চেঙ্গিস খানের দেশে

পার্লামেন্ট স্কয়ারে দেখা মিলল এই ভাস্কর্যের।  ছবি: লেখক
পার্লামেন্ট স্কয়ারে দেখা মিলল এই ভাস্কর্যের। ছবি: লেখক

হঠাৎ করেই আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে আন্তর্জাতিক এক আলোচনা সভায় অংশ নেওয়ার। ই-মেইল পেয়ে প্রথমে চেঙ্গিস খানের নামটাই ভেসে উঠল; কানে যেন বাজতে থাকল ঘোড়ার পায়ের খটখট আওয়াজ। ছোটবেলা থেকে যে কত পড়েছি চেঙ্গিস খানের কথা! ঘোড়সওয়ারসমৃদ্ধ দুর্ধর্ষ বাহিনী কীভাবে বড় একটা সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল, এমনকি এই উপমহাদেশেও চেঙ্গিস খানের নামে কাঁপতেন সব রাজা। সেই চেঙ্গিস খানের দেশে যাওয়ার আলাদা একটা উত্তেজনা তো আছেই। সে উত্তেজনা চেপে উড়াল দিয়েছিলাম গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। তিন দিনের সফর। স্বল্প সময়ে একটা শহর বা দেশের আর কতটুকু বোঝা যায়। হয়তো সাত অন্ধের হাতি দেখার মতোই আমার এই চেঙ্গিস খানের দেশ দেখা।

রাজাদের রাজা

বিমানবন্দরে নেমেই বোঝা গেল, মঙ্গোলীয়দের আসল নায়ক আসলে চেঙ্গিস খানই। তাঁর নামেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি। সংসদ ভবনের সামনেও তাঁরই মূর্তি। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁর প্রতিকৃতি। নগরীর বড় হোটেলটা তাঁর নামে, জাদুঘরেও তিনি—উলানবাটোরজুড়েই যেন তাঁর সরব উপস্থিতি। ইতিহাসও সাক্ষী যে চেঙ্গিস খানই হলেন রাজাদের রাজা—আসল মহারাজ।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১২০৬ সালে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন মঙ্গোলিয়ার সাম্রাজ্যের। সেই সাম্রাজ্য কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভূমি-সংযুক্ত সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলাই খান তো চীনের প্রাচীর পেরিয়ে চীনও দখল করে নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইয়ুয়ান শাসনের। তাঁর মৃত্যুর পর এই শাসনের পতন ঘটে। তখন অবশ্য চীন ছেড়ে মঙ্গোলীয়রা নিজের দেশে ফিরতে বাধ্য হন। চেঙ্গিস খানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তিনি মঙ্গোলীয় সব গোত্রকে সংঘবদ্ধ এবং একত্র করতে পেরেছিলেন। তাঁর তৈরি যোদ্ধারা ছিলেন সাহসী ও শক্তিশালী। তাঁর সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ছোট ইউনিট ছিল ১০ সদস্যের। ১০টি ছোট দল মিলে গঠিত হতো মাঝারি ইউনিট। আর ১০টি মাঝারি ইউনিট (১০,০০০ জন) নিয়ে গঠিত হতো সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ইউনিটটি। এই ডেসিম্যাল পদ্ধতি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যজুড়ে। ‘নোমাড’ সংস্কৃতির সঙ্গে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে যায় এর গঠনপদ্ধতি। এই সেনাবাহিনীর ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকত প্রতিবেশী সাম্রাজ্যগুলো। চেঙ্গিস খানের ঠিক সেই সাম্রাজ্য এখনো মঙ্গোলীয় জাতীয়তার ভিত্তি। আর বুদ্ধি ও অমিত সাহসের কারণে তিনি হয়েছেন সবার নেতা। উলানবাটোরের মঙ্গোলীয় আর্ট মিউজিয়ামের এক কর্নারে থাকা একটি লাইন যেন সত্যিই বর্ণনা করে তাদের নেতাকে ‘অল কিংস কিং, হেভেন্স সন—চেঙ্গিস খান।’

উট, ঘোড়া আর যানজট

মঙ্গোলিয়ান ‘নোমাড’ সংস্কৃতির সঙ্গে উট আর ঘোড়ার যোগাযোগ ওতপ্রোত। মঙ্গোলিয়ান উটের আবার বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমরা উপমহাদেশ বা আরবে যে উট দেখি তার কুঁজ কিন্তু একটা, কিন্তু মঙ্গোলিয়ান উটের কুঁজ দুটো। এমন উট এ অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও এখন দেখা যায় না। আর এই উটগুলো নাকি আরবের উটের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। এগুলোর শক্তি প্রায় একেকটা হাতির সমান। গোবি মরুভূমিতে মঙ্গোলিয়ানদের সবচেয়ে বড় সঙ্গী হলো এই উট। রাস্তার ধারে তাই দেখি উটের প্রতিকৃতি তৈরি করা। সেসব উট বহন করে চলেছে বড় বড় বাক্স।

মঙ্গোলীয় উটের যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা ভাস্কর্য দেখেও বোঝা গেল
মঙ্গোলীয় উটের যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা ভাস্কর্য দেখেও বোঝা গেল

আবার ঘোড়া ছাড়াও মঙ্গোলিয়াকে কল্পনা করা যায় না। এদের সাম্রাজ্য গঠনের মূল শক্তিই ছিল অশ্বারোহী যোদ্ধা। ঘোড়সওয়ার সেই বাহিনী ছুটে যেত হাজার হাজার মাইল। দখল করত রাজ্য, প্রতিষ্ঠা করত তাদের সাম্রাজ্য। মঙ্গোলীয় ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়ল উট আর ঘোড়া নিয়ে অনেক শিল্পকর্ম। এ দুটি প্রাণী যেন তাদের সংস্কৃতির মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় দেখি লাল পতাকাসহ হাতে আঁকা ভ্লাদিমির লেনিনের প্রতিকৃতি—যেন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্মৃতি বহন করছে এটি।

তবে উলানবাটোরে সত্যিকারের উট আর ঘোড়া চোখে না পড়লেও যানজটের অভিজ্ঞতা ঠিকই হলো। হোটেল থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে ন্যাশনাল একাডেমি ফর গভর্ন্যান্স ভবনে যেতে সকালে সময় লাগল ৫০ মিনিট। আর যানজট হবেই না বা কেন, দেশের ৩০ লাখ লোকের অর্ধেকই থাকে এই শহরে। শহরের আকার ঢাকার চেয়েও ছোট। সবাই গাড়ি নিয়ে বের হয় এবং সব চৌরাস্তায় জটলা। তবে ঢাকার অধিবাসী হিসেবে উলানবাটোরের যানজট আমার কাছে কিন্তু অসহনীয় লাগেনি, বরং জট নিয়ে বকবক করতে দেখলাম এই শহরের বাসিন্দাদের।

মঙ্গোলিয়ায় বাংলাদেশি

হ্যাঁ, মঙ্গোলিয়াতেও বাংলাদেশি আছেন। তবে সংখ্যায় অনেক কম; আঙুল গুনে হিসাব করা যায়। তাঁদের বেশির ভাগই মঙ্গোলিয়ান মেয়ে বিয়ে করে এ দেশে সংসারী হয়েছেন। এ রকম একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, তাঁর বউয়ের সঙ্গে পরিচয় কোরিয়ায়। ওখানে তিনি কাজ করতে গিয়েছিলেন। এরপর প্রেম ও বিয়ে। তারপর বউয়ের হাত ধরেই উলানবাটোরে আসা। এখন সামলাচ্ছেন বউয়ের ব্যবসা। বন্ধুত্ব হয়ে গেল মিন্টু নাথ নামের এক বাংলাদেশির সঙ্গে। তঁার বাড়ি চট্টগ্রামে। পুরোন ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করেছেন। এখন উলানবাটোরে একটি কলেজে হিসাববিজ্ঞান পড়ান।

সংগীতে বিষাদের সুর
আয়োজকদের কল্যাণে উপভোগ করা গেল ঐতিহ্যবাহী মঙ্গোলীয় সংগীত। লোকজ সংগীত শোনা হলো, শোনার সুযোগ মিলল তাদের বিখ্যাত ‘থ্রোট সং’। এই সংগীতে গলা থেকে নানা বিচিত্র ঝংকার বেরিয়ে আসে। গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল নানা বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার। অনেক সাধনার পর নিশ্চয়ই এই কৌশল আয়ত্ত করেছেন এই শিল্পীরা। পরে ইউটিউবে ঢুকে দেখি বেশ বিখ্যাত এই মিউজিক। তবে মঙ্গোলীয় সংগীতের টোনটা কিন্তু আমার কাছে বিষাদময় লাগল, তা কি বৈরী আবহাওয়ায় মানুষের নিরন্তর সংগ্রামের প্রতিফলন? মনে পড়ল ইংরেজ কবি জন কিটসের সেই বিখ্যাত কথাগুলো, ‘আমাদের সবচেয়ে মধুর গানগুলো বলে সবচেয়ে দুঃখের কথা।’

কুস্তির দেশে ক্রিকেট
অবাক হলাম জেনে যে মঙ্গোলীয়রাও ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে। যে দেশে দলীয় খেলা তেমন নেই বললেই চলে। খেলা বলতে এরা বোঝে কুস্তি আর তির নিক্ষেপ, সেই উলানবাটোরে এখন দুটি ক্রিকেট ক্লাব। এতে প্রথমে যোগ দিয়েছেন উপমহাদেশ থেকে আসা ভারতীয়, বাংলাদেশি আর পাকিস্তানি—সবাই। এখানকার অস্ট্রেলীয় দূতাবাস একজন কোচের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাঁর তত্ত্বাবধানে হাতেখড়ি হচ্ছে ক্রিকেটারদের। বেশ কয়েকটি স্কুলে ক্রিকেট খেলা চালু হয়েছে। আমার বন্ধু মিন্টু নাথও একটি ক্লাবে নিয়মিত ক্রিকেট খেলেন। তাঁদের ম্যাচ হয় প্রতি রোববার। গতবার হংকং থেকে একটি দল এসেছিল ক্রিকেট খেলতে। এবার মিন্টু নাথরা পরিকল্পনা করছেন হংকংয়ে খেলতে যাওয়ার। কে জানে কয়েক বছর পর আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে হয়তো দেখা যাবে মঙ্গোলিয়াকে খেলতে।

পার্লামেন্ট স্কয়ার
পার্লামেন্ট স্কয়ার

কাশ্মীরি উল

মিন্টু নাথকে বললাম, কী কেনা যায় যা মঙ্গোলিয়ার স্পেশাল। তিনি নিয়ে গেলেন গোবি কাশমের উলের শোরুমে। সেখানে ঢুকে তো আমার মাথা খারাপ, অসাধারণ সব উলের সমাহার। আমার এত দিনের ধারণা ছিল ‘পশমিনা’ হলো সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো উল। এদের কাশ্মীরি উল দেখে আমার মনে হলো, এগুলো তো পশমিনার চেয়ে ভালো বৈ মন্দ নয়। সূক্ষ্ম উলের সূক্ষ্ম কাজ। হাতে নিলে মনে হয় কোনো ওজনই নেই। আর এত নরম স্পর্শ যে হাতে নিলেই মন ভালো হয়ে যায়। অথচ ঠান্ডার সময় গা গরম করতে এগুলোর জুড়ি নেই। বিস্ময় হলো, এত পাতলা উল এত ওম দেয় কীভাবে! এই উল তৈরি হচ্ছে কোনোটা উটের পশম দিয়ে, আবার কোনোটা ভেড়ার পশম থেকে। শোরুমে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেই মন ভালো হয়ে গেল। বুঝলাম, ‘গোবি’ ব্র্যান্ড কেন এই ট্যাগলাইন করেছে, ‘ট্রিপ টু মঙ্গোলিয়া ইজ ইনকমপ্লিট উইদাউট গোবি কাশমের।’

শুরুতেই যা বলেছিলাম, দুই-তিন দিন একটি শহর চেনার জন্য যথেষ্ট সময় নয়। তারপরও এ কদিনেই উলানবাটোর আর মঙ্গোলিয়া নিয়ে অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা হলো। গোবি মরুভূমিতে ড্রাইভে যাওয়া বা ট্রান্স সাইবেরীয় রেলে ওঠার সুযোগ এর পরের ট্রিপের জন্য তুলে রাখলাম। তারপরও বলব, অভিজ্ঞতা যা হলো তা মধুর। আর মঙ্গোলীয়দের আতিথেয়তা সত্যি ভোলার নয়, এক দিনের চেনাশোনা যেন হাজার বছরের বন্ধুত্ব। উলানবাটোর শহরটাও যেন আমার সারা জীবনের বন্ধুই হয়ে গেল।