হিরোশিমার জন্য অনুশোচনা?

আরিয়ে নাইয়ার
আরিয়ে নাইয়ার

এ মাসের শেষের দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জাপান সফর করবেন, যার মধ্য দিয়ে হিরোশিমা–বিষয়ক আলোচনার ইতি ঘটবে বলে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, খবর হিসেবে তা আনন্দেরই। এটা নিশ্চিত, ওবামা ১৯৪৫ সালের পারমাণবিক হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন না, যে বোমাবর্ষণের কারণে শহরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, আর প্রায় ৯০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল (পরবর্তীকালে আরও অনেক মানুষ তেজস্ক্রিয়তার কারণে মারা যায়)। যা হোক, ওবামার এই সফরে অতীত মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, অর্থাৎ কেন এমনটা ঘটেছিল।
হিরোশিমা ও এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলার পক্ষে সব সময় যে যুক্তি দেওয়া হয় তা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত শেষ করার লক্ষ্যে এটা করা হয়েছিল। এমনকি এর কারণে অনেক জাপানি ও মার্কিন নাগরিকের জীবন বেঁচে গিয়েছিল, এ কথাও বলা হয়। এই যুক্তির মাধ্যমে আকারে–ইঙ্গিতে বলা হয়, হিরোশিমা কোনো সামরিক লক্ষ্য ছিল না। এর মূল কৌশলগত লক্ষ্য ছিল বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা, যাতে জাপানিরা বুঝতে পারে, যুদ্ধ চালাতে হলে কী মূল্য দিতে হবে।
কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, জাপানিদের পারমাণবিক বোমার বিধ্বংসী ক্ষমতা দেখানোর জন্য তো শহরের বাইরে সামরিক ঘাঁটিতেও হামলা করা যেত। এ কথাটিও মার্কিন নীতিপ্রণেতারা ভেবেছিলেন। কিন্তু সেটা করা হলে জাপানি নীতিপ্রণেতাদের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না—এই চিন্তায় তাঁরা সেটা বাদ দেন।
বস্তুত, দূরবর্তী শহরে বোমা না ফেলে এই হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন নীতিপ্রণেতাদের মনে আরেকটি ভাবনা ছিল। তাঁরা আসলে সরাসরি দেখতে চাচ্ছিলেন, শহরে এই বোমা ফেললে তার প্রভাব কেমন হয়। যেমন, তাঁরা টোকিওর কথা ভাবেননি। কারণ, কিছুদিন আগেই টোকিও শহরকে আগুনবোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে সেখানে পারমাণবিক বোমা ফেলা হলে তার ফলাফল ঠিক বোঝা যাবে না। মার্কিন কর্মকর্তারা কিয়োটো শহরের কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন যুদ্ধমন্ত্রী হেনরি স্টিমসন ওই শহরে মধুচন্দ্রিমা করতে গিয়েছিলেন বলে বাদ সাধেন, এ রকম একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসম্পন্ন শহর ধ্বংস করা যাবে না। ফলে শেষমেশ হিরোশিমা ও নাগাসাকিকেই বেছে নেওয়া হয়।
এই মনোভঙ্গির সমস্যাটা সবার কাছেই খোলাসা হওয়া উচিত। সবচেয়ে দৃশ্যমান ব্যাপারটা হলো, যদি যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত করতে বেসামরিক নাগরিকদের এমন গণহারে মারা গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে নৃশংসতার সব ধরনই কোনো না-কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য। এত কিছুর পরও ওবামা হিরোশিমাবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। অধিকাংশ মার্কিন নাগরিকই এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করবেন। নানা কারণে মার্কিনদের মধ্যে এ মনোভাব গড়ে উঠেছে।
প্রথমত, প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে জাপানিদের ভূমিকা। জাপান যেসব এশীয় দেশ দখল করেছিল, সেখানকার জনগণের সঙ্গে তারা শুধু নির্মম আচরণই করেনি (ফলে অনেকেই মনে করেন, জাপানের বেসামরিক মানুষের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা ঠিক), তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে পার্ল হার্বারে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এ যুদ্ধে টেনে নিয়ে আসে। অনেক মার্কিন নাগরিকই মনে করেন, এরপর জাপানে যা করা হয়েছে সেটা ঠিকই আছে, ওটা তাদের প্রাপ্যই ছিল।
এ ছাড়া জাপান আবার নিজের অপকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশের ব্যাপারে অত্যন্ত দ্ব্যর্থবোধক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরীয় নারীদের জোর করে ‘যৌন দাসী’ বানিয়ে তারা নিজ সেনাদের মনোরঞ্জনে বাধ্য করেছিল, সে ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করার ব্যাপারে তারা আমতা-আমতা করে। তার সঙ্গে তো বোমা মেরে যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার যুক্তিটা আছেই। ফলে খুব কম মার্কিন নাগরিকই মনে করেন, জাপানের কাছে দুঃখ প্রকাশ করার কিছু আছে।
কিন্তু এ গল্পের আরও কিছু দিক রয়েছে। পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনন্য ভূমিকা বিবেচনায় তার কাজকে একভাবে না একভাবে যুক্তিসিদ্ধ মনে করা হয়, যদিও অনেক মার্কিন নাগরিকই মনে করেন, সেগুলো কৌশলগতভাবে ভুল ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই হয়েছিল। সম্প্রতি ইরাক যুদ্ধের বেলায়ও তা-ই হলো, যখন সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত রয়েছে—এ ধুয়া তুলে ইরাকে হামলা চালানো হলো। মার্কিনরা ভুল করে দুঃখও প্রকাশ করবে না, এটাই তাদের ‘ব্যতিক্রমী’ বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে সব সময়ই দুঃখ প্রকাশের ক্ষেত্রে অনাগ্রহী ছিল, তা নয়। ১৯৮৮ সালে মার্কিন কংগ্রেসে আইন পাস হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে জাপানি-মার্কিনদের বন্দী করা হয়েছিল, তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তাতে সইও করেছিলেন। রিগ্যানের উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৯১ সালের ৭ ডিসেম্বর এই বন্দীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি লেখেন, সেদিন ছিল পার্ল হার্বারে আক্রমণের ৫০তম বার্ষিকী।
অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই অতীতের অপকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ড, যিনি ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে তা করেছিলেন। যেখানে একসময় ওয়ারশর ঘাঁটি ছিল, সেখানে নির্মিত এক স্মৃতিসৌধ সফরে গিয়ে তিনি হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নুইয়ে জার্মানির পক্ষ থেকে গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, ব্র্যান্ড নিজেও নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। এক অসাধারণ মুহূর্ত ছিল ওটা। ঠিক সেই ক্ষণেই জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করে।
দুঃখ প্রকাশ করে ব্র্যান্ড ছোট হননি; বরং এতে তাঁর ও জার্মানির মর্যাদা বেড়ে গিয়েছিল। যদিও কেউ কল্পনাও করে না, ওবামা হিরোশিমায় গিয়ে সে রকম কিছু করবেন, কিন্তু সেখানে তাঁর বক্তব্য ও চালচলন সারা পৃথিবীরই নজরে থাকবে। আমরা আশা করি, তাঁর কথায় অন্তত এ লক্ষণটুকু থাকবে, সেই বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর দায় যে যুক্তরাষ্ট্রের, তিনি সেটা স্বীকার করেন।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
আরিয়ে নাইয়ার: ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের ইমেরিটাস প্রেসিডেন্ট।