প্রতিভার প্রকাশ বাল্মীকিপ্রতিভায়

শিল্পকলার মঞ্চে সানিডেল স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা
শিল্পকলার মঞ্চে সানিডেল স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা

‘আপু, খেয়াল করেছেন? ডান দিকের ছোট ডাকাতটা আমার মেয়ে!’ দর্শকসারিতে বসে এভাবেই নিজের মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন এক অভিভাবক। গত সোমবার। সেদিন সন্ধ্যায় সানিডেল স্কুলের (মিডল সেকশন ১) শিক্ষার্থীরা শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চস্থ করেছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিনাট্য বাল্মীকিপ্রতিভা

গীতিনাট্যের অভিনয়শিল্পীরা সবাই দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মঞ্চ প্রস্তুত। হলরুম কানায় কানায় পরিপূর্ণ। অভিভাবকদের মধ্যে আনন্দ মিশ্রিত অস্থিরতা। না জানি মেয়ে কেমন করবে! আলো-আঁধারিতে মনে হলো, মঞ্চে গুটি গুটি পায়ে একটা পুতুল এসে দাঁড়াল। একটু পর বোঝা গেল, পুতুল নয়, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেটার নাম মীর ফারিয়ান মেহবুব। শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে, তার সাবলীল উপস্থাপনা শুরুতেই দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। যারা বলে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা ভালো বাংলা জানে না, ফারিয়ান মেহবুবের কথা শুনলে নিশ্চয়ই তাদের ধারণা বদলে যাবে। নাটক শেষে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামও বিশেষভাবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তার কাছ থেকে সুন্দর বাংলা উচ্চারণ শেখার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।

প্রধান অতিথি ও সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শুরুতে প্রদীপ প্রজ্বালন করেন সানিডেল স্কুলের অধ্যক্ষ তাজিন আহমেদ। নাটক শুরুর আগে প্রথমে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় নাটকের সারমর্ম জানিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র ২০ বছর বয়সে বাল্মীকিপ্রতিভা লেখেন। ১৮৮১ সালে রচিত ও অভিনীত হয় প্রথম নিরীক্ষাধর্মী গীতিনাট্য বাল্মীকিপ্রতিভা। সেখানে নিজের লেখা কোনো নাটকের চরিত্রেও প্রথম অভিনয় করেন কবি নিজে।

মোটামুটি বড় পরিসরে গীতিনাট্যটি সাজানো হয়েছিল। অভিনয় করেছে মোট ৩৪ জন শিক্ষার্থী। পর্দার পেছনে কণ্ঠসংগীতে ছিল আরও ২২ জন। এত শিক্ষার্থীকে নিয়ে অনুশীলন করা নিশ্চয়ই কঠিন কাজ ছিল? প্রশ্নের উত্তরে এই আয়োজনের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক, উপাধ্যক্ষ জেবুন্নেসা মাহ্‌মুদ বললেন, ‘কঠিন তো ছিলই। তবে বাচ্চাদের উৎসাহ সবকিছু সহজ করে দিয়েছে। পরিশ্রম করতে ওরা কোনো কার্পণ্য করেনি। শিক্ষার্থীসহ সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে।’

পরিশ্রমের ফল দর্শকেরা দেখেছেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। দস্যু রাজার দশাসই চলাফেরা এবং সাগরেদকে ফুঁ দেওয়া দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছে সবাই। দৈবক্রমে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যদি হাজির হতেন, হয়তো এই বাচ্চাদের পরিবেশনা দেখে এদের নিয়েই একটা গল্প বা ছড়া লিখে ফেলতেন! দস্যুদল ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ছোট্ট বালিকাটির যে অসহায় চাহনি, সেদিন শিল্পকলায় হাজির হওয়া দর্শকদের মতো রবীন্দ্রনাথের চোখেও হয়তো এই দৃশ্যটা লেগে থাকত।

শিক্ষার্থীরা একটি মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা উপহার দিয়েছে উল্লেখ করে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘আমি অভিভূত। চমৎকার পরিবেশনা। সানিডেলের শিক্ষার্থীরা এত সুন্দর বাংলা বলে। চিত্তাকর্ষক। একসময় ইংলিশ মিডিয়ামে উন্নাসিকতা ছিল। বাংলাকে গুরুত্বই দেওয়া হতো না। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এখন আর তা নেই। সানিডেলের পরিবেশনা এ ধারণা আরও পাকাপোক্ত করল।’

সমাপনী বক্তব্যে অধ্যক্ষ তাজিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা চ্যালেঞ্জটা জয় করেছি।’ প্রতিটি ঋতুতেই সানিডেলে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সব সময় শিক্ষার্থীদের এ দেশের সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে চেষ্টা করি। মমত্ববোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। দিন শেষে আমরা সবাই বাঙালি। বাংলাকে ভালোবাসি।’ জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। আর শেষ হওয়ামাত্রই পর্দার পেছন থেকে শোনা যায় শিক্ষার্থীদের উল্লাস।