মেহমান

বদলে যাওয়ার নিয়ম মেনে আজাদ ভাইও বদলে গেছেন। চার বছর আগে দেখা সেই ক্লিন সেভড আজাদ ভাই আর নেই। তার মুখভর্তি এখন মেহেদি রঙা দাড়ি। বদলে গেছে তার চারপাশও। তিনি যে চেয়ারে বসতেন সেই চেয়ারও নেই। নতুন চেয়ারের পেছনে ঝুলছে গোলাপি রঙের তোয়ালে।

আমি মনে মনে একটু দমে যাই। বহিরাঙ্গের মতো অন্তরঙ্গেও কি বদলে গেছেন আজাদ ভাই? সেই সদা হাস্যোজ্জ্বল, আন্তরিক, সহযোগিতাপরায়ণ আজাদ ভাই কি নেই?

আজাদ ভাই আমাদের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সেমিনার কর্তা। কারণে-অকারণে কত অগণনবার জ্বালিয়েছি তাঁকে। সেই আজাদ ভাই কি এখনো তেমনই আছেন? মনের ভেতর কু ডাক দেয় আমার।

‘কী মিয়া, কী সমস্যা হইছে কও? বিপদে না পড়লে তো আর আজাদের কাছে আসবা না, জানি।’ আমাকে দেখে আজাদ ভাই-ই কথা শুরু করেন। সেই হাসিমুখ। আমার মনের মেঘ সরে যেতে শুরু করে। উৎফুল্ল হয়ে বলি, আমাকে চিনতে পেরেছেন আজাদ ভাই? আমি...।

কথা শেষ করতে দেন না আজাদ ভাই। ‘চিনমু না ক্যান ব্যাটা? তুই থার্ড ব্যাচের ছিলি না? তুই, মেহেদী, শোভন আমারে কি কম জ্বালাইছিস?’ চেয়ার এগিয়ে দেন আজাদ ভাই। ‘নে বস। কী সমস্যা হইছে ক দেখি।’

বিরাট বিপদে পড়েছি আজাদ ভাই...। গলা কেঁপে ওঠে আমার। কান্নায় ভেঙে পড়তে যাচ্ছিলাম। আজাদ ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে কাঁধে হাত রাখেন। ‘এত টেনশন করতেছিস ক্যান ব্যাটা! আজাদ আছে না?’ তারপর সব শুনে আজাদ ভাই হো হো করে হেসে ওঠেন। ‘এইডা কোনো ঘটনাই না ব্যাটা! তিন শ ট্যাকা ফি জমা দিয়া একটা অ্যাপ্লিকেশন কর। এক সপ্তার মধ্যে সব ঠিক হইয়া যাইব, যাহ।’

সব কাজ শেষ করে আজাদ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোসিওলজি বিল্ডিং থেকে ধীর পায়ে নেমে আসি। ক্যাম্পাসের চিরপরিচিত জায়গাগুলোতে মমতাভরে চোখ বুলাই। সেই কাঁঠালতলা তেমনই আছে। তবে পূর্বদিকে একটা নতুন ক্যানটিন হয়েছে। পশ্চিমের বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাছগুলো বড় হয়েছে। ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে দেখি সেই ডিম খিচুড়ি এখনো আছে। আমরা যে রকম অমৃত মনে করে খেতাম এখনকার ছেলেমেয়েও দেখি সে রকম তৃপ্তি নিয়েই খাচ্ছে।

ক্যাম্পাসের বাইরে এসে প্রধান ফটকের পাশে সেই চায়ের ঝুপড়ি দোকানগুলো আঁতিপাঁতি করে খুঁজি। নেই। একটাও নেই। রাস্তার উল্টো দিকে দেখলাম টিএসসি হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখলাম ইয়া বড় বড় লুচি আর সবজি পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের সময়ে এসব ছিল না। দুপুরের লাঞ্চ হিসেবে অনেক ছেলেমেয়েই এসব খাচ্ছে। লোভ দমানো গেল না। বললাম, আমাকেও লুচি দিয়েন। দুটো লুচি, সঙ্গে আলু দিয়ে বানানো একধরনের ঘন ডাল। মুখে দিতেই খুশিতে চোখ বন্ধ হয়ে এল। স্বর্গের খাবার কি এর চেয়েও সুস্বাদু?

বিল দিতে গিয়ে আরেকবার বিস্মিত হলাম। মাত্র ষোলো টাকা! ষোলো টাকায় মধ্যাহ্নভোজ!

এই লুচির দোকানগুলোর উল্টো দিকে কিছু ঝুপড়ি চায়ের দোকান হয়েছে, দেখলাম। প্রত্যেকটা ঝুপড়ির ভেতর উঁকি দিই আর মন খারাপ হয় আমার। চেনা নয় কেউ। সবাই নতুন। পুরোনোরা তাহলে গেল কোথায়? সবশেষ ঝুপড়িতে এসে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আমার। এ যে জসিম ভাই! সেই চা-ওয়ালা জসিম ভাই। আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন। ‘আপনেরা হেই যে পাস কইরা বাইর হইয়া গেছেন, আর তো আহেন না! এমনে কইরা কেউ ভুইলা থাহে, কন?’ নিজের কাঁধের গামছা দিয়ে বেঞ্চি মুছে দিয়ে বলেন, ‘বহেন।’ সেই কফি দেওয়া চা চাই জসিম ভাই, বসতে বসতে বলি আমি। জসিম ভাই হাসেন। গরম পানি দিয়ে কাপ ধুয়ে চা বানিয়ে দেন। চায়ে চুমুক দিয়ে এক নিমেষে চলে যাই আগের দিনগুলোতে।

ফেরার সময় বিল দিতে গিয়ে তাজ্জব বনে যাই। জসিম ভাই কিছুতেই চায়ের বিল নেবেন না। ‘কী যে কন! রাহেন তো। বিল দিতে হইব না। আপনি আমগো মেহমান। মেহমানের কাছ থিকা কেউ বিল লয়?’ আমি যতই তাঁর হাতের মধ্যে টাকা গুঁজে দিতে যাই তিনি ততই ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দেন আর বলেন, ‘আপনি এখন মেহমান...আপনি এখন মেহমান।’

এমন মধুময় ভালোবাসা আমি আমার জীবনে খুব কম পেয়েছি। ভালোবাসার কাঙাল আমি, চোখে জল চলে আসে এমনিতেই। দ্রুত বের হই ঝুপড়ি থেকে। বাইরে চব্বিশ ক্যারেটের সোনার মতো চকচকে রোদ। সেই রোদে শুকিয়ে যেতে থাকে আমার চোখের শিশির। কিন্তু বুকের ভেতর জেগে থাকে এক টুকরো মুগ্ধ অচিনপুর।