শ্বাসরুদ্ধকর আরেক গল্প

>

গুহায় আটকে পড়াদের উদ্ধার অভিযানের প্রস্তুতি চলছিল। ছবি: এএফপি
গুহায় আটকে পড়াদের উদ্ধার অভিযানের প্রস্তুতি চলছিল। ছবি: এএফপি

শেষ বিকেলের আলোটাও বুঝি অপেক্ষায় ছিল। আর তাই দিগন্তে হারালেও সূর্য উঁকি দিচ্ছিল। থাইল্যান্ডের মেঘলা আকাশের কোণে দেখা দিল একটি হেলিকপ্টার। আর তাতেই যেন আনন্দের বান ডাকল পুরো দেশে। সবার মুখে একটাই ধ্বনি, ‘হুররে!’

এ দৃশ্যে স্বস্তি আর সাফল্যের আনন্দ যেন মিলেমিশে একাকার। থাম লুয়াং গুহায় আটকে পড়া ১২ জন কিশোর আর তাদের কোচকে উদ্ধারে কