স্বপ্নের বসত হুইলচেয়ারে

তাঁদের ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন আর মনোবলটুকু এখনো অটুট
তাঁদের ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন আর মনোবলটুকু এখনো অটুট

এপ্রিলের ২৭ তারিখ। রাজশাহীর মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠ। স্বপ্ন আর স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার নিয়ে হাজির মানুষগুলো। হাতিয়ার বলতে ওই ব্যাট আর বল। দুটো চাকা আর চেয়ারে জীবনটা আটকে গেলেও, স্বপ্নকে আটকাবে এমন সাধ্য কার? তবে এই দৃশ্যে সবচেয়ে অবাক করা খবর—হুইলচেয়ার ক্রিকেট খেলতে আসা ৭৫ জনের এই দলটায় আছেন ১৮ জন নারীও। যাঁদের এত দিন তাঁদের পরিবার পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পারলেই বাঁচত, সেই সব কন্যা সেদিন আলোয়-হাওয়ায় ক্রিকেট খেললেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের নয়াদিয়াড়ির মতো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একা চলে এসেছিলেন মোয়াজ্জেমা খাতুন। একাই! অনেকটা পরিবারের নির্দেশ অমান্য করে। যে দেশে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূলধারার বাইরে ভাবা হয়, সে দেশে হুইলচেয়ারে জীবন কাটানো ক্রিকেটপাগল এক মেয়ের স্বপ্নের কথা আগ্রহভরে শুনবেই-বা কে? পরিবারই যেখানে প্রতিমুহূর্তে তটস্থ থাকে কন্যাদের ভবিষ্যৎ চিন্তায়।

এই ভবিষ্যতের অর্থ ভিন্ন। পরিবারে প্রতিবন্ধী ছেলে যদি হয় কষ্টের নিশান, মেয়েরা তো পুরোদস্তুর বোঝা! সুস্থ-সক্ষম কন্যাকে বিয়ে দেওয়াটাই যখন এ দেশের যেকোনো পরিবারের বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে প্রতিবন্ধী কন্যা তো রীতিমতো গলার কাঁটা! মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল মোয়াজ্জেমার সঙ্গে। এপার থেকেও ঠিক বোঝা যাচ্ছিল, ক্রিকেটের জন্য কতটা মায়া ঝরে পড়ছে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়া তরুণীর কণ্ঠে, ‘আমি যখন ছোট, তখন থেকেই ক্রিকেট আমার প্রাণ। ক্রিকেট খেলা চললে আমি উঠতেই চাইতাম না টেলিভিশনের সামনে থেকে। আমার মা-ভাবিরা বলতেন, ‘‘মেয়ে মানুষ! ক্রিকেট নিয়ে এত পাগল কেন? আর এত দেখে কী লাভ? কোনো দিন তো খেলতে পারবি না।”’ চোখ ফেটে জল আসতে চাইত প্রতিবন্ধিতার অভিশাপ নিয়ে বেড়ে ওঠা মেয়েটির।

সেদিন রাজশাহীর হুইলচেয়ার ক্রিকেটের এই প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমে আসা ১৮ মেয়ের সবার গল্পটা প্রায় এ রকমই। মোয়াজ্জেমার মতো পারিবারিক-সামাজিক বাধা নিয়ে বেড়ে ওঠা মেয়েদের জন্য এ তো ক্রিকেট নয় শুধু। এ তো সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের শতাব্দী প্রাচীন মানসিকতায় বিপুলতর আঘাত! একটু অন্যভাবে সক্ষম এই মানুষগুলোর নিজের মনে অন্ধকার কোটরে জমিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো আলোতে আনতে ছুটে গেছেন মোহাম্মদ মহসিন।

মাঠে নামছেন মোহাম্মদ মহসিন (ডানে)
মাঠে নামছেন মোহাম্মদ মহসিন (ডানে)

মহসিনের কথা
মোহাম্মদ মহসিন টঙ্গীর পাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়ে ছেলেবেলার পোলিওতে চলার শক্তি হারানো সাধারণ ছেলেটি। যে কখনো তাঁর ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন আর মনোবলটুকু হারাননি। বাংলাদেশে হুইলচেয়ার ক্রিকেটের জন্ম দেওয়া এই মানুষটির বড় স্বপ্ন ছিল ক্রিকেট খেলার। কিন্তু ওই যে ‘চলতে পারে না, আবার ক্রিকেট খেলা!’ দমেননি মহসিন। বাসে করে টঙ্গী থেকে বারবার পাড়ি দিয়েছেন গুলিস্তান, স্টেডিয়ামপাড়ায় খুঁজে ফিরেছেন একটু খেলার সুযোগ। চলাচলের ঝক্কির সঙ্গে উপরি পাওনা মানুষের অবজ্ঞা তো ছিলই। বড় দুঃখ নিয়ে বলছিলেন, ‘কখনো কখনো রাত হয়ে যেত। ঢাকা থেকে ফেরার পথে বাসে উঠতে গেলে আমাকে নিতে চাইত না।’

