কবর সংরক্ষণ নিয়ে ভাবতে হবে

ঢাকায় কবরস্থান–সংকটের বিষয়টি কারও অজানা নয়
ঢাকায় কবরস্থান–সংকটের বিষয়টি কারও অজানা নয়

কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর দেহ সমাহিত করতে হয়। এটা মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদিসহ অনেক ধর্মের বিধান। আর কবর দিতে প্রয়োজন জমির। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই ছোট। সে জন্যই আমরা ধরে রাখতে পারছি না বনভূমি, কৃষিজমি এমনকি খাল-বিল, খেলার মাঠ, নদীনালা। এমনকি শিল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের জন্যও জমির সংস্থান করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। তেমনি কঠিন হয়ে পড়েছে কবরের জমির সংস্থানও। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীতে এ সংকট ইদানীং প্রকট রূপ নিয়েছে। এখানে বসবাসকারী কেউ মারা গেলে কাউকে মফস্বলের পুরোনো ঠিকানায় নেওয়া হয়। তবে সে প্রবণতায়ও ভাটা পড়েছে। পুরোনো ঠিকানার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলছেন অনেকে। তাই মৃত্যুর পর ঢাকাতেই তাঁদের কবর দিতে হয়। ঢাকায় কবরস্থান–সংকটের বিষয়টি কারও অজানা নয়। এ সংকট দূরীকরণে রায়ের বাজারে প্রায় ৮০ হাজার প্লটের একটি কবরস্থান সম্প্রতি চালু হয়েছে। কিন্তু এতেও কি হবে?
২০১৩ সালের জুন মাসে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন,
১ লাখ জনসংখ্যা–অধ্যুষিত স্থানের জন্য ৩০ থেকে ৪০ একর কবরের জমি থাকতে হয়। সে বিবেচনায় তখনকার হিসাবেই ঢাকায় কবরস্থানের মোট আয়তন হওয়া উচিত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একর। আর রায়ের বাজার যুক্ত হয়েও আমাদের দুটি সিটি করপোরেশনের আওতায় আছে ২৩২ একরের ৭টি কবরস্থান। অবশ্য সামরিক বাহিনীর একটি নিজস্ব কবরস্থান রয়েছে। আর আছে কয়েকটি ব্যক্তিগত কবরস্থানও। অবশ্য একটি পরিকল্পিত নগরীর হিসাব-নিকাশ মেনে আমাদের রাস্তাঘাট, পার্ক, খেলার মাঠ, লেক—এগুলোর কিছুই নেই। সুতরাং কবরস্থানও থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।

তবে এ ধরনের প্রকট সমস্যার মধ্যেও সিটি করপোরেশন থেকে নেওয়া কবরের প্লট নিয়ে কেমন জমিদারি চলছে, সম্প্রতি তার একটি ক্ষুদ্র চিত্র এসেছে ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকে। জানা যায়, বনানী কবরস্থানে জনৈক শিল্পপতি ও সাবেক আইনপ্রণেতা ২৬টি প্লট কিনে রেখেছেন ১৯৯৭-৯৮ সালে। এর মধ্যে দাফন হয়েছে দুটিতে। প্লটগুলো ঘিরে সীমানাদেয়ালে তিনি ব্যক্তিগত কবরস্থান কথাটিও লিখে রেখেছিলেন। ব্যবস্থাপকদের তৎপরতায় এখনো তাঁর নামটি আছে; বাদ গেছে ‘ব্যক্তিগত’ শব্দটি। কেনার সময় তাঁর ব্যয় হয় ৩০ লাখ টাকার মতো। জানা যায়, অগ্রিম সংরক্ষণ করা এসব কবরের এখন গোপনীয় দর প্রতিটির ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা।

একইভাবে  আরেক শিল্পপতি পরিবারের ৪৫টি কবর কেনা আছে। ওই পরিবারের কয়েকজন সদস্য ১৯৯৮-৯৯ সালে ওই সব প্লট কিনে নেন। এ পর্যন্ত আটটি প্লটে দাফন হয়েছে। এ রকম বেশিসংখ্যক প্লটের মালিক আরও কেউ কেউ থাকতে পারেন। এখন অবশ্য সিটি করপোরেশনগুলো কবরের প্লট বিক্রি করছে না। তবে বড় অঙ্কের ফি দিয়ে ১০, ১৫, ২০ বছর মেয়াদি সংরক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবে কোনো কোনো পরিবারের সদস্যদের বরাবরে একটি কবরস্থানে এতগুলো প্লট বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল কোন যুক্তিতে, বোধগম্য নয়। কোনো নিয়ম বা নীতিমালা না থাকুক, স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি তো থাকার কথা। বনানী রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকা। তেমনিভাবে এখানকার কবরস্থানটিরও রয়েছে আভিজাত্য। সে আভিজাত্যে এত বড় ভাগ বসাল মোটে দুটো পরিবার। তা-ও নামমাত্র মূল্য দিয়ে। এখানে তারা বংশানুক্রমে সমাহিত হওয়ার বাসনায় তা করেছে সিটি করপোরেশনের ‘বদান্যতায়’। বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজন কেউ ‘উপহার’ হিসেবে দিতে পারবেন কবরের জমি।

সৌদি আরবে এখন কোনো কবর সংরক্ষণ ও চিহ্নিত করা হয় না। এমনকি বাদশাহর কবরও নয়। তা সত্ত্বেও এ দেশের ধনিকশ্রেণির কেউ কেউ যদি তা করতে চান, ব্যক্তিগতভাবে জমি কিনে করার সুযোগ রয়েছে। তবে সারা দেশে যেভাবে ব্যবহারযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, সেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে গোটা দেশে কবর সংরক্ষণ বন্ধ করার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় নেওয়ার সময় এসেছে। শহরাঞ্চলগুলোতে তো বটেই। নগর ও শহরবাসীর গৃহস্থালি বর্জ্য নিষ্কাশনের উপযুক্ত স্থানও পাওয়া যায় না। যেখানেই ফেলার ব্যবস্থা করা হয়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আসে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে। এ বিষয়ে নগরপিতারা যেমন অসহায়, তেমনি দোষ দেওয়া যাবে না প্রতিবাদী ব্যক্তিদেরও।

আর বর্জ্য ফেলার স্থানগুলোও অনেক ক্ষেত্রে আপত্তিকর। বেশ কিছু বর্জ্য তুরাগতীরের কিছু অংশেও ফেলা হচ্ছে। এতে  তীর ভরাট ও নদীদূষণ—দুটি ‘কাজই’ আপনা থেকে হয়ে চলছে। আপত্তি করা যায়। তখন বলা হবে, কোথায় ফেলব? আসলেই তো তাই। আমাদের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দিতে এগুলো আবাসিক এলাকা থেকে এনে ফেলা হচ্ছে কতগুলো স্থানে। আর এত নির্দোষ স্থান সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভাগুলো পাবে কোথায়? তারাও তো গুরুতর সমস্যায় রয়েছে। অথচ আবর্জনা পরিষ্কার করতেই হবে। বিষয়টি আলোচনায় এল জমির প্রাপ্যতা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সংকটের সমস্যা নজরে আনতে। কবরস্থানের জমিও একইভাবে প্রাসঙ্গিক। রায়ের বাজারে নতুন বড় কবরস্থান করতে যে ৯৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তা-ও তো ব্যক্তিমালিকানায় ছিল। তাঁরা তো হারালেন ভূমি। ক্ষতিপূরণ হয়তো পেয়েছেন সরকারি দরে। আর তা পেতে ঘাটে ঘাটে খেসারতও দেওয়ার কথা অনেকেরই। আমাদের শাসনব্যবস্থায় আমরা এখনো এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে পারিনি। করদাতা জনগণের টাকায় সৃষ্ট সুযোগ-সুবিধার বড় অংশীদার সমাজের উচ্চবিত্তরা। এখন দেখছি কবরস্থানেও তাঁদের কারও কারও কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

আমাদের নগর পরিচালকদের অদূরদর্শিতায় এ জমি বুভুক্ষু রাজধানীতে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা চলছিল দীর্ঘকাল। ঢাকা সিটি করপোরেশনগুলোর আওতায় নতুন চালু হওয়া রায়ের বাজার ছাড়া যে কবরস্থানগুলো আছে, তার পরিমাণ, প্লটের সংখ্যা আর প্রকৃতি এ আলোচনার সহায়ক হতে পারে।

জুরাইন: ১৭.২৬ একর, স্থায়ী কবর ২৬৯৪, অস্থায়ী কবর ৪১০০০ (ঢাকা দক্ষিণ)

আজিমপুর: ২৭.০০ একর, স্থায়ী কবর ৬৫০০, অস্থায়ী কবর ৩০০০০

মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান: ৬৫.০০ একর, স্থায়ী কবর ৩০০০০, অস্থায়ী কবর ৬১০০০ (ঢাকা উত্তর)

বনানী: ১০.০০ একর, স্থায়ী কবর ৭৫১৪, অস্থায়ী কবর ৪৫০০

উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর: ১.১০ একর, স্থায়ী কবর ৮৪, অস্থায়ী কবর ৫৮০

উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর: ৬ একর, অস্থায়ী কবর ২৫০০

ওপরের তথ্যগুলো বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত। কিছু ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। তবে মোটা দাগে বিষয়টি এমনই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন কবরস্থানে ইতিমধ্যে অনেক প্লট স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বনানী তো মনে হয় করা হয়েছে স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়ার জন্যই। আর তা দেওয়াও হয়েছে বিবেচনাহীনভাবে। যেসব স্থায়ী প্লট এখনো খালি রয়েছে, সেগুলো নিয়ে সিটি করপোরেশনগুলো ও সরকার নতুনভাবে বিবেচনা করতে পারে। এ মহানগরীতে জাতীয় জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদানজনিত কারণে কোনো ব্যক্তির কবর স্থায়ী সংরক্ষণের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। আর অন্য সবাইকে একই কাতারে নিয়ে আসা উচিত। যেসব স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া আছে, অথচ ব্যবহার হয়নি, এর বরাদ্দ বাতিলের প্রস্তাবও অযৌক্তিক হবে না। সরকার চাইলে প্রয়োজন বিবেচিত হলে আইনও করা যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া জমিদারিপ্রথা আইন করে বাতিল করা হয়েছে। আর বংশানুক্রমিক ব্যবহারের জন্য রাজধানীর কবরগুলো কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তির হাতে থাকবে, এমনটা হতে পারে না। অস্থায়ী সংরক্ষণব্যবস্থাও পাঁচ বছরের বেশি না হওয়াই সংগত। যানবাহন চলাচল, ফুটপাত, গাড়ি পার্কিং, খাল-বিল, নদীনালা দখল, কোথাও আমরা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। মৃত্যুর পর মানুষের স্থায়ী নিবাস কবর। সে কবরে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো বিরোধ আর ভেদাভেদ নেই। তবে যাঁকে কবর দেওয়া হবে, তাঁকে আভিজাত্য দিতে স্বজনদের এ প্রচেষ্টা কী ফল দেবে? বরং নগরের অন্য বাসিন্দাদের বঞ্চনার অভিশাপ ও গ্লানি বহন করতে হবে তাঁদের।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব