তিন হাজার মানুষের মেসবাড়ি

এমন আটটি ভবন নিয়েই সরদার কলোনি। ছবি: সুমন ইউসুফ
এমন আটটি ভবন নিয়েই সরদার কলোনি। ছবি: সুমন ইউসুফ

বিকেলবেলা। মূল ফটকের পাশে আধভাঙা এক লোহার চেয়ারে নির্ভার বসেছিলেন প্রহরী। পরিচয় জেনে মাঝবয়সী মানুষটা অনেকটা দ্বিধায় পড়লেন। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘কথা কওয়ার মতো কাউরে তো এখন পাইবেন না। সবাই অফিসে গেছে।’ কাউকে যখন পাওয়া যাবে না, চেষ্টা করলাম তাঁর সঙ্গেই গল্প জমাতে। কিন্তু জমল না। কারণ, প্রহরী আবদুল হালিমের চাকরির বয়স সেদিন মাত্র ১০ দিন, কলোনির হালহকিকত তাঁর অজানা। তাই আনুষ্ঠানিকতা শেষে গলি ধরে আরও দুই কদম এগোনোর পর মনে হলো—এ যেন নিঃশব্দের জগৎ। ফটকের বাইরে যে কোলাহল, তার রেশ হয়তো এখানে কিছুটা আছে, কিন্তু সেই কোলাহল ছাপিয়ে কলোনির নীরবতা আলাদাভাবে অনুভব করা যায়।

১৪ মে এমন আরও খানিকটা সময় অলস কেটেছিল দক্ষিণ কমলাপুরের সরদার কলোনিতে। গলি ধরে পায়চারি করতে করতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। কক্ষে কক্ষে তালা খোলার শব্দে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করল সরদার কলোনি। একজন-দুজন করে একসময় রীতিমতো অফিসফেরত মানুষের ঢল নামল। যাঁদের অনেকের এক হাতে অফিসের ব্যাগ, অন্য হাতে কাঁচাবাজার। তাঁদের কেউ কেউ এলেন মোটরবাইক হাঁকিয়ে, কেউ এলেন ধীর পায়ে। এমন নানান বয়সী মানুষের পদভারে মুহূর্তে বদলে গেল কলোনির পরিবেশ। গলিতে তখন মানুষের উভয়মুখী চলাচল। এখানে-ওখানে দল পাকিয়ে খোশগল্পও করছিলেন কেউ কেউ।

দেশের নানা প্রান্তের, নানা বয়সের, নানা পেশার মানুষের বসবাস একই ভবনে
দেশের নানা প্রান্তের, নানা বয়সের, নানা পেশার মানুষের বসবাস একই ভবনে

কেউ ছাত্র, কেউ চাকরিজীবী

এমন এক আড্ডায় পাওয়া গেল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাকারিয়া ওলিকে। একসময় ১৩৫/ডি ভবনে থাকতেন তিনি, কয়েক মাস হলো উঠেছেন ১৩৫/ই ভবনের চতুর্থ তলায়। বন্ধুদের গল্প থেকে বিরতি নিয়ে বললেন, ‘এখানকার ৭০ শতাংশ মানুষ চাকরিজীবী, বাকিরা শিক্ষার্থী। একসময় শুধু চাকরিজীবী মানুষই থাকতেন, ধীরে ধীরে ছাত্রদের সংখ্যা বাড়ছে।’ তবে তিনি এ-ও জানালেন, এই ছাত্রদের বড় অংশ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া। কারণটাও জানালেন তিনি, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব হল নেই। এখান থেকে যাতায়াত-সুবিধার কারণে অনেকেই আসেন। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের সামনে প্রায়ই সরদার কলোনির “টু-লেট” দেখা যায়।’

১৩৫/ই ভবনের সামনে তাঁর সঙ্গে কথা শেষে আবার চলে যাই একেবারে শেষের বাড়িটায়। বাড়ির নম্বর ১৩৫/বি। রসুইঘরে তখন রাতের রান্নার তোড়জোড় চলছে। বারোয়ারি রান্নাঘরে তিনজন রান্নার লোক। একজন রুটি বেলছিলেন, একজন মাংসে মেশাচ্ছিলেন মসলা, অন্যজনের ব্যস্ততা ছিল চাল ধোয়ায়। মেসবাসীরা তাঁদের খালা বলেই ডাকেন। প্রতিটি তলায় এমন রান্নার আয়োজন চলছিল। রান্নাঘর পেরোতেই দেখা হলো আবুল মনসুর নামের একজনের সঙ্গে। ১৩৫/বি ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে কয়েকজন মিলে ১৬ বছর ধরে বাস করেন তিনি। পেশায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সহকারী হিসাবরক্ষক। পরিবারের বাকি সদস্যরা চট্টগ্রামে থাকেন, তাই বাধ্য হয়ে এখানেই থাকা। তিনি বললেন, ‘অফিস কাছে। অপেক্ষাকৃত ভাড়া কম। এমন সুযোগ-সুবিধার জন্যই এখানে থাকা।’

এমন সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে আরও কিছু সুবিধা পান এখানকার বাসিন্দারা। আবদুল্লাহ মজনু যেমনটি বলছিলেন, ‘আমি এখানে আট বছর ধরে আছি। দুই ভাই মিলে থাকি। মতিঝিল এলাকায় একা থাকার জন্য এমন সুবিধাজনক জায়গা আর নেই। সাত-আট মিনিটে অফিসে যেতে পারি।’

কথায় কথায় তাঁর কাছে আরও জানা গেল, ব্যাচেলর শুনলে অনেক বাসার মালিক মুখ ফিরিয়ে নেন। আবার ভাড়া দিলেও নানা রকম চাপের মধ্যে রাখেন। কতজন থাকবে, কীভাবে থাকবে, কখন বাসায় ফিরবে—এমন অনেক নিয়মও তৈরি করেন। সে তুলনায় এই কলোনিতে থাকার সুবিধা হলো এখানে নিয়মের শেকল নেই। এখানকার নিয়মকানুন কলোনিবাসীবান্ধব।

কখনো পড়া
কখনো পড়া

বাবার হাত ধরে ছেলে

কতটা কলোনিবাসীবান্ধব তাঁর প্রমাণ সেখানে ভূরি ভূরি। এই যেমন পঞ্চাশোর্ধ্ব আবু তাহের। সরদার কলোনিতে যখন এলেন, তখন তিনি নিতান্তই তরুণ। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, অফিস কাকরাইলে। এখনো সেই কলোনিতেই থাকছেন তিনি। তবে দিনে দিনে তাঁর কক্ষসঙ্গী বদলেছে। এখন সঙ্গে থাকেন দুই ছেলে। দুজনই রাজধানীর একটি কলেজে স্নাতকোত্তর পড়ছেন। তিনি বলছিলেন, ‘পুরো পরিবার নিয়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাসের মতো সংগতি নেই। দুই ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর এখানেই এনেছি। নিরাপত্তা আর যাতায়াত-সুবিধার জন্য সরদার কলোনির বিকল্প নেই।’

রশিদা খালার ৩০ বছর

এই কলোনি যাঁদের নিজের করে নিয়েছে কিংবা যাঁরা এই কলোনিকে নিজের করে নিয়েছেন—এমন মানুষও এখানে কম নয়। ৬০ বছর বয়সী রশিদা বেগম তাঁদেরই একজন। এই দুনিয়ায় তাঁর কেউ নেই, কিছু নেই। কোথায় যাবেন তারও কোনো ঠিকানা নেই। স্বপ্ন দেখার বয়সে একে একে হারিয়েছেন সবাইকে। ১৯৭৩ সাল, তাঁর ভাষায় ‘স্বাধীনের দুই বছর’ পর হারিয়েছেন স্বামীকে। তারপর থেকে একা রশিদা জীবনকে চিনেছেন পদে পদে। ১৯৮৮ সালের কোনো একসময় এসেছিলেন ঢাকায়। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার রশিদা বেগম কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পা রেখে বুঝেছেন, এত দিনে জীবনের খুব ছোট অংশই চিনেছেন তিনি। এরপর এর-ওর বাড়িতে কাজ করেছেন। কয়েক মাস পর রান্নার কাজ পান এই কলোনিতে। এখনো ১৩৫/ই ভবনে আটজনের রান্না করেন।

কখনো একসঙ্গে খাওয়া
কখনো একসঙ্গে খাওয়া

ভাতের মাড় নিতে এল ভ্যান

রশিদা বেগমের দুঃখ-দিনের কথা শুনে মনটায় কেমন বিষাদ ভর করল। বেরিয়ে পড়ি, পায়চারি করি গলির ভেতর। বেলা ডোবার মুহূর্ত, অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, এমন সময় একটি ভ্যানগাড়ি ঢুকল কলোনিতে। একটি ভ্যান নিয়ে কৌতূহলী হওয়ার কিছু ছিল না। কৌতূহল জাগল ভ্যানের কতগুলো প্লাস্টিকের মাঝারি ড্রামে যখন ভাতের মাড় ঢালা হচ্ছিল, তখন। জানা গেল, এটা এখানকার প্রতিদিনের দৃশ্য। কলোনির সবগুলো বাড়ি থেকে ভাতের মাড় সংগ্রহ করেন ৮০ বছর বয়সী মো. তোতা। তাঁর ছয়টি গরুর পেটে চালান হয় সরদার কলোনির ভাতের মাড়। তিনি প্রতিটি ভবনেই প্লাস্টিকের ড্রাম রেখে যান। সন্ধ্যার মুহূর্তে এসে মাঝারি আকারের এই ড্রামগুলো নিয়ে যান।

ফেনী স্টোর

এই কলোনির কি কিছুই ফেলনা নয়? নিজের ভেতর প্রশ্ন রেখেই মুদি দোকানের সামনে দাঁড়াই। ১৩৫/জি ভবনের পেট ফুঁড়ে বেরোনো এই দোকানই কলোনির একমাত্র মুদি দোকান। যেখানে ‘ছারপোকা মারার ওষুধ’ থেকে নিত্যপণ্য পাওয়া যায়। মো. হোসেন দেড় বছর ধরে দোকানের দায়িত্ব পেয়েছেন; পারিবারিক দায়িত্ব। তার আগে দোকানটি ১০ বছর চালিয়েছেন বড় ভাই মো. শহীদুল্লাহ। ভাই প্রবাসী হলে বৈদ্যুতিক কারিগর হোসেন হাল ধরেন দোকানের। কেউ আসছিলেন চাল নিতে, কেউ এসে বললেন, ‘১০ টাকার তেল দেন।’ দেদার বেচাবিক্রির পরও অফিসফেরত কারও হাতে বাজারের ব্যাগ দেখলেই বিড়বিড় করেন হোসেন। তাঁর অভিমান, ‘ভাই, গায়ের ফকির ভাত পায় না। সবই আমার দোকানে আছে, কিন্তু তারা বাইরে থেকে কিইনা আনে।’

এটাই সরদার কলোনি। ফেরার সময় মনে হলো—এ যেন কলোনি নয়, একটি গ্রাম। আরও একটু বাড়িয়ে বলা যায়, সরদার কলোনি যেন সমগ্র বাংলাদেশ। ওই যে গলিতে দাঁড়িয়েই তো শুনতে পেলাম—কত রকম ভাষা, কত রকম পরিচয়ের মানুষ। তাঁরা দিনান্তে এসে ঢুকছেন একই কক্ষে। যে কক্ষের কেউ নোয়াখালীর, কেউ ময়মনসিংহের কিংবা উত্তরবঙ্গের কোনো জেলার। বাড়িতে হয়তো অনেকে আছেন, কিন্তু এখানে, এই সরদার কলোনির ভবনগুলোর ছাদের নিচে—সবাই তো পরমাত্মীয়। এভাবেই তো হাসি-কান্নায়, সহযোগিতায়-ভালোবাসায় পার করছেন বছরের পর বছর।

সরদার কলোনির বিড়ালগুলোও বন্ধু হয়ে যায় বাসিন্দাদের
সরদার কলোনির বিড়ালগুলোও বন্ধু হয়ে যায় বাসিন্দাদের

গোড়াপত্তনের গল্প

‘এইটা একসময় আছিল ফসলের মাঠ। শাকসবজির আবাদ হইত। সামনের রেলওয়ের কাজ শুরু হইলে অনেক মানুষ আইসা সরদার সাবরে (আফির উদ্দিন সরদার) বলছিল থাকার ব্যবস্থা করতে।’ ১৩৫/সি ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মো. মিন্টু সরদার কলোনির গোড়াপত্তনের গল্প বলছিলেন। একসময়কার পতিত জমি, খালপাড়ের এই জমিতেই বসবাস শুরু হলো নিম্নআয়ের মানুষের। সেটা কখন, তা বলতে পারলেন না মো. মিন্টু। শুধু বললেন, ‘পাকিস্তান আমলে হইব।’

তবে আধুনিক সরদার কলোনির গোড়াপত্তনের সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা গেল ১৩৫/সি ভবনের অংশীদার ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সরদার আকিল আহমেদের কাছে। ‘আমার দাদা আফির উদ্দিন সরদার পারিবারিকভাবে দক্ষিণ কমলাপুর ও মুগদা এলাকার মানুষ। এই এলাকার অনেক সম্পত্তি ছিল তাঁদের। যার একটি অংশ এই কলোনির জমি। দাদা আমার বাবা-চাচাদের জমিটা দিয়ে গেছেন। তাঁরা আট ভাই মিলে এই কলোনি তৈরি করেছেন। বংশগত নামের কারণেই কলোনির নাম হয়েছে সরদার কলোনি।’ বলছিলেন তিনি।

একসঙ্গে অনেকের রান্না
একসঙ্গে অনেকের রান্না

সরদার আকিল আহমেদের কাছেই জানা গেল, এটা ১৯৮২ সালের কথা। মতিঝিল তখনো রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। ব্যাংক-বিমাসহ সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অনেকে এসে তাঁর বাবা-চাচাদের কাছে অনুরোধ করলেন থাকার একটা ব্যবস্থা করার জন্য। তাঁদের কথাতেই তোলা হলো আধা পাকা কয়েকটি ঘর। ব্যবস্থা হলো কর্মজীবী মানুষের থাকার। আরও বছর চারেক পর ভিত্তি গড়া হলো বহুতল ভবনের। একে একে উঠল আটটি ভবন। গড়ে উঠল সরদার কলোনি।

এখন আচমকা কেউ ভবনের ভেতরে ঢুকলে ধন্দে পড়বেন। কারণ, বাড়িগুলো অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের মতো। মাঝে ফাঁকা জায়গা। প্রতিটি তলার এক অংশে গণশৌচাগার ও রান্নাঘর। সরদার আকিল আহমেদের ভাষায়, ‘আসলে মেসের কথা মাথায় রেখেই ভবনগুলোর নকশা করা হয়েছিল। তবে দুটি ভবনের নকশা আলাদা। সেখানে দুই কক্ষের জন্য একটি শৌচাগার ও রান্নাঘর আছে।’

রশিদা বেগম
রশিদা বেগম

১৩৫ নম্বর প্লটের এই কলোনিতে এখনো আটটি ভবনই রয়েছে। মূল ফটক থেকে গলি ধরে এগোলে চৌহদ্দির মধ্যে হাতের বাঁয়ে পড়ে ১৩৫/ই (চারতলা), ১৩৫/ডি (পাঁচতলা), ১৩৫/বি (আটতলা) এবং ডানে পড়ে ১৩৫ (চারতলা), ১৩৫/জি (পাঁচতলা), ১৩৫/এফ (পাঁচতলা), ১৩৫/সি (ছয়তলা) ও ১৩৫/এ (দোতলা) ভবনগুলো। মো. মিন্টু, কলোনিতে যিনি মিন্টু ভাই, তিনিই হিসাব করলেন তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা ১৩৫/সি ভবনে ৭৪টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে দুই থেকে পাঁচজন থাকেন। ‘এক হিসেবে আমরা জেনেছি আট ভবনে প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস।’ জানালেন সরদার আকিল আহমেদ।

রাজধানীর দক্ষিণ কমলাপুরের সরদার কলোনি ‘ব্যাচেলরদের মেস’ হিসেবে পরিচিত। তবে অধিবাসীদের অনেকেই বিবাহিত। তাঁদের কেউ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী, আছেন ব্যবসায়ী-চিকিৎসক-রাজমিস্ত্রি-উন্নয়নকর্মী-শিক্ষার্থীসহ নানান পরিচয়ের মানুষ। কিছু নিয়মকানুন মেনে যে কেউ সরদার কলোনির বাসিন্দা হতে পারেন। কক্ষপ্রতি ভাড়া চার হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত।