পড়তে চাই, পড়াতে চাই

এই তরুণ দলের হাত ধরেই এগিয়ে চলছে রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের কার্যক্রম। ছবি: সুমন ইউসুফ
এই তরুণ দলের হাত ধরেই এগিয়ে চলছে রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের কার্যক্রম। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘সিরিয়াস’ ধারার বইপত্র নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা করা এবং তরুণদের সাহিত্য সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করাই রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের কাজ। এ সংগঠনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা সবাই তরুণ—অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া, কেউ লেখাপড়া শেষ করে সবে ঢুকেছেন কর্মজীবনে। বিস্তারিত প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে

ব্যাপারখানা আজবই বটে। প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে যখন পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কিছু পড়তে চান না অনেকে, সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া একদল তরুণ গোগ্রাসে গিলছেন সাহিত্য আলোচনা। কেবল তা-ই নয়, বক্তাদের একের পর এক প্রশ্নে রীতিমতো জর্জরিত করে তুলছেন তাঁরা। প্রশ্নকর্তাদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউবা ঢাকার কোনো কলেজের। সবার প্রশ্নের মধ্যেই আছে অনুসন্ধিৎসার ছাপ। পাক্কা ঘণ্টা দেড়েকের ভাবগম্ভীর প্রশ্নোত্তরের পর আবার শুরু হলো গুরুগম্ভীর আলোচনা। শ্রোতারা তবুও নট-নড়নচড়ন। এটি ছিল রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মাসিক বক্তৃতার চিত্র। চর্মচক্ষুতে দেখেছিলাম বটে সেই মনোহর দৃশ্য।

ধীরে ধীরে এমন মনোহর ব্যাপার-স্যাপারই ঘটিয়ে চলেছে রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট। এটি তরুণদের পড়াশোনাভিত্তিক একটি সংগঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আশ্রয় করে যার বেড়ে ওঠা। ‘সিরিয়াস’ ধারার বইপত্র নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা করা এবং তরুণদের সাহিত্য সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করাই এর অন্যতম কায়কারবার। আর এ সংগঠনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের দর্শনও আলাদা। তাঁরা বলেন, ‘পড়ারও সুসংবদ্ধ একটি নিয়ম আছে। আমাদের মুখ্য বিষয় পড়ুয়া নয়, চাই পড়া।’

বক্তৃতা আয়োজনে হাজির হয়েছিলেন লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ। ছবি: সংগৃহীত
বক্তৃতা আয়োজনে হাজির হয়েছিলেন লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ। ছবি: সংগৃহীত

মানে কী এসব কথার?

মানে বোঝার জন্যই রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের আরও কাছাকাছি যাওয়া। প্রাথমিকভাবে এটুকু জানা ছিল যে, ‘সাপ্তাহিক লেকচার’ ও ‘মাসিক লেকচার’ নামে প্রায় নিয়মিতভাবে বক্তৃতার আয়োজন করে সংগঠনটি। এর মধ্যে এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সাপ্তাহিক লেকচার তিন শতাধিক এবং মাসিক লেকচার হয়েছে বিশটির বেশি। আর এই লেকচারগুলোতে যেমন রেহমান সোবহান, মুহাম্মদ ইউনূস, আকবর আলি খান, গোলাম মুরশিদ, মাহফুজ আনাম, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রমুখ অভিজ্ঞ মানুষেরা বক্তৃতা করেছেন, তেমনি এসেছেন তরুণেরাও।

গাউসুল আজম মার্কেটের ছোট্ট ঘর

‘গাউসুল আজম মার্কেটের ৬৭ নম্বর দোকান। চলে আসুন।’ রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের ইফতেখারুল ইসলাম ঠিকানাটি দিয়েছিলেন। সেই সূত্রে ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় তাঁদের দপ্তরে হানা দেওয়া গেল গত ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায়।

অপরিসর একটি ঘর। এখানে বসে আছেন সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা। সাকল্যে তাঁরা নয়জন। তবে সেদিন ছিলেন ছয়জন। বাকি তিন কর্তা জুলফিকার ইসলাম, মাশরুর শাকিল ও আতাউর রহমান উপস্থিত ছিলেন না তখন। তাঁদের অনেকে এখনো ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। কেউ লেখাপড়া শেষ করে সবেমাত্র ঢুকেছেন কর্মজীবনে। ‘আমি রাশেদ রাহম’, ‘আমি জামসেদুল ইসলাম’, ‘আশরাফুল ইসলাম’, ‘ইফতেখারুল ইসলাম’, ‘রাকিবুল হাসান’...এভাবে শেষে যিনি নিজের পরিচয় দিলেন, তাঁর নাম আরিফ খান। বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এ তরুণ আইনজীবীই ব্যতিক্রমী এই সংগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা।

ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক আহরার আহমেদের (বাঁ থেকে বসা) সঙ্গে রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের তরুণেরা
ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক আহরার আহমেদের (বাঁ থেকে বসা) সঙ্গে রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের তরুণেরা

পড়ুয়া নয়, চাই পড়া

: ‘আমাদের মুখ্য বিষয় পড়ুয়া বা রিডার নয়, প্রধান বিষয় হলো রিডিং বা পড়া।’ কথাটি বুঝিয়ে বলুন। আলাপের পয়লা আরিফ খানের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা।

: দেখুন, পড়ার আনন্দে পড়েন, এমন পাঠক অনেকই আছেন। আমরা শুধু পড়ার আনন্দে পড়তে চাই না, সমাজ-রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক দায় নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে পড়তে চাই। গভীর পাঠের জন্য একজন মানুষের ভেতরে যে দক্ষতা থাকা দরকার, সেই দক্ষতা তৈরিতে তাকে সহায়তা করতে চাই। তাই পাঠকের চেয়ে পড়াই আমাদের কাছে মুখ্য। আমাদের লক্ষ্য হলো, জ্ঞাননির্ভর সমাজ বিনির্মাণ।

যেভাবে স্বপ্নের শুরু

২০০২ সাল। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার চেমটি গ্রামের আরিফ খান ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। কিন্তু ভর্তির পরই বুঝতে পারলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য একজন ছাত্রের যে প্রজ্ঞা থাকা উচিত, তাঁর সেসবের ঘাটতি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরই এই ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি পূরণে অতঃপর নানা পাঠচক্রে ঘুরলেন তিনি। আশ মিটল না। একসময় দু-চারজন বন্ধুবান্ধব মিলে নিজেরাই একটি পাঠচক্র করলেন। বন্ধুদের অনাগ্রহে সেটিও বন্ধ হলো একদিন। কিন্তু আরিফ পড়া থামালেন না। তাঁর মনে তখন প্রশ্ন, সবাই তো নিছক পড়ার আনন্দে পড়ে। অগোছালোভাবে পড়ে। জ্ঞানচর্চার নিয়মতান্ত্রিকভাবে পড়ে কজন?

এর মধ্যে তাঁর স্নাতক শেষ হলো। ব্যারিস্টারি পড়তে আরিফ এবার গেলেন লন্ডনে। সেখানে গিয়েও ডুবে গেলেন বিচিত্র বইয়ের অনন্ত জগতে—নিউ ক্যাসল নর্থ আম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ও ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। ফলে ব্যারিস্টারি পাস করার ব্যাপারটি লাটে উঠল। অগত্যা ব্যারিস্টার না হয়েই তাঁর দেশে ফেরা, ২০১০ সালে।

সে সময় তিনি কেবল আইন ব্যবসায় হাতেখড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। এখানে আরিফের পরিচয় হলো ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া আরও কয়েকজন বইয়ে বুঁদ হওয়া মানুষের সঙ্গে। তিনি তাঁদের প্রশ্ন করলেন, আজ কত শব্দ পড়েছেন? প্রতি মিনিটে আপনার পড়ার গতি কত?

এমন প্রশ্ন শুনে তাঁদের তখন তাজ্জব অবস্থা, শব্দ গুনে পড়া আবার কী! তবে আরিফের এসব কথাবার্তায় তাঁর প্রতি আকর্ষণ বোধ করলেন ওই মানুষগুলো। নতুন স্বপ্নের পেছনে ছোটার সেই তো সূচনা।

রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের ওয়েবসাইটের প্রথম পাতা
রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের ওয়েবসাইটের প্রথম পাতা

শুরু হলো রিডিং ক্লাব

২০১১-তে বইয়ে বুঁদ হওয়া ওই কয়েকজনকে নিয়ে আরিফ গড়ে তুললেন বুক রিডিং ক্লাব। শুক্রবার বিকেলে তাঁরা মিলিত হতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকেই সাপ্তাহিক লেকচার শুরু করলেন তাঁরা। প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে শুরু হলো আড্ডা। আস্তে আস্তে বিস্তৃত হতে থাকল কার্যক্রম। ২০১৭ সালে এটি ট্রাস্টে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আসতে লাগলেন লেকচারগুলোতে। যাঁরা এসব লেকচার শুনতে আসেন, কিছুদিন পর দেখা যায়, তাঁরাই নতুন কোনো বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর যাঁরা পড়াশোনাকে সিরিয়াসভাবে নিচ্ছেন না, তাঁরা ঝরে যাচ্ছেন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সিরিয়াস পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করছে সংগঠনটি। বর্তমানে এই সংগঠনের পাশে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। সহায়তা করছে জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনও।

ক্লাবের আরেক প্রস্থ

রিডিং ক্লাবের নিয়মগুলো খুব মজার। অন্যান্য সংগঠনের মতো আলাদা করে কোনো সভ্য বা সদস্য নেই এখানে। জ্ঞানকে যিনি ব্রত হিসেবে নেবেন, তিনিই এ সংগঠনের সঙ্গে একাত্ম হতে পারবেন। তাঁদের মতে, একজন জ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তির প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ থেকে ১৩ ঘণ্টা পড়া প্রয়োজন। বই কীভাবে পড়তে হবে, তার ওপর বেশ কয়েকটি কর্মশালা করেছেন তাঁরা। সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দুষ্প্রাপ্য বই। তা ছাড়া গবেষণা শেখার জন্য তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ‘একাডেমিক ডিসিপ্লিন’-এর ইতিহাস রচনা এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ওপর নিয়মিত প্রশিক্ষণও তাঁদের অন্যতম কর্মসূচি।

‘অনুবাদ ও গবেষণা’ নামে এ সংগঠনের একটি বিভাগ আছে। এর মধ্যে এখান থেকে প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গভাবে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘এলিস কমিশন রিপোর্ট’। রাশেদ রাহমের অনুবাদ ও সম্পাদনায় রিপোর্টটি পুস্তকাকারে বেরিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর থেকে।

রিডিং ক্লাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে http://reading-club.org ঠিকানার ওয়েবসাইট থেকে। এ ছাড়া আছে ফেসবুক পেজ (https://goo.gl/JEr1DT)।

বই পড়া, বক্তৃতাবাজি... অতঃপর?

‘২০১১ থেকে ২০১৮—এই কয়েক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিচিত্র বিষয়ের পড়ালেখায় আগ্রহ বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যেকোনো সেমিনার ও বক্তৃতায় আগের চেয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিও বেশি। এর পেছনে কিন্তু রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের কিছুটা হলেও ভূমিকা আছে।’—রাশেদ রাহমের এই কথায় নড়েচড়ে বসতে হলো বৈকি। ঘটনা কি আদতেই এমন?

খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, তাঁর দাবি একেবারে মিথ্যে নয়। জ্ঞানচর্চার অন্য রকম আলো হয়ে দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠন। আহা, একসময় সেই আলোয় ভাসবেও হয়তো আরও অনেকে।