সেই অবহেলা পেয়ে থেমে গেলে হয়তো কিছুই হতো না। মহসিন থামেননি বলেই এ দেশে জন্ম নিয়েছে হুইলচেয়ার ক্রিকেট নামে একটি নতুন স্বপ্ন। প্রতিবন্ধিতায় নিজের ভেতরে কুঁকড়ে নেওয়া মানুষগুলোকে হাত ধরে আলোতে এনেছেন মহসিন। ২০১২ সালে ‘সিআরপি’র সহযোগিতায় শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল গঠন করা হলো। ২০১৩ সালে ভারতের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের সঙ্গে তিনটি প্রীতি ম্যাচ খেলল সিআরপি দল। কিন্তু হুইলচেয়ারে থাকায় স্বপ্নপূরণ হলো না মহসিনের। ঘুরতে থাকলেন দরজায় দরজায়।

এক বছর পর বহু চেষ্টার পর আলোর মুখ দেখল বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়দের এনে দল গড়লেন মহসিন। ২০১৪ সালের জুনে ভারতে তাজমহল ট্রফি খেলতে ভারত যায় মহসিনদের শারীরিক প্রতিবন্ধী দল। শুধু যাওয়া নয়। ২-১ এ সিরিজ জিতে দেশে ফেরে। কিন্তু সেই দলটিতেও জায়গা পোক্ত হলো না মহসিনের। আবারও কারণ ওই হুইলচেয়ার। মূলত শারীরিক প্রতিবন্ধী দলে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের মাঠে নামাতে অনীহার কথা বড় ক্ষোভ নিয়ে বলছিলেন মোহাম্মদ মহসিন, ‘সে সময়েই ভাবনা শুরু হলো একটা দল গড়ার, যেখানে খেলবে শুধু হুইলচেয়ারে থাকা খেলোয়াড়েরাই।’

তাঁর চোখে স্বপ্ন দেখল বাংলাদেশ
২০১৬ সালে আলোর মুখ দেখল মহসিনের স্বপ্ন। মহসিনের মতো আরও ৩২ হুইলচেয়ার ক্রিকেটারের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নযাত্রায় মহসিনের সারথি এখন ২০০ মানুষ। হুইলচেয়ার ক্রিকেট আসার আগে যাঁরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতেন ঘরের কোণে। হীনম্মন্যতায়-অপদস্থ হওয়ার ভয়ে! ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রথমবার এই মানুষগুলোকেই হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে দেখা গেল প্রাণের উচ্ছ্বাসে ক্রিকেটের উৎসবে মেতে উঠতে। সে সময়ের স্মৃতি হাতড়ালে মনে পড়ে, এক হুইলচেয়ার ক্রিকেটারের মুখ। খেলা শেষে যিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হুইলচেয়ার থেকে। দু চোখের অঝোর ধারায় মাখামাখি হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের কংক্রিট, ‘আমিও কোনো দিন যে ক্রিকেট খেলব, সে তো আমার স্বপ্নেরও বাইরে!’

পরের বছর ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে জয়, সে বছরে নেপালে ত্রিদেশীয় সিরিজের রানারআপ হলো মহসিনদের হুইলচেয়ার দল। আর গত এপ্রিলে ভারতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ আর ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে ফিরেছে হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল। এটা কিন্তু শুধু জয় নয়। প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানসিকতায় ভেতরে ভেতরে এক বিপুল আন্দোলনের জন্ম দিয়ে দিয়েছেন মহসিনেরা। হুইলচেয়ার ক্রিকেটের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইমাগো স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাবির বলছিলেন, ‘মহসিন যখন আমার অফিসে আসে, তখন মনে হয় একটা র‍্যাম্প (সিঁড়ির বিকল্প) থাকা দরকার ছিল। আসলে ভিন্নভাবে সক্ষম এই মানুষগুলোও যে আমাদের সমাজের পূর্ণাঙ্গ অংশীদার, এ তো আমাদের কখনো ভাবতে শেখানোই হয়নি।’ নাগরিক জীবনে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির বদলের শুরুটা এভাবেই হচ্ছে প্রতিদিন, সে যত অল্প পরিসরেই হোক না কেন।

গড়বেন নারীদের দল
মোহাম্মদ মহসিনের সার্থকতা এখানেই। সেটাকে সম্পূর্ণতা দিতে এবার অন্তরালে লুকিয়ে রাখা নারীদের আলোয় আনার সংগ্রামে নেমেছেন মহসিন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসও। ‘ড্রিমস অন হুইলস’ নামের এই প্রচেষ্টায় এখন জেলায় জেলায় মোয়াজ্জেমাদের মতো নারী ক্রিকেটারের খোঁজে ঘুরছেন মহসিন। একটা জাতীয় দল গড়বেন। সেখানে হয়তো প্রথমবার হুইলচেয়ারের বন্দিত্বের বাইরে প্রথমবার মুক্তির স্বাদ পাবেন প্রতিবন্ধী নারীরা। হয়তো তখন এই সমাজও এই নারীদের বোঝা হিসেবে না দেখে, গৌরব হিসেবে দেখবে প্রথমবার।