স্বামী সব জেনে গেলে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিই

অধ্যাপক মেহতাব খানম
অধ্যাপক মেহতাব খানম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা

অল্প বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু দুজনের চিন্তাভাবনার অনেক অমিল হওয়ায় ভুল-বোঝাবুঝি শুরু হয়। একসময় সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ে। সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ভাগাভাগি করি। সে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অনেক পরামর্শ দেয়। দিনে দিনে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। এ দিকে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিই।

এই সিদ্ধান্তটা বন্ধুটি জানার পর আমাকে ভালোবাসার কথা জানায়। একপর্যায়ে আমিও তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। এসব আমার স্বামী জেনে যায়। তখন বিবাহবিচ্ছেদের কথা বলি। সিদ্ধান্ত শুনে সে প্রথমে রাগারাগি করলেও পরে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যায়, আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। সবকিছু বিবেচনা করে আমি বিচ্ছেদের চিন্তা বাদ দিয়ে বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই।

ধীরে ধীরে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। আমার প্রতি তার ভালোবাসা বাড়ে। কিন্তু এখন আমি হতাশায় ডুবে যাচ্ছি। নিজের পেশা, সন্তান, সংসার—কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছি না। বন্ধুর কথা মনে পড়ে বারবার। সে-ও মাঝেমধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করে। আমি কীভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক


পরামর্শ

তোমার বর্তমান মানসিক অবস্থার কারণে শুধু তুমি নও, সম্পূর্ণ পরিবারই বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। মনে হচ্ছে তুমি তোমার স্বামীকে আত্মহত্যার উদ্যোগ নিতে দেখে নিজের সেই সময়ের আবেগকে আর গুরুত্ব দিতে পারোনি। হয়তোবা নিজেকে অপরাধী মনে করেছ এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার জন্য। দ্রুত তাই যৌক্তিক সত্তাকে সক্রিয় করে তুমি বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছ। সে সময়ের জন্য তোমার সিদ্ধান্তটি পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সহায়তা করেছে।

তবে আমাদের অবচেতন মন যখন আবেগীয়ভাবে কারও সঙ্গে মানসিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, তখন পরবর্তী সময়ে যৌক্তিক সত্তার সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়। যৌক্তিক ও আবেগীয় সত্তার মধ্যে একটি গৃহযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়। এর আগেও যৌক্তিক সত্তাটি হার মেনেছিল যখন তুমি বন্ধুর প্রস্তাব প্রথমে ফিরিয়ে দেওয়ার পর আবার তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছিলে। 

এখন তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক আগের তুলনায় ভালো। তোমার প্রতি স্বামীর ভালোবাসাও বেড়েছে। তা সত্ত্বেও বন্ধুর কথা মনে পড়ছে বলে তুমি হয়তো নিজের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ছ। এ ক্ষেত্রে অজান্তেই ভুল হয়েছে। ভুল হলো বিপরীত লিঙ্গের একজন বন্ধুর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের হতাশাগুলো ক্রমাগত জানানো এবং সম্পর্ক উন্নয়নে পরামর্শ দিতে গিয়ে বন্ধুরও উচিত তোমাকে প্রচুর সময় দেওয়া।

এতে উল্টো ব্যাপারটি ঘটে গেল। পরিশেষে তুমি বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের দিকে চলে গেলে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত মানুষ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে আমরা যখন নিভৃত জীবনের খুঁটিনাটি প্রতিনিয়ত আলোচনা করি, তখন সম্পর্কের সীমারেখাটি লঙ্ঘিত হয়। মনের অজান্তেই প্রচণ্ড নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। সে কারণে প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলররা শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা রেখেই একটি পেশাগত সীমারেখা রক্ষা করে নৈতিক দিকগুলো অনুসরণ করে ক্লায়েন্টের জীবনের জটিল সম্পর্ক নিয়ে দক্ষভাবে কাজ করেন। এ বিষয়ে দক্ষ নন এমন কোনো বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যাগুলো প্রযুক্তির মাধ্যমে শেয়ার করতে গিয়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এতে সেই দুটো মানুষই নয়, তাদের খুব কাছের মানুষেরাও তীব্র কষ্টের মধ্যে পড়ে যায়।

বন্ধুত্বের বা প্রেমের সম্পর্ক এবং বিয়ের পরের সম্পর্কটি একেবারে ভিন্ন। বিয়ের পর অনেক বাস্তবতা সামনে চলে আসার ফলে আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তোমার স্বামীকে জীবনসঙ্গী করার ফলে সেই ব্যাপারটিই ঘটেছে। এখন আবার বন্ধুটির প্রতি ভালোবাসা তোমাকে হাতছানি দিচ্ছে ঠিকই, তবে পরবর্তী সময়ে ওকে বিয়ে করলে তোমাদের পারস্পরিক অনুভূতিগুলো একই রকম না-ও থাকতে পারে। বিশেষ করে তোমার যেহেতু একটি অতীত রয়েছে, সেটি নতুন সম্পর্কটিকে সুন্দরভাবে সামনে নিয়ে যেতে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। এখনো যদি তুমি কিছুদিন দুজনের কাছ থেকেই সম্পূর্ণ আলাদা করে নিজের সঙ্গে কথোপকথন করতে পারো, তাহলে ভালো হয়। একটি নোটবুকে লিখতে পারো বর্তমান বিবাহিত জীবনটি রাখলে তোমার কী কী সুবিধা ও অসুবিধা হচ্ছে এবং বন্ধুটির সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কে গেলে কী কী সুবিধা ও অসুবিধা হতে পারে। জীবনের বাস্তবতাগুলোকে মাথায় রেখে কাজটি করতে পারলে খুব ভালো হয়। হয়তো এ থেকে একটি উত্তর তুমি পেয়ে যাবে।