দুভাবে মানুষ হাসাই

>‘আমার মতে, সবচেয়ে মজার বিষয় মানুষ হাসানো। সেটা কমেডি করেও হয়, আবার যারা হাসতে পারে না, নিজেদের লুকিয়ে রাখে, তাদের সুস্থ করালেও হয়।’ এভাবেই ‘মীরাক্কেল’–এর একটি পর্বে বলেছিলেন কৌতুকশিল্পী কমর উদ্দিন আরমান। মীরাক্কেল খ্যাত আরমান কৌতুক বলে মানুষকে যেমন হাসান, তেমনি সারা দেশ থেকে ঠোঁট ও তালুকাটা শিশুদের খুঁজে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে চট্টগ্রামের এমন একটি প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন তিনি। আরমানের গল্প নিয়ে ছুটির দিনের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন


বড়সড় দোতলা ভবন। আঙিনায় রকমারি ফুলের গাছ। আশপাশটাও সবুজে ভরা। ঢোকার মুখে মন ভালো করে দেওয়া ছবি—দরজায় বড় ফেস্টুনে এক শিশুর চওড়া হাসি। বোঝাই যাচ্ছে ওদের জগৎ। ভেতরের ঘরে পা রাখতেই কানে এল শিশুদের কোলাহল। কেউ ঘরের মধ্যে দৌড়াচ্ছে, কেউ খেলছে বিছানায় বসে। এসব ঘরে ঘুরে ঘুরে খুনসুটিতে মাতছেন এক তরুণ। ক্ষণে ক্ষণে তুলছেন হাসির ফোয়ারা।

ঠোঁটকাটা শিশুর মুখে হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করেন কৌতুকশিল্পী আরমান। ১২ জুলাই চট্টগ্রামের লায়ন মোখলেছুর রহমান ফাউন্ডেশনে এক শিশুর সঙ্গে মজা করছেন আরমান। শিশুটির মায়ের মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে হাসি। ছবি: সৌরভ দাশ
ঠোঁটকাটা শিশুর মুখে হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করেন কৌতুকশিল্পী আরমান। ১২ জুলাই চট্টগ্রামের লায়ন মোখলেছুর রহমান ফাউন্ডেশনে এক শিশুর সঙ্গে মজা করছেন আরমান। শিশুটির মায়ের মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে হাসি। ছবি: সৌরভ দাশ

সেই তরুণ আমাদের চেনা মুখ কমর উদ্দিন আরমান। পরিচয় আরও বিস্তৃত করলে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল জি বাংলার ‘মীরাক্কেল সিজন ৯’ প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় রানারআপ। কৌতুকে দম ফাটানো হাসিতে মজিয়েছিলেন দুই বাংলার মানুষকে।
কৌতুকশিল্পী আরমানের এ এক অন্য জগৎ, যেখানে চট্টগ্রাম নগরের লায়ন মোখলেছুর রহমান ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক তিনি। কাজ করেন ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীদের নিয়ে। ফাউন্ডেশন পরিচালিত ২০ শয্যার হাসপাতালে বিনা মূল্যে হয় অস্ত্রোপচার। কিন্তু কজনই বা জানেন বিষয়টি। কেউ ধরে নেন নিয়তি, কেউ চিকিৎসা খরচের ভয়ে গুটিয়ে রাখেন সন্তানকে। অথচ ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচার বদলে দিতে পারে সব। মানুষের কাছে সেই বার্তা পৌঁছানোর কাজ করেন আরমান। তাঁর ভাষায়, ‘কৌতুক করা আমার পেশা। এটা করি মনের টানে।’

স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে আরমান
স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে আরমান

হাসি ফেরানোর ছোট্ট দুনিয়া
১২ জুলাই। দুপুর ১২টা। আগে থেকেই কথা বলা ছিল আরমানের সঙ্গে। ছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়ার গ্রামের বাড়িতে। আগের রাতে এসেছেন। সপ্তাহখানেক আগে বাবা মারা গেছেন। অসুস্থ অবস্থায় বাবাকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কেটেছে হাসপাতালে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানা। শোক কাটিয়ে আবার যোগ দিয়েছেন কাজে।
চট্টগ্রাম নগরের খুলশীর লায়ন মোখলেছুর রহমান ফাউন্ডেশনের হাসপাতালে খোঁজ করতেই নিচতলার একটি ঘরে পাওয়া গেল তাঁকে। সেখানে অস্ত্রোপচার করাতে আসা শিশুর অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তখনো তাঁর কোলে একজন শিশু। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। কথা শুরু হলো।
হাসির বার্তাবাহক হিসেবে আরমানের পথচলা শুরু ২০১০ সালে। লিও ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. শামীম খানের আগ্রহে কাজ শুরু। আরমান বলেন, ‘২০১৫ সাল পর্যন্ত কাজের জন্য সম্মানী পেতাম। সেই সম্মানী আমারও দরকার ছিল। চট্টগ্রাম শহরে থাকা-খাওয়ার খরচ চলত ওই টাকায়। এরপর মীরাক্কেলের প্রতিযোগিতায় থাকার জন্য সাত মাসের মতো সরাসরি যুক্ত ছিলাম না। এখন আবার আছি। তবে এখন আমি স্বাবলম্বী, তাই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছি।’
আরমানের কাছে অন্য রকম ভালো লাগার জায়গা এটি। বললেন, ছোট্ট একটি তথ্য দিয়ে একটি মানুষের সারা জীবনের হাসি ফেরাতে পারার আনন্দ সব সময়ের প্রেরণা। ফাউন্ডেশনে তাঁদের মতো স্থায়ী ও অস্থায়ী স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন প্রায় ১০০ জন। তাঁদের হাত ধরে এ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার হয়েছে অন্তত সাড়ে ছয় হাজার ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীর। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ শিশু।

শ্রাবণীর মুখে এখন অমলিন হাসি
শ্রাবণীর মুখে এখন অমলিন হাসি

শ্রাবণী, মোস্তাকদের অমলিন হাসি
ঘটনাটা ছয়-সাত মাস আগের। একদিন ছোট্ট শ্রাবণীর খোঁজ পান আরমানদের একজন কর্মী। নগরের চকবাজারে টেম্পোতে দেখা। দাদির সঙ্গে এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ওই স্বেচ্ছাসেবক ফোন নম্বর নিলেন। পরে খোঁজ শুরু করেন আরমান। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বানীগ্রামে তাঁদের বাড়ি। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মেয়ের ঠোঁটকাটার যে চিকিৎসা করাবেন, সেই সামর্থ্য নেই। আরমান বিনা খরচে অস্ত্রোপচার করে সুস্থ হওয়ার কথা বললে প্রথমে তাঁদের বিশ্বাস করাতে কষ্ট হয়। পরে বুঝিয়ে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। অস্ত্রোপচারের পর এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয় শ্রাবণী। হাসপাতাল ছাড়ার দিন সেকি হাসি তাঁর মায়ের!
অন্যদিকে মোস্তাকের গল্পটা আরও করুণ। ১২ বছরের মোস্তাক জন্মান্ধ। তার ওপর ঠোঁটকাটা। তবে সে ভালো গান করে। মেসেঞ্জারে মোস্তাকের গানের ভিডিও আরমানকে পাঠান কেউ একজন। শুরু করেন খোঁজ। অবশেষে দেখা পান মোস্তাকের। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নে তার বাড়ি। আরমান ছুটে যান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মোস্তাকের সঙ্গে দেখা। কুড়িগ্রামে তার বাড়িতে গিয়ে আরমান দেখেন, খুবই দরিদ্র তারা। বাবা দিনমজুর। তিন বেলা খাবার জোটাতে হিমশিম অবস্থা। আরমান পরিবারটির সঙ্গে এক দিন কাটান। গিয়েছিলেন মোস্তাককে সঙ্গে করে চট্টগ্রামে অস্ত্রোপচারের জন্য আনতে। কিন্তু মোস্তাকের যে শারীরিক অবস্থা, তাতে তাকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আনা অসম্ভব। শেষে বের করলেন উপায়—সেখানে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ‘অপারেশন ক্লেফট’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে তার অস্ত্রোপচার করিয়ে দেন আরমান। এখন ঠোঁটকাটা সেরেছে। এবার তার চোখের আলো ফেরানোর কাজ করবেন—দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন আরমান।

‘মীরাক্কেল’–এর একটি পর্বে (২০১৬) উপস্থাপক মীরের সঙ্গে আরমান। ছবি: সংগৃহীত
‘মীরাক্কেল’–এর একটি পর্বে (২০১৬) উপস্থাপক মীরের সঙ্গে আরমান। ছবি: সংগৃহীত

পালাবদলের মীরাক্কেল!
২০১৫ সালে মীরাক্কেলের সিজন ৯-এর প্রথম পর্বে আরমানের পরিবেশনার পর কৌতুকের হাস্যরসের অনুষ্ঠানটি হয়ে পড়ে গুরুগম্ভীর। নিজেই জানান তাঁর কাজ সম্পর্কে। আরমান বলেন, ‘আমি দুভাবে মানুষ হাসাই। একটি কৌতুক বলে, অন্যটি ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীদের হাসি ফিরিয়ে দিয়ে।’ এই কথা শোনার পর উপস্থাপক মীর তো বটেই, বিচারক এবং অন্যরাও দাঁড়িয়ে আরমানকে সম্মান জানান।
সবাই জানার পর আরমানের ফেসবুক পেজে আসতে থাকে ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীদের খবর। এসব তথ্য ও ঠিকানা তিনি পাঠিয়ে দেন ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে। প্রতিযোগিতায় থাকা অবস্থায়ও অনেকের অস্ত্রোপচার হয়েছে আরমানের মাধ্যমে।
মীরাক্কেল থেকে আসার পর তো রাতারাতি অবস্থা বদলে গেল। এখন আরমান কিছু বললেই মানুষ তাঁর কথায় সায় দেন। যেখানেই কোনো অনুষ্ঠান করতে যান, সেখানে মানুষকে বিনা মূল্যে হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার এ খবর পৌঁছে দেন। আরমান বলেন, ‘এখন আমার কাজের সুবিধা হয়েছে বেশি। ঘড়ি ধরে অফিস না করলেও ফেসবুকে সব সময় সক্রিয় থাকি। এর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছি তথ্য।’
ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শামীম খান বলেন, ‘আরমান তারকা হওয়ার পর তাঁর কাজ আরও বেড়েছে। এখন তাঁকে সবাই চেনে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফাউন্ডেশনের সব সুবিধার কথা। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়া।’

কুড়িগ্রামের মোস্তাকের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন আরমান
কুড়িগ্রামের মোস্তাকের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন আরমান

হাসি ফেরানোর শুরুর গল্প
লায়ন মোখলেসুর রহমান ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পপতি নাদের খান। বন্ধুর নামে গড়ে তোলেন এ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। যাত্রা করে ২০০১ সালে।
শুরুতে বেশ কয়েক বছর প্রতিষ্ঠানে ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীদের ব্যয়ভার বহন করতেন নাদের খান নিজে এবং লায়ন্স ক্লাবের সদস্যরা। ২০০৫ সালে অপারেশন ক্লেফটের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৮ সালের জুন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কাজ চলে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘দ্য স্মাইল ট্রেন’-এর সঙ্গে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।