প্যারিসের রাস্তায় বিনে পয়সার ইফতার

পথের পাশে এমন সাদা কাপড় বিছিয়ে রোজাদারদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। ছবি: লেখক
পথের পাশে এমন সাদা কাপড় বিছিয়ে রোজাদারদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। ছবি: লেখক
>প্যারিসে সন্ধ্যা বলতে যেটা বোঝায়, স্তালিনগ্রাদ এলাকায় সেটা নয়। অন্তত এই রমজান মাসে তো নয়ই। এখানে পুরো রমজান মাসে বড় রাস্তার মাঝখানের বৃক্ষশোভিত জায়গাজুড়ে চলে বিনে পয়সায় ইফতার পরিবেশন।

স্তালিনগ্রাদ মেট্রোস্টেশনের কাছে এসে মোটামুটি থমকে গেছি। সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে। রাস্তার দুপাশে অপেক্ষমাণ শত শত মানুষ। কেউ বসেছেন বেঞ্চিতে। কেউ দাঁড়িয়েছেন বাসস্টপেজের আশপাশে দল বেঁধে। কেউ আছেন দোকানঘরের ছাউনির নিচে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষই বেশি। দক্ষিণ এশীয় আর আরব্য চেহারার মানুষও মিলল। পাশেই গাড়ি রাস্তার মাঝখানে বৃক্ষশোভিত পথে (বুলভার্ড) রীতিমতো এলাহি আয়োজন। 

লাল জ্যাকেট পরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক খুব ব্যস্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছেন। হাতে অনেকগুলো পানির বোতল। দ্রুত হাতে তাঁরা সেগুলো রাখলেন নিচে বিছানো কাপড়ের ওপর। সেটা শেষ না হতেই পেছনে আরেক দল। তাদের হাতে খেজুর। খেজুরের পরের আইটেম এল—ফ্রুট সালাদ। টুকরো রুটি, ফলের রস আর দুধের বোতল লম্বা সারি করে সাজানো হয়ে গেছে আগেই। ইফতারের সময় হয়ে এল বলে! প্যারিসের মতো শহরের রাস্তায় বিনে পয়সায় ইফতারের এমন আয়োজন? তা-ও কিনা পুরো রমজান মাস? ভাবনাতেই ছিল না!

অচেনা প্যারিস সন্ধ্যা
এই তো গেল সপ্তাহের কথা। প্যারিসের নানা এলাকায় ঘুরছি। আর মাথায় ঘুরছে চিরচেনা পুরান ঢাকার ইফতার বাজারের দৃশ্য। প্যারিসে কি এমন কিছু নেই? প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রে দু-চার দিনের ঘোরাঘুরিতে মিলল না সে রকম কিছু। বাসে যেতে যেতে শুধু তুর্কি একটা দোকানে ‘রামাদান মোবারক’ লেখা চোখে পড়েছিল। আর একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টের সামনে ইফতারের বিশেষ খাবার প্যাকেজের বিজ্ঞাপন। ব্যস, এটুকুই। 

ইফতারি বিতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা
ইফতারি বিতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা

খবরটা দিলেন প্যারিসের সংগীতশিল্পী কুমকুম। গার দু নর্দ এলাকার এক বাঙালি আড্ডায় ইফতার প্রসঙ্গ উঠতেই কুমকুম জানালেন বিনে পয়সার ইফতারের এই আয়োজনের খবর। শুনে আর বিলম্ব নয়। গার দে লেস্ত থেকে পাতালরেলে চেপে স্তালিনগ্রাদ। 
এটা শহরের খানিকটা দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা। প্যারিসে ইফতার সময় ৯টা ৪০ মিনিট। নয়টা না বাজতেই হাজির হয়ে গেছি জায়গামতো। কিন্তু ভাগ্য মন্দ। ইফতারের সময় হওয়ার ঠিক আগে আগে, মুষলধারে বৃষ্টি। সঙ্গে চারপাশে অন্ধকার। রাস্তার মাঝখানের বুলভার্ডে যেখানে ইফতারের আয়োজন হয় সেখানে শামিয়ানা নেই। তাই আয়োজনটা যেমন ভেবেছিলাম সে রকম হলো না। হাতে হাতে ইফতার নিয়েই সবাই বিদায়। 

পরদিন আবারও হাজির। ইফতারের একদম দুই ঘণ্টা আগেই। তখনই ভিড় জমে গেছে মোটামুটি। খাবার সরবরাহ করার ভ্যান এসে গেছে আগেই। চলছে খাবার প্লেটে সাজানোর কাজ। দ্রুত হাতে রুটি ভাগ করছিলেন বেশ কয়েকজন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ব্যস্ততার মাঝেও হাত মেলাতে এলেন দলনেতা নাবিল। মুখে চাপ দাড়ি। ন্যাড়া মাথা। শক্ত-সমর্থ্য শরীর। প্রথম দেখায় মনে হয় সুলতান সুলেমান সিরিজের কোনো চরিত্র। তবে তুরস্ক নয়। নাবিলের পূর্বপুরুষের বাড়ি আলজেরিয়া। এখন ফ্রান্সই ঠিকানা। জানালেন, এই ইফতার আয়োজনে সহযোগিতা করে তাঁদের সংগঠন ‘আ কোর দো লা প্রেকারিতে।’ যার সহজ বাংলা হতে পারে ‘হৃদয় দিয়ে মানুষজনকে সাহায্য করা।’ এই ইফতার আয়োজন মূলত অভাবী মানুষের জন্যই। কিন্তু এই ইফতারে যে কারও শামিল হতে বাধা নেই। নাবিল আবার কাজে ফিরে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, ‘থাকো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’ 

