বন্ধু হয়ে মানুষের পাশে

উত্তরবঙ্গে শীতার্ত মানুষেরা এসেছিলেন ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের শীতবস্ত্র নিতে। ছবি: সংগৃহীত
উত্তরবঙ্গে শীতার্ত মানুষেরা এসেছিলেন ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের শীতবস্ত্র নিতে। ছবি: সংগৃহীত
>ফারাজ আইয়াজ হোসেন বন্ধুত্ব, সাহস ও মানবিকতার প্রতীক। তাঁর সেই অনুভূতি ধারণ ও লালন করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। কখনো ছুটে যাচ্ছে বিপন্ন শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ নিয়ে, কখনো আয়োজন করছে বিনা মূল্যে চক্ষুশিবির, পরিচালনা করছে শীতবস্ত্র বিতরণ, পাশে দাঁড়িয়েছে হৃদ্‌রোগ, ক্যানসারসহ দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত অনেক মানুষের। এই ফাউন্ডেশনের কথা থাকছে এই প্রতিবেদনে 
ফারাজ আইয়াজ হোসেন (১৫ এপ্রিল ১৯৯৬ – ১ জুলাই ২০১৬)। ছবি: সংগৃহীত
ফারাজ আইয়াজ হোসেন (১৫ এপ্রিল ১৯৯৬ – ১ জুলাই ২০১৬)। ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের পাহাড়ি পথ ধরে চলছে সারি সারি ট্রাক। খাবার ও কাপড়ে ঠাসা এসব যন্ত্রযান যাচ্ছে মিয়ানমার থেকে আসা বিপন্ন শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ নিয়ে। ট্রাকের সঙ্গে একদল উদ্যমী তরুণ। গায়ে টি-শার্ট আর মাথায় ক্যাপ। তাতে লেখা, ‘আমরা ফারাজ’। এই তরুণেরা ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের কর্মী।

২০ বছরের তরুণ ফারাজ আইয়াজ হোসেন বন্ধুত্ব, সাহস ও মানবিকতার যে নিদর্শন দেখিয়েছিলেন, সেই অনুভূতিই ধারণ ও লালন করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন।

মানুষের পাশে
মানুষের পাশে

মা সিমিন হোসেন তাঁর দুই ছেলে যারেফ আয়াত হোসেন ও ফারাজ আইয়াজ হোসেনকে ছোটবেলায় বলতেন, ‘জীবনে যা-ই হও না কেন, প্রথমে একজন ভালো মানুষ হবে।’ রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালের ১ জুলাই কালরাতে ফারাজ তাঁর মায়ের সেই কথাই রেখেছিলেন। তাঁর দুই বন্ধু অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈনকে জঙ্গিরা হত্যা করতে বন্দী করে রেখেছিল। তাঁদের সঙ্গে থাকা ফারাজকে চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল জঙ্গিরা। কিন্তু বন্ধুদের ছেড়ে আসেননি ফারাজ। বরং দুই বন্ধুকে রক্ষা করতে জঙ্গিদের মুখোমুখি হন। অন্যদের সঙ্গে ফারাজকেও নৃশংসভাবে হত্যা করে জঙ্গিরা।

২০ বছরের এই তরুণের সাহসিকতা ও অন্যের প্রতি সমবেদনার দৃষ্টান্ত সবার জন্য গৌরব এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর এই বীরত্বগাথা। ফারাজের পরিবার তাঁর নামে প্রতিষ্ঠা করেছে ‘ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন’।

সাভারের সিআরপিতে খোলা হয়েছে ফারাজ হোসেন কেন্দ্র
সাভারের সিআরপিতে খোলা হয়েছে ফারাজ হোসেন কেন্দ্র

ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। রাজধানীর র‍্যাডিসন হোটেলে ‘ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার ২০১৭’ প্রদান অনুষ্ঠানে এই ফাউন্ডেশনের ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশন গঠনের ঘোষণা দিয়ে ফারাজের বড় ভাই যারেফ বলেন, ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কথা বিবেচনায় না নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করবে এই ফাউন্ডেশন। পরিণতির কথা না ভেবে মানবিকভাবে যা সঠিক, তা নিয়ে এই ফাউন্ডেশন কাজ করবে। কারণ, এই প্রতিষ্ঠান যাঁর নামে, সেই ফারাজ হোসেন এই চেতনাই ধারণ করতেন।’ এরপর মানুষ যেখানে বঞ্চিত, অসহায় ও বিপন্ন, সেখানেই ছুটে গেছে সাহসী যুবকের নামে গড়া সংগঠনটি।

রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণ
রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণ

ফারাজের জন্মদিন উপলক্ষে গত ১৫ এপ্রিল মিরপুরে দুস্থ শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে চক্ষুশিবির পরিচালনা করে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ববিতা। তিনি বলেছিলেন, ‘ফারাজ যেভাবে আত্মাহুতি দিয়েছে, যে কষ্ট করেছে, যে সাহস দেখিয়েছে, তা নতুন করে বলার কিছু নয়। এ রকম সাহসিকতা সারা বিশ্বে বিরল। এই যুগের একজন ছেলে শিখিয়েছে বন্ধুত্ব ও মানবিকতার মূল্য কত।’

ফারাজের এই হাসি এখন মানুষের হৃদয়ে
ফারাজের এই হাসি এখন মানুষের হৃদয়ে

ঢাকায় বড় বড় দুটি চক্ষুশিবির পরিচালনা করেছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। চক্ষুশিবিরে চোখের সব রকম পরীক্ষা করা হয়েছে, ওষুধ দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে চশমাও দেওয়া হয়েছে। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই এই সুবিধা পেয়েছে। ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন খ্যাতনামা চিকিৎসকেরা। এক হাজারের বেশি মানুষ এই সুবিধার আওতায় চোখের আলো ফিরে পেয়েছেন।

শুধু চোখের চিকিৎসা নয়, দুস্থ রোগীদের জন্য ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়ার কাজ করছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। তাঁদের দরকারি ওষুধও দেওয়া হয়েছে।

শিশুদের জন্য চক্ষুশিবিরে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ববিতা (মাঝে)
শিশুদের জন্য চক্ষুশিবিরে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ববিতা (মাঝে)

রোহিঙ্গা শিবিরের ত্রাণের কথা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। ১৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পরিবারকে সহায়তা দিয়েছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। ত্রাণ বিতরণের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের একজন সংগঠক জানালেন, এই ফাউন্ডেশনের নাম শুনেই মানুষ এগিয়ে আসে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তারাও ত্রাণ বিতরণে সহায়তা করেন। ফারাজের নামে ফাউন্ডেশনের তৎপরতা তাঁদের মনে জাগিয়ে তোলে অন্য অনুভূতি।

গেল বছর হাড়কাঁপানো শীতে কাবু হয়েছিল উত্তরাঞ্চলের মানুষ। সেখানেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব জেলায় বিপুল পরিমাণ শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। শুধু ত্রাণই নয়, হৃদ্‌রোগ, ক্যানসারসহ দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত অনেক মানুষ ফাউন্ডেশনের সহায়তা পেয়েছে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে।

দুস্থ মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা
দুস্থ মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা

সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনকেন্দ্রের (সিআরপি) সঙ্গে প্রতিবন্ধী মানুষের সহায়তায় কাজ করছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। সিআরপিতে খোলা হয়েছে ‘ফারাজ হোসেন কেন্দ্র’। সেখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের নানাভাবে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষা-চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যা যা করা দরকার, তার সবই করা হবে এই কেন্দ্রে।

এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে ফারাজের ভাই যারেফ আয়াত হোসেন বললেন, ‘ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য, ফারাজ যে সাহসিকতা, বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ও মানবিকতার নিদর্শন রেখেছেন সেই একই গুণাবলি দেশের ভেতর ও দেশের সীমানার বাইরে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে। নিজের জীবন দিয়ে ফারাজ তাঁর চরিত্রের এই দিকগুলো প্রকাশ করে গেছেন। ভাগ্য যাঁদের অনুকূলে নেই, তাঁদের এগিয়ে নিতে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাব। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারি নির্মাণে আমাদের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ফারাজের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করে যাব।’

ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল বিনয় দাস বললেন, ‘সাহসিকতা, বন্ধুত্ব আর মানবতার প্রতি ফারাজের মূল্যবোধ সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে ফাউন্ডেশন। শুধু মেডিকেল ক্যাম্প বা চক্ষুশিবির নয়, যেখানেই বঞ্চিত ও অসহায় মানুষ, সেখানেই কাজ করবে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। “শেষমেশ আমরা তো সবাই ফারাজ”।’

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যাচ্ছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের ত্রাণবাহী গাড়ি
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যাচ্ছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের ত্রাণবাহী গাড়ি