জিয়া বললেন, 'আমি ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে তো?'

জেনারেল জিয়াউর রহমান
জেনারেল জিয়াউর রহমান

প্রশ্নটি রেখেছিলেন প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর অধীন তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এরশাদ ও চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুরের কাছে। স্থান কক্সবাজার আর সময়টা ছিল উনিশ শ একাশির মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ।
জেনারেল জিয়া এসেছেন কক্সবাজারে স্থলসেনা, নৌসেনা ও বিমানসেনার বার্ষিক মহড়া দেখতে। বসেছেন তিনি কক্সবাজার বিমানবন্দরের টাওয়ার বারান্দায়, যেখান থেকে অদূরে সমুদ্রসৈকতে অনুষ্ঠিত মহড়া দেখতে পাওয়া যাবে। তিনি সামনের সারিতে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বসে আর ঠিক পেছনে মেজর জেনারেল মঞ্জুর। জিয়া ঠাট্টাচ্ছলে কথাটা বলেছিলেন, কিন্তু এরশাদ বেশ গম্ভীর হয়ে মঞ্জুরের দিকে তাকালেন। মঞ্জুর হেসে বললেন, স্যার, আপনি সেনাবাহিনীর গোলাগুলি থেকে নিরাপদ দূরত্বে। উপস্থিত সবাই হেসে উঠলেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন তিন বাহিনীর হোমরাচোমরা অফিসার, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এবং বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। আর ছিলাম আমি, তৎকালীন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক।
জিয়াউর রহমানের সেদিনের সে কৌতুক যে তিন সপ্তাহ পরে মারাত্মকভাবে সত্যি হবে, তা কেউ জানত না, অন্তত জিয়া তো নয়। জিয়ার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমি বিশদভাবে আমার বইতে লিখেছি, আজ এ লেখায় তার পুনরুক্তি করতে চাই না। আমি এ লেখায় কক্সবাজারের যৌথ বাহিনীর মহড়ায় আমার প্রত্যক্ষ তৎকালীন তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার, সে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রতি সামরিক অধিকর্তাদের উদ্ধত আচরণ ও দেশে বিদ্যমান দ্বৈত শাসনের কিছু ঘটনা তুলে ধরতে চাই।
কক্সবাজারে সামরিক বাহিনীর যৌথ মহড়া এর আগেও হয়েছে, যেখানে তিন বাহিনী সম্মিলিত স্থল-জল-বায়ুতে ছদ্মযুদ্ধের মহড়া করত। এতে তিন বাহিনীর প্রধানেরা ছাড়াও সেনাবাহিনীর সব আঞ্চলিক অধিনায়কেরা থাকতেন। জেনারেল জিয়াও সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে প্রত্যক্ষ করতেন। এটা ছিল সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীর ব্যাপার, আমরা বেসামরিক কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলাম না। শুধু সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধে স্থানীয় প্রশাসন মহকুমার সব সরকারি রেস্টহাউসগুলো সামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে দিতেন কয়েক দিনের জন্য।
সেবার মে মাসে তার অন্যথা হলো না। সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধে সার্কিট হাউসসহ সব সরকারি বিশ্রামাগার তাদের এখতিয়ারে দেওয়া হলো। এমনিতেই কক্সবাজারে সে সময় সরকারি রেস্টহাউস খুব অল্প ছিল। সামরিক বাহিনী সব নিয়ে নেওয়ায় অন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তার সে কয়টা দিন কক্সবাজাের থাকার আর জায়গা ছিল না। আমি এ নিয়ে বেশি ভাবলাম না, কারণ ওই সময় কোনো মন্ত্রীর কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল না।
বিপদ হলো মহড়ার চার-পাঁচ দিন আগে। হঠাৎ একদিন কক্সবাজারের মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) আমাকে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে জানালেন যে এইমাত্র তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট সাহেবের সঙ্গে কক্সবাজার আসছেন মহড়া দেখতে। শুধু তিনি নন, তাঁর সঙ্গে আসবেন আরও পাঁচ-ছয়জন মন্ত্রী। মহকুমা প্রশাসকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, কোথায় তাঁদের রাখবেন। কারণ সব রেস্টহাউস সেনাবাহিনী নিয়ে নিয়েছে। এসডিও আমাকে ধরলেন যাতে চট্টগ্রামের সামরিক অধিনায়ক মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে বলে অন্তত প্রধানমন্ত্রীর জন্য সার্কিট হাউসে একটি কামরা ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলি। আমি রাজি হলাম, আর এ-ও বললাম প্রধানমন্ত্রী আর অন্যান্য মন্ত্রীর বিকল্প বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে, দরকার হয় পর্যটন মোটেলে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জেনারেল মঞ্জুরকে জানালাম উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা আর অনুরোধ করলাম প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সার্কিট হাউসে রাখার জন্য। জেনারেল মঞ্জুর বললেন, এটা সম্ভব নয়। কারণ সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট (তাঁর কাছে সুপ্রিম কমান্ডার) ছাড়া আর থাকবেন তিন বাহিনীর প্রধানেরা। মঞ্জুর আরও বললেন এবং বিরক্তির স্বরে, প্রধানমন্ত্রীকে সামরিক বাহিনীর মহড়ায় তাঁরা আমন্ত্রণ করেননি। তাঁকে আর তাঁর মন্ত্রীদের বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সামলাতে হবে। তবে আমার বিশেষ অনুরোধে তিনি একটি রেস্টহাউস ছাড়তে রাজি হলেন। পরে আমরা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ছয়জন মন্ত্রীকে সে রেস্টহাউস আর পর্যটন মোটেলে রাখি। (শাহ আজিজুর রহমান তাঁকে সার্কিট হাউসে জায়গা দেওয়া হচ্ছে না শুনে বেশ উষ্মা প্রকাশ করেন এবং স্থানীয় প্রশাসনের ওপর হম্বিতম্বি করেন। তিনি তখনো জানতেন না যে সামরিক বাহিনী পরে তাঁর ও তাঁর মন্ত্রীদের সঙ্গে কী আচরণ করবে।)
কক্সবাজারে আমার সে অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল না, এটা ছিল সম্পূর্ণভাবে একটি সামরিক ব্যাপার। জেলা প্রশাসক হিসেবে আমার সেখানে কোনো দায়িত্ব ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে আগের দিন প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব ফোনে জানালেন যে প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তাঁর সঙ্গে আমি যেন কক্সবাজারে দেখা করি, জরুরি কথা আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজারে চলে গেলাম। চার ঘণ্টার রাস্তা, পৌঁছালাম রাতে। সব রেস্টহাউস আর্মির দখলে, উঠলাম পর্যটন মোটেলে।
পরদিন সকালে উঠেই গেলাম বিমানবন্দরে প্রেসিডেন্টকে রিসিভ করতে। সেখানে ছিলেন তিন বাহিনী প্রধানেরা আর মঞ্জুর। জিয়ার সঙ্গে বিমান থেকে নামলেন প্রধানমন্ত্রী ও আরও পাঁচ-ছয়জন মন্ত্রী, যাঁদের সবার নাম মনে নেই, একমাত্র বিমান পরিবহনমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান ছাড়া।

>পরিতাপের বিষয় প্রেসিডেন্ট জিয়া এর কিছুদিন পর একই মাসে মারা যান তাঁর নিজের তৈরি সামরিক কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রে। তাঁর মৃত্যুতে যতখানি তাঁর সৃষ্ট বেসামরিক রাজনীতিকেরা শোক এবং একাত্মতা দেখিয়েছিলেন, মনে হয় তার একাংশও সামরিক নেতারা দেখাননি, অথচ তাঁর মৃত্যুর সুযোগ তাঁরাই বেশি নিয়েছিলেন

প্রেসিডেন্ট জিয়া নামার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সব সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুরসহ জিয়াকে নিয়ে এত তটস্থ ছিলেন যে তাঁরা কোনো মন্ত্রী তো দূরের কথা, প্রধানমন্ত্রীর দিকেও ভ্রুক্ষেপ করলেন না। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললাম যে আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যেতে হচ্ছে, তবে এসডিও তাঁর সঙ্গে থাকবেন।
সকাল ১০টায় ছিল সম্মিলিত মহড়া। জিয়া প্রথম সার্কিট হাউসে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে চলে আসেন কক্সবাজার বেসামরিক বিমান ভবনে, যার ছাদ থেকে মহড়া দেখার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। বসার জায়গা করা হয়েছিল চার কি পাঁচ সারিতে। জিয়া আর তিন বাহিনীর প্রধানেরা বসেছিলেন সামনের সারিতে। পেছনের সারিতে মেজর জেনারেল পদবিধারীরা, যাঁদের সঙ্গে পঙ্ক্তি পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ। পেছনের সারিতে অন্য সামরিক কর্তাদের সঙ্গে ছিলেন বাকি মন্ত্রীরা আর কেন জানি না, আমি। মহড়া প্রায় দেড় ঘণ্টা চলে। আমরা সবাই অদূরে সৈকতে চলা ছদ্মযুদ্ধ দেখি। এক বাহিনী নৌজাহাজে আক্রমণ করে, স্থলবাহিনী তা প্রতিহত করে, ওপর থেকে আসে বিমান। মহড়া শুরু হওয়ার আগে জিয়া ওপরে উল্লিখিত মন্তব্য করেন, যা সবাই কৌতুক হিসেবে নেন সেদিন।
শাহ আজিজ ও জিয়ার অন্যান্য মন্ত্রী আগ্রহের সঙ্গে মহড়া দেখতে থাকেন। আমার মনে পড়ে না মহড়া চলাকালে জিয়া একবারও পেছনে আসীন প্রধানমন্ত্রী কিংবা কোনো মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
মহড়ার পর উপস্থিত সবার জন্য এক চা-চক্র ছিল। এটা ছিল সামরিক বাহিনী প্রদত্ত একমাত্র আপ্যায়ন, যেখানে জেনারেল জিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর ছিল মঞ্জুরের দেওয়া প্রেসিডেন্টের জন্য দ্বিপ্রাহরিক ভোজন, আর রাতে সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর প্রধান এরশাদের নৈশভোজ। দুটিতে মন্ত্রী তো দূরের কথা প্রধানমন্ত্রীকেও সামরিক কর্মকর্তারা আমন্ত্রণ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। প্রধানমন্ত্রী নৈশভোজে তাঁর আমন্ত্রণ নেই শুনে বেশ হতাশ হন, কিন্তু ঝানু রাজনীতিবিদ হওয়ায় বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি, যতটা উষ্মা প্রকাশ করেন তাঁর সার্কিট হাউসে জায়গা নেই শুনে।
আমাকে সেদিন রাতে নৈশভোজের পর প্রেসিডেন্ট জিয়া সার্কিট হাউসে ডাকেন। আমার ধারণা হয়েছিল যে তিনি হয়তো শাহ আজিজ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইবেন। জিয়া তিনি কিংবা তাঁর মন্ত্রীদের সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইলেন না। কথা হলো কক্সবাজারের কিছু প্রকল্প নিয়ে। আমার তখন (এবং আরও অনেকবার) মনে হয়েছে যে জিয়া ভালো করেই জানেন তাঁর মন্ত্রীদের অবস্থান কোথায়, তাঁদের তিনি যেভাবে চালাবেন, তাঁরা তাতেই খুশি। তাঁর সামরিক বাহিনীও তা ভালো করে জানত।
পরদিন সকালে আমি যখন সার্কিট হাউসে ফিরে গিয়েছি প্রেসিডেন্টকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এরশাদ আমাকে এক পাশে ডেকে এনে বললেন, তিনি শুনেছেন শাহ আজিজ নাকি তাঁর থাকার জায়গা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। আমি ভাবলাম শুধু থাকার জায়গা, এরশাদ বলছেন কী? তাঁকে ডেকে এনে কত অপমান করা হয়েছে, তা কি তাঁরা জানেন না? আমি কিছু বলার আগেই এরশাদ বলে উঠলেন ডিসি সাহেব, তাঁকে (অর্থাৎ শাহ আজিজ) একটু সামলে নেন। আমি শুধু অবাক হয়ে রইলাম। ভাবলাম আমাদের কি দুটি সরকার, এক বেসামরিক আরেক সামরিক?
পরিতাপের বিষয় প্রেসিডেন্ট জিয়া এর কিছুদিন পর একই মাসে মারা যান তাঁর নিজের তৈরি সামরিক কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রে। তাঁর মৃত্যুতে যতখানি তাঁর সৃষ্ট বেসামরিক রাজনীতিকেরা শোক এবং একাত্মতা দেখিয়েছিলেন, মনে হয় তার একাংশও সামরিক নেতারা দেখাননি, অথচ তাঁর মৃত্যুর সুযোগ তাঁরাই বেশি নিয়েছিলেন।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক, অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড আফটারমেথ বইয়ের লেখক।