প্রাণের বন্ধুরা অতীত হয় না

এক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে অনেকগুলো বন্ধুর প্রাণ। মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁদের স্মরণ করেছেন সিলেটের জালালাবাদ রাগীব–রাবেয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
এক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে অনেকগুলো বন্ধুর প্রাণ। মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁদের স্মরণ করেছেন সিলেটের জালালাবাদ রাগীব–রাবেয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
>নেপালের কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস বাংলার উড়োজাহাজটির যাত্রী ছিলেন সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ১৩ নেপালি শিক্ষার্থী। মারা গেছেন ১১ জন। মেডিকেল জীবনের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ করে ছুটিতে তাঁরা বাড়ি ফিরছিলেন। বন্ধুদের স্মরণ করে লিখেছেন তাঁদের সহপাঠী, রাগীব-রাবেয়া মেডিকেলের ১৯ তম ব্যাচের ছাত্র তীর্থ তাপস সাহা রায়

সাল, ২০১৩। নেপালের ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, কাঠমান্ডু।

অনেক গল্পের আর বন্ধুত্বের শুরু এখানেই। এখানে এসেই পরিচয় হয় কয়েকজন সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ স্বপ্নচারীর। বাবা-মায়ের আঁচলের ছায়া ছেড়ে পরদেশে পাড়ি, অনেকের জন্য হয়তো প্রথমবারের মতো এত কাছ থেকে বিমান দেখা...

তাদের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ক্লাসে। সদ্য বুলি শেখা শিশুর মতো আধো আধো বাংলায় আর ইংরেজি-হিন্দির অদ্ভুত মিশ্রণে শুরু হয় কথোপকথন! কখনো কি মনে হয়েছিল, তারা বিদেশি? রীতিনীতি অনেক বেশিই আলাদা? উহুঁ, একদমই না।
মাসখানেকের মধ্যে সিলেটি ভাষাও পুরোদস্তুর রপ্ত করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল আমাদের। মানুষ হিসেবে তো বটেই, বন্ধু হিসেবেও ওরা অতুলনীয়। প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ...ক্যালেন্ডারের পাতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে আরও।

চারু বড়াল, আমার প্রথম নেপালি বন্ধু। অন্য রকম একটা জীবনীশক্তি ছিল মেয়েটার মধ্যে। হাসি ছাড়া কখনো একটি কথাও বলেছে কি না, মনে পড়ে না। তার সেই স্নিগ্ধ, সহজিয়া চাহনিতে মাঝেমধ্যে মনে হতো-দেশ থেকে এত দূরে থাকার কষ্টটা আড়াল করে নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকতে ও কীভাবে পারে? আমাদের প্রথম পরিচয়ের সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেমন লাগছে বাংলাদেশ?’ মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, ‘আচে থোরা আমার দেশের মতো। কিন্তু আমার মা তো আর এখানে নেই, তাই ইকদিন শেষ করে চলে তো যানা হ্যায়!’

আলজিনা বড়াল, প্রচণ্ড রকমের উদ্যমী, মেধাবী ছাত্রী! ক্লাসের প্রথম বেঞ্চ তার দখল করা লাগবেই, যেভাবে হোক। তার সঙ্গে এক দিনের আলাপে বললাম, ‘কেন এত কষ্ট করছ?’ জবাবে শুনতে পাই তার দৃঢ় কণ্ঠ, ‘তোমাদের তো চিন্তা নাই, আমাকে তো ফিরভি দেশে যেতে হবে, নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। ইছাড়া কীভাবে আমি ডাক্তার হব?’

সঞ্জয় পৌডেল, একহারা গড়নের রোগা ছেলেটাকে দেখে কেউ কখনোই বলবে না সে পুরো ফুটবল মাঠে কর্তৃত্ব করে বেড়ায়! ক্লাস শেষে বিকেল হলেই বুট জুতা হাতে ঝুলিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠের দিকে হেঁটে যেত, আর হঠাৎ রাস্তায় দেখা হলেই একগাল হেসে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলত, ‘এইইই বন্দু, চলো না যাই খেলে আসি।’

হাসতে অসম্ভব পছন্দ করে যে মেয়েটি, তার নাম সারুণা শ্রেষ্ঠা। সারাক্ষণ ভাবত, কখন বাসায় ফিরবে! মেডিকেলের পড়ার চাপে ছটফটে মেয়েটার বাড়িতে ফেরার সুযোগ হয়নি গত দুই বছর। একবারে পরীক্ষা শেষ করে নিশ্চিন্তে বাড়িতে গেলে কয়েক মাসের টানা শান্তি, এটাই হয়তো মাথায় ছিল। সব সময় বলত, ‘এবার নেপাল গেলি আমাকে আর কেউ ফেরাতে পারবে না।’

সঞ্জয় মহারজন ছিল সারুণার উল্টো, খুব শান্ত একটা ছেলে। গত পাঁচ বছরে পড়ার সময়ে লাইব্রেরির একটা নির্দিষ্ট কোণ ছাড়া তাকে আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এমন একরোখা সৈনিকের মতো পড়ত, পড়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাটাই বোধ হয় শুধু বাকি রেখেছিল। চশমার পেছনে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দিয়ে অনায়াসে মানুষকে আপন করে নিত মিলি মহারজন। কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থাপক দরকার, অথচ মিলি নেই? তার মানে আমাদের মাথায় হাত। নেপালি আর ইংরেজি ভাষার জগাখিচুড়ি দিয়ে কীভাবে কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়, সেটা মিলিই জানত সবচেয়ে ভালো। আর অঞ্জিলা শ্রেষ্ঠা জানত কীভাবে পরিশ্রম করতে হয়। হিমালয়ের দেশের মানুষগুলো যে আমাদের চেয়ে বেশি পরিশ্রমী, সেটা প্রমাণের জন্যই হয়তো ক্লাস শেষে আমরা যখন ক্লান্ত হয়ে হোস্টেলের দিকে যেতাম, বই-খাতা নিয়ে অঞ্জিলা ছুটত লাইব্রেরিতে। মাঝে সন্ধ্যায় দুই কাপ কফি। তারপর আবার সেই মুখ বুজে মেডিকেলের বিদঘুটে সব শব্দের সঙ্গে পায়চারি শুরু...

নিগা মহারজনের নাচ ছিল অনবদ্য। ক্যাম্পাসের যেকোনো অনুষ্ঠানে ওর কোরিওগ্রাফি থাকবেই। কিন্তু রাত পোহালেই মোটা, গোল চশমাটা চোখে দিয়ে হাজির ক্লাসের ৪ নম্বর বেঞ্চের শেষ মাথায়। দেখে কেউ বুঝবেই না, আগের দিন সারাটা রাত কেটেছে নাচের মহড়ায়। শ্বেতা থাপা আবার অতটা সরব ছিল না। চুপচাপ নিজের মধ্যে থাকাই তার পছন্দের কাজ! কারও সাতে-পাঁচে নেই। ফাইনাল প্রফ পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় কথায় কথায় বলছিলাম, ‘এত তাড়াহুড়া করছ কেন? পরীক্ষার তো এখনো অনেক দূর।’ উত্তর পাই, ‘আমার বাসা থেকেও কি দূরে?’

পড়ালেখায় ‘সিরিয়াস’ ছিল পূর্ণিমা লোহানীও। মৃদুভাষী মেয়েটা চুপচাপ পড়ত আর ফিসফিস করে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলত। আশনা শাক্যের কথা শুনতাম মুগ্ধ হয়ে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় যখন রোগীদের সঙ্গে কথা বলত, কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝত না সে বিদেশি। খুব সাবলীলভাবে সবাইকে আপন করে নিত।

সামিরা ব্যঞ্জনকার নিজের দুনিয়ায় থাকত। আবার পড়ার কথা মনে পড়ে গেলে পাগলামি, উদাসীনতা ভুলে ছুটত পড়ার টেবিলে। আজ যে সামিরা ফ্র্যাকচার নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় একা একা শুয়ে আছে, তাকে অচেনা লাগে। ছুটি পেলেই মা-বাবাকে নিয়ে দেশ-বিদেশ বেড়াতে যেত যেই প্রিন্সি ধামি, সে এখন আইসিইউতে। অবাক লাগে, ও কি আমাদের প্রিন্সি? আমাদের কলেজের তুখোড় ছাত্রী সেই প্রিন্সি?

পাঁচ বছরে গুটিকতক দিনই তো ওরা কাটিয়েছে পরিবারের সঙ্গে। আর বাকি সময়টুকু? একই ছাদের নিচে হাজারটা রাত কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে আমরা ছিলাম একসঙ্গে। আমরা ‘আমরা’ হয়েই ছিলাম, কখনো মনে হয়নি ওরা আলাদা। এই করিডোর দিয়ে যখন হেঁটে যাই প্রতিদিন, সেই একই লিফট, সেই এক লেকচার গ্যালারি; যেন তাদের হাসি কানে আসে।

মার্চ ১২, ২০১৮। এই দিনটা কেন আমাদের জীবনে আসতেই হলো? ফাইনাল প্রফ পরীক্ষার ধকল না কাটতেই ওরা ছুটে গিয়েছিল মায়ের কোলে। বাবার কাছে একটু আবদার, ভাইয়ের সঙ্গে একটু খুনসুটি...কত দিন পর!

এভাবে কেন তাদের চলে যেতে হবে? এত বছরের কষ্টের ফলটাও যে জানা হলো না।

হয় না, প্রাণের বন্ধুরা কখনো অতীত হয় না। তোরা আমাদের প্রতিটা ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মিশে আছিস বন্ধু। ওই পোড়া বিমানটার দিকে আরেকবার তাকানোর মতো মানসিক শক্তি আমাদের নেই। যখন প্লেনটা ল্যান্ড করছিল, কতটা আকুতি নিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলি? কাচের দেয়ালের ওপাশেই তো সবাই। আর মাত্র মিনিট পাঁচেকের অপেক্ষা...

ক্ষমা করিস বন্ধু। যখন সবচেয়ে বড় যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিলি, তখন পাশে থাকতে পারিনি। বলা হয়নি, ‘আজ আমাদের দিন নয়, আজ আমরা যাব না।’