যেখানে রাজপুত্রদের বিয়ে হয়

সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের সিঁড়ি ভেঙে নামছেন প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেল
সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের সিঁড়ি ভেঙে নামছেন প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেল

রাজপুত্র হ্যারির মুখে উদ্বেগ আর উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। নিচু স্বরে কিছুক্ষণ পরপর বড় ভাই উইলিয়ামের  সঙ্গে কিছু একটা বলছেন। রাজপরিবারের অন্য সদস্যরা একে একে আসা শুরু করলেন। ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন। সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের অন্দর-বাহির রাজপরিবারের সদস্য আর আমন্ত্রিত অতিথিতে পূর্ণ। সারা পৃথিবী থেকে এই রাজকীয় বিয়েতে দাওয়াত পেয়েছেন মাত্র ৬০০ জন। সেন্ট জর্জেস চ্যাপেল গির্জার সবাই অধীর আগ্রহে কনের জন্য অপেক্ষা করছেন। রাজকীয় রোলস রয়েলস এসে থামল চ্যাপেলের আঙিনায়। গাড়ি থেকে নেমে এলেন শুভ্র পোশাকের হবু রাজবধূ মেগান মার্কেল। প্রাসাদের আঙিনায় হর্ষধ্বনি উঠল। তিনি হাত নেড়ে চ্যাপেলের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলেন। 

পৃথিবীর নামীদামি চ্যানেলগুলো এই রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠান লাইভ দেখাচ্ছিল। কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে এই বিয়ের অনুষ্ঠান আমিও দেখলাম। অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে একটা ধাক্কা মতো খেলাম। চ্যানেলগুলো সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের ভেতর-বাহির যে অংশই দেখাচ্ছে, সেই জায়গাগুলো আমার খুব পরিচিত। আমি একসময় এই জায়গাগুলোতে হেঁটে বেড়িয়েছি! ঘুরে ঘুরে দেখেছি!

সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের সামনে লেখক
সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের সামনে লেখক

২০১২ সালে কমনওয়েলথ ইয়ুথ কনফারেন্সে যোগ দিতে আমি তখন ইংল্যান্ডে। আয়োজক কর্তৃপক্ষ একদিন প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে ঘোষণা করল, ‘রাজপ্রাসাদের আমন্ত্রণে আমরা কালকে উইন্ডসর ক্যাসেলে যাচ্ছি এবং সেন্ট জ‌র্জেস চ্যাপেলের প্রার্থনায় অংশ নেওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ তোমরা পা‌চ্ছ।’ প্রবল উত্তেজনা প্রকাশ করতে তাঁরা মুখ দি‌য়ে নানা ধরনের শব্দ করলেন! তাঁদের অতি উত্তেজনার কারণটা ধরতে পারলাম না, খুশি না হ‌লে অভদ্রতা হতে পারে, এ জন্য মুখে খানিকটা হাসি ধরে রাখতে হলো।

কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো একসময় ব্রিটিশ রাজত্বের অধীন ছিল, উইন্ডসর প্রাসাদ থেকে তারা এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পরিচালনা করত। তাদের সাম্রাজ্য এতই বড় ছিল যে গর্ব করে বলা হতো, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না’। ইংল্যান্ডের রানির সবচেয়ে প্রাচীন এই প্রাসাদ সেন্ট্রাল লন্ডন থে‌কে ২০ মাইলের মতো দূরে। আমরা গ্রে হাউন্ড বাসে করে প্রাসাদের সিংহদরজায় নামলাম। কমনওয়েলথভুক্ত দে‌শ থে‌কে আসা প্রতিনিধিরা মি‌লে রাজসিক বা‌কিংহাম প্যা‌লেস দে‌খে‌ছি। চোখধাঁধানো বাকিংহাম দেখার পরে ‌সাদাসিধে উইন্ডসর প্রাসাদ আম‌ার খুব একটা মনে ধরল না। প্রাসাদের মধ্যে সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে প্রার্থনায় অংশ নিতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। সবার হাতে গানের কথা লেখা কাগজ দেওয়া হলো। প্রার্থনা শেষে রাজকীয় বাদক দলের সঙ্গে আমাদেরও গাইতে হলো সেসব গান। গানে আবেগ দিতে আমরা কোনো কমতি রাখলাম না। আচার অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন ছ‌বি‌ তোলায় ব্যস্ত, আমি জায়গাটা ঘুরে ঘু‌রে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। এই চ্যাপেলেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন রানি প্রথম এলিজাবেথ, রাজা অষ্টম হেনরি, রাজা প্রথম চার্লস, রাজা তৃতীয় জর্জসহ আরও অনেকে। পাথরের তৈরি চ্যাপেলের ভেতরেরটা বিস্ময়কর, সঙ্গে কিছুটা ভয় ধরানো। আধো অন্ধকার চ্যাপেল থেকে রৌদ্রোজ্জ্বল মাঠই আমাকে বেশি টানে। 

বিবিসির পর্দায় প্রিন্স হ্যারি আর মেগান মার্কেলের বিয়ে দেখার সময় আরও জানলাম, এই সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলেই প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলট‌নের বিয়ে হয়েছে। বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছে প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার! তথ্যগুলো আগে জানলে সেখানে আরও চমৎকার কিছু ছ‌বি থাক‌ত ঠিকই, কিন্তু প্রাচীন সেই চ্যাপেলের ‌দৃশ্যগুলো আর মস্তিষ্কে গেঁথে থাক‌ত না। সব খারাপেরও নিশ্চয়ই এমন একটা ভা‌লো দিক থা‌কে।

সিদ্ধার্থ মজুমদার

ঢাকা