মা যেন শান্তি পায়।
আয়েশা সিদ্দিকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও কারুকলা অনুষদের সাবেক গ্রন্থাগারিক।