মুজিবনগরের জীবন্ত চার কিংবদন্তি

লিয়াকত আলী, আজিম উদ্দিন শেখ, সিরাজ উদ্দিন, হামিদুল হক
লিয়াকত আলী, আজিম উদ্দিন শেখ, সিরাজ উদ্দিন, হামিদুল হক

যে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়েছিল, সেই গাছটি মারা গেছে। সৈয়দ নজরুল ইসলামও আজ আর নেই। তবে যাঁরা তাঁকে গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন, তাঁদের চারজন আজও বেঁচে রয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গার্ড অব অনার দেওয়ার সেই ঘটনা তাঁদের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল।

আনসার বাহিনীর ১২ জন সদস্য সেদিন গার্ড অব অনার দিয়ে যে শুধু বিরল ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ৮ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা দিনক্ষণসহ সেদিনের ইতিহাস মুখস্থ বলে দিতে পারেন। প্রতিবছরের ১৭ এপ্রিল তাঁদের ডাক পড়ে। ৭০-৮০ বছর বয়সেও তাঁরা আগের মতো আনসার বাহিনীর পোশাক পরে রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সামনে এসে দাঁড়ান। বৈদ্যনাথ বাবুর আম্রকাননে তখন যেন জীবন্ত ইতিহাস কথা বলে ওঠে।

মেহেরপুর জেলার ঐতিহাসিক এই আম্রকানন ঘিরে এখন মুজিবনগর কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। একটি ফলকে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, ‘অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান’।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্মাননা পেয়েছেন সিরাজ উদ্দিন (ডানে) ও লিয়াকত আলী। ছবি: সংগৃহীত
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্মাননা পেয়েছেন সিরাজ উদ্দিন (ডানে) ও লিয়াকত আলী। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি মুজিবনগর কমপ্লেক্সে ঢুকতেই ভবনের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল। ছবিতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদানকারী একজন আনসার সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পদক নিতে দেখা যাচ্ছে। মনে হলো, আহা! এই লোকটি যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে ছুঁয়ে দেখতাম। ছবির দিকে অপলক চেয়ে থাকতে দেখে পাশ থেকে একজন ভ্যানচালক বলে উঠলেন, ‘উনি কিন্তু এখনো বেঁচে আছেন। আপনি গেলে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি।’

ভ্যানচালক যুবকের নাম মোহাম্মদ আলী। মুজিবনগর কমপ্লেক্সের সব ইতিহাস তাঁর মুখস্থ। তিনি বললেন, ‘শুধু একজন না, গার্ড অব অনার দেওয়া চারজন বেঁচে আছেন।’

চেপে বসলাম মোহাম্মদ আলীর ভ্যানে। ১০ মিনিটের মধ্যে ভ্যানচালক ছবির মানুষটির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে নামালেন। তাঁর নাম আজিম উদ্দিন শেখ। পথে পাওয়া গেল সিরাজ উদ্দিনকে। তাঁকে সঙ্গে করে লিয়াকত আলীর বাড়িতে যাওয়া হলো। এই তিনজনের বাড়ি মুজিবনগরের ভবেরপাড়া গ্রামে। কিন্তু বেলা পড়ে আসার কারণে শুধু হামিদুল হকের বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হলো না। তাঁর বাড়ি পাশের সোনাপুর গ্রামে। পরে ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়।

মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেওয়া হচ্ছে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১
মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেওয়া হচ্ছে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১

লিয়াকত আলী ও আজিম উদ্দিন শেখের বয়স এখন প্রায় ৮২ বছর। অন্য দুজনের বয়স ৭০-এর বেশি। তাঁরা পড়াশোনা করেছেন ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। ১৯৭১ সালে সবাই মাঠে কাজ করতেন।

আজিম উদ্দিন কথাবার্তায় বেশ চটপটে। শরীরস্বাস্থ্য এখনো বেশ। ১৭ এপ্রিল ১২ জন ছিলেন গার্ড অব অনারে। গড়গড় করে ১২ জন আনসার সদস্যের নাম বলে গেলেন তিনি। সেই সময়ের কথা শোনানো শুরু করলেন: ‘তখন আমার বয়স ৩৬-৩৭ বছর। একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার সদস্য ছিলাম। তখন তো আনসার সদস্যরা সরকারি ছিল না। তাই পাশাপাশি বাড়িতে কৃষিকাজ করতাম।’

আজিম উদ্দিনের মনে আছে, তিনি পিরোজপুরে (তৎকালীন মহকুমা) সত্তরের নির্বাচনে ‘ডিউটি’ করতে গিয়েছিলেন। এরপর বাড়িতে ফিরে আসেন। তিনি বললেন, ‘তখন এখানে (মুজিবনগর) ডাকবাংলো হয়েছে। সেখানে ইপিআর ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পের ইপিআর সদস্য ইউনুস আলীর সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। তাঁর সঙ্গে ফুটবল ও কাবাডি খেলতাম। প্রতিদিন সকালে ইপিআর ক্যাম্পে চা খেতে যেতাম। এদিকে কুষ্টিয়ায় প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। ২৬ মার্চ সকালে ক্যাম্পে গেলাম।’ তখন ইউনুস আলী আজিম উদ্দিনকে বলেন, ‘ভাই, আপনাকে আমি আজ আর চা দেব না। গ্রামের ভেতরে গিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার সদস্য পান কি না দেখুন। পেলে ডেকে নিয়ে আসেন। আপনার দায়িত্বে এই ক্যাম্প ছেড়ে দিয়ে আমরা কুষ্টিয়ায় চলে যাব।’

আজিম উদ্দিন বললেন, ‘আমি গ্রামের ভেতর থেকে ১২ জন আনসার সদস্য ডেকে নিয়ে ক্যাম্পে যাই। আমাদের দায়িত্বে মালামাল রেখে ইপিআর সদস্যরা চলে গেলেন।

‘ভারত থেকে সেই ক্যাম্পে চাল-ডাল, হাঁড়ি-পাতিল, অস্ত্রসহ মালামাল আসতে লাগল। তখন এখানকার মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) ছিলেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা। তাঁর নামেই ভারত থেকে মালামাল আসত। আমরা বিলি করতাম। ১৬ এপ্রিল বিকেলে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ক্যাম্পে এলেন। সঙ্গে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। সন্ধ্যার সময় ক্যাম্পের পেছন দরজা দিয়ে বাগানের ভেতরে গার্ড অব অনার দেওয়ার ব্যবস্থা ঠিক করে এলেন। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কাছে ডেকে বললেন, “কাল এখানে কিছু মেহমান আসবে। তোমরা তৈরি থেকো।” তিনি বাগানের ভেতরে ঠিক করা জায়গায় (এখন যেখানে লাল রঙের বেদি তৈরি করা হয়েছে) একটি মঞ্চ বানাতে বললেন।

মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ভাস্কর্যে—গার্ড অব অনার
মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ভাস্কর্যে—গার্ড অব অনার

‘আজিম উদ্দিনরা সে সময় গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির লোকদের নিয়ে বিভিন্ন বাড়ি থেকে কাঠের তক্তা এনে একটি মঞ্চ তৈরি করলেন তাঁরা। রাত থেকেই শাঁ শাঁ শব্দ হতে লাগল। আমরা বুঝতে পারিনি, সাধারণ পোশাকে ভারত থেকে এত সৈন্য আসছে। আর কত যে বিদেশি সাংবাদিক!’

আজিম উদ্দিন বলে যান, ‘১৭ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে সবাই এসে হাজির হলেন। কমান্ড করার জন্য আমাদের পিসি (প্লাটুন কমান্ডার) ইয়াদ আলী প্রস্তুত হয়েছিলেন। এ সময় পুলিশ সুপার (এসপি) মাহাবুব এলেন। তিনিই কমান্ড করলেন। আমরা সালাম দিলাম। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সালাম নিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সব যার যার জায়গায় চলে গেলাম। তাঁরাও চলে গেলেন। এর প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি বিমান বাগানের ওপরে চক্কর দিতে লাগল। কিন্তু তখন বাগানের গাছ এত ঘন ছিল যে ওপর থেকে বোঝার উপায় ছিল না, কোথায় কী হচ্ছে। এর দুই–তিন দিন পরে আমরা ভারতে চলে যাই। পরে ৮ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ শুরু করি।’

এই চার আনসার সদস্যের ভাষায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাঁদের কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। একটি পত্রিকায় লেখালেখি হওয়ার পর আনসার সদর দপ্তর থেকে তাঁদের খোঁজ করা হয়। সরকার তাঁদের দুই ঘরের আধা পাকা বাড়ি করে দিয়েছে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে প্রত্যেককে ২ লাখ টাকা দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পান। এখন ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে ডাক পড়ে। তাঁরা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাত থেকে সম্মাননা নিয়েছেন।

চারজনের মধ্যে লিয়াকত আলী এখন ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। অন্য তিনজন মোটামুটি চলাফেরা করতে পারেন। সবার বাড়িতেই গার্ড অব অনার প্রদানের সেই ছবি টাঙানো রয়েছে। সাজানো রয়েছে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া পদক। লিয়াকত আলীর বাড়িতে একটি ছবিতে দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে এই চারজন আনসার সদস্য সম্মাননা গ্রহণ করছেন। 

মুজিবনগর কমপ্লেক্সে যে ভাস্কর্য বানানো হয়েছে, সেখানে ৮ জন আনসার সদস্য রয়েছেন বলে জানালেন সিরাজ উদ্দিন। তাঁদের দাবি, নকশা পাল্টে নামসহ তাঁদের ১২ জনের ভাস্কর্য করতে হবে।

১২ জনের যে ৮ জন মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে ইয়াদ আলীর বাড়ি মেহেরপুরের বাড়াডি গ্রামে। সেখানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে। সাহেব আলীকে তাঁর নিজ গ্রাম সোনাপুরে কবর দেওয়া হয়েছে। অন্য ৬ জনকে মুজিবনগর সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ভবেরপাড়ার কেসমত আলী, মফিজ উদ্দিন, অস্থির মল্লিক, ফকির মোহাম্মদ, নজরুল ইসলাম ও মহিউদ্দিন। মুজিবনগরের জীবন্ত কিংবদন্তিদের সঙ্গে কথা বলে ফেরার সময় এই কবরস্থানের পাশে দাঁড়ালাম। নীরব থেকে শ্রদ্ধা জানালাম।