স্তালিনগ্রাদের বাসিন্দা ফরাসি তরুণ জর্ডান ওডিন। ১০ বছর ধরে থাকেন এই এলাকায়। তিনি বলছিলেন, ‘এখানে অভাবী আর গৃহহীন মানুষের আনাগোনা বেশি। প্রায় সময়ই ফ্রি খাবার বিতরণ করা হয়। তবে রমজানের এই আয়োজনটা বিশেষ আয়োজন।’ 

টুকরো রুটি
টুকরো রুটি

সেই সব মানুষ
মায়াকাড়া চেহারা। হাসি হাসি মুখ। কৃষ্ণাঙ্গ যুবক বসে ছিলেন ইফতারির নানা পদ সামনে নিয়ে। ইংরেজি জানা নেই। একজন দোভাষীর সহায়তায় চলল কথাবার্তা। এসেছেন সুদান থেকে। ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে এসেছেন প্যারিসে। কপাল এখনো খোলেনি। কিন্তু হালও ছাড়েননি। প্রতিদিনই আসেন স্তালিনগ্রাদে এই ইফতার আয়োজনে। কোথায় থাকেন? জিজ্ঞেস করতেই একটা লজ্জামাখা হাসি। লজ্জা পেলাম আমিও। আসলে ঠিকঠাক থাকার কোনো জায়গা নেই ছেলেটার। বইয়ের ভাষায়, গৃহহীন অথবা ভাসমান। 
পাশেই আরেকজন আলজেরিয়ার মধ্যবয়স্ক মানুষ। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলেন। একটা রোজাও বাদ দেননি। বলছিলেন, ‘এখানে সবাই মিলে ইফতার করতে ভালো লাগে। খাবারের আয়োজনও ভালো।’ মাথায় টুপি। জুব্বা পরা কয়েকজন আফ্রিকার মানুষ পাশেই ছিলেন। হাসি বিনিময় হলো। কিন্তু কথা হলো না। 

খাবারদাবার তখন সব সাজানো হয়ে গেছে। ঘড়িতে ঠিক ৯টা ৪২ মিনিট। ইফতার শুরু করেছেন সবাই। মিলেমিশে খাবার ভাগ করে নেওয়া। কোনো হট্টগোল নেই। চেনা-অচেনা কত দেশ, কত জায়গার লোক। একজন আরেকজনের দিকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। পাশ দিয়ে হুসহাশ। খানিক পরপর বাস-কার আসছে-যাচ্ছে। পাশের একটা রেস্টুরেন্টে জমজমাট ফুটবল খেলা চলছে। সেখানে চিৎকার চলছে। কিন্তু এই সময়টায় সেসব দিকে আগ্রহ নেই এঁদের কারও।

আয়োজকদের দলনেতা নাবিল
আয়োজকদের দলনেতা নাবিল


বাংলাদেশ দ্য গ্রেট
ইফতার শেষে চলে আসব। আবার মেট্রোস্টেশনের দিকে যাচ্ছি। পেছন থেকে কেউ একজন ডাকল। তাকিয়ে দেখি স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা নাবিলকে। 
—‘সরি মাই ফ্রেন্ড, দেরি হয়ে গেল।’ 
বললাম, ‘ঠিক আছে। তুমি তো অনেক ব্যস্ত।’ 
‘বাংলাদেশ গ্রেট। আমি বাংলাদেশের কথা জানি।’—তার ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল নাবিল। 
বটে? এত দেশ ঘুরে দেশের এমন প্রশংসা তো শুনিনি খুব বেশি। না, স্রেফ কথার কথা নয়। নাবিল আদতেই বাংলাদেশকে ‘গ্রেট’ মনে করে। 
—‘বাংলাদেশ ভালো। তোমরা একটা অসাধারণ কাজ করেছ। তোমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছ। না হলে মানুষগুলো মারা যেত। খোদা তোমাদের মঙ্গল করবে।’ বলল নাবিল। 
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এসেছি প্যারিসে আসার সপ্তাহখানেক আগে। সেখানে কত বিদেশি মানুষ কাজ করছেন। খোলামনে বাংলাদেশের এমন উচ্চকিত প্রশংসা শুনিনি তেমন কারও কাছে। 
নাবিল তার খাবারবাহী ভ্যানগাড়িতে উঠে বসেছে। চলে যাবে। তাকে বিদায় জানালাম। 
রাত নেমেছে প্যারিসে। ফিরতি ট্রেন ধরব। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। মনটা খুশিতে ভরে উঠল কেন যেন!

ফলের সালাদ
ফলের সালাদ