আমার আম্মার বই

আমাদের চার ভাইবোনকে সময়ানুবর্তী রাখতে আম্মা নিজে সারা জীবন কঠোর নিয়ম মেনে চলেছেন। টিভি দেখা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া—সবকিছু ছিল চূড়ান্ত রকমের সময় মেনে। এমনকি অসুস্থ হলেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি কোনো দিন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আজ অবধি কোনো দিনও আম্মাকে বিলাসিতা করে এক বেলা আলস্যে সময় কাটাতে দেখিনি। তাঁর কাছে পড়ার বই ছাড়া অন্য যেকোনো বই ছিল ‘আউট বই’। একমাত্র বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নতুন ক্লাস শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েক দিন ‘আউট বই’ পড়ার অনুমতি মিলত। তা-ও নিয়মের মধ্যে। এ ছাড়া সারা বছর বেশ কসরত করেই বই পড়তে হতো—বাথরুমে গিয়ে, লেপের নিচে, পড়ার বইয়ের ভেতরে বই লুকিয়ে। ধরা পড়লে খবর ছিল। ছোটবেলায় আম্মাকে ভয় পেতাম যমের মতো।

কলেজে পড়ার সময় মনে হলো—আর না, এভাবে চলতে পারে না। এ পরিস্থিতি শেষ হওয়া প্রয়োজন। শুরু করলাম হুমায়ূন আহমেদ দিয়ে। একটা বইয়ের প্রথম কিছু অংশের গল্প বললাম আম্মাকে। বাকিটা নিজে পড়ে নেন বলে বইটা দিয়ে সরে গেলাম। দুই দিনের মধ্যে ওই বই শেষ। এরপর একে একে সুনীল, সমরেশ, আশাপূর্ণা দেবী, বিমল চন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়—সবই চলল। পড়া শেষ হলে জিজ্ঞেস করতাম, কেমন লাগল। মনে আছে, আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতি পড়ার পর বকুল কথা আর সূবর্ণলতা পড়ার জন্য কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। এবার অবশ্য আমি একটু ভাব নিতে ছাড়লাম না।

তত দিনে সেই কঠোর নিয়মের ‘আউট বই’ পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। পরীক্ষার আগের দিনও গল্পের বই হাতে দেখলে তেমন কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হতো না। বইপড়ার পাশাপাশি তিনি পত্রপত্রিকায়ও তখন নিয়মিত লেখা শুরু করেছেন। প্রথম আলোর ছুটির দিনের ‘ঘরমন জানালায়’ নিজের মনের জানালা খুলে দিতেন নিয়মিত। একেকটা লেখা প্রকাশিত হতো, আম্মার উৎসাহ বেড়ে যেত বহু গুণ। মাঝে মাঝে পাঠকদের চিঠিও পেতেন। আম্মার পথ ধরে একসময় আমিও এই জগতে প্রবেশ করলাম।

দীর্ঘদিন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বর্তমান পেশায় যোগদানের পর সময়ের অভাবে এদিকে আর মনোযোগ দেওয়া হয়নি। তবে আম্মা তাঁর অভ্যাস অব্যাহত রেখেছেন। কিছুদিন পরপর সেই লেখা পত্রিকায় প্রকাশিতও হতে থাকে। সঙ্গে পড়ার পরিসর বাড়ানোর জন্য নিয়মিত জোগান দেওয়ার দায়িত্ব আমি নিজে থেকেই নিয়ে নিই। দু-একটা বই বেশি ভালো লেগে গেলে আম্মাকে তার গল্প শোনাই।

এখন নিয়মের বেড়াজালে আটকে যাওয়া আমরা ‘আম্মানির্ভর’। বাচ্চাদের নিয়ে অফিস করার উপায় থাকে না বলে আম্মার কাছেই আমাদের অসহায় আত্মসমর্পণ। ফলে আম্মার এখন আর গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয় না। আমাদের সংসার সচল রাখতে আম্মার ছুটির দরখাস্ত আমরা নামঞ্জুর করতে থাকি নিয়মিত। আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রতি রাতে বায়না করে নানুর কাছে গল্প শোনার। আম্মাও তাঁর ছোটবেলার রঙিন সময়গুলো ভাগ করে নেন ওদের সঙ্গে। প্রায়ই নস্টালজিক হয়ে পড়েন গল্প বলতে বলতে। বাড়ি যেতে না পারলেও, মাটির টান, তাঁর ছোটবেলা তাঁকে তাড়িত করে। বারবার সেই সময়ে ফিরে যেতে চেয়ে অবশেষে সেহেলী হক (আম্মা) তাঁর আত্মজৈবনিক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন—বিহ্বল মাটির সুবাস। দাঁড়কাক প্রকাশনা থেকে বইটি বের হয়েছে ৯ ডিসেম্বর। প্রকাশনা-প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে পেরে আমি গর্বিত। আম্মার লেখালেখি অব্যাহত থাকুক—এই প্রার্থনা সব সময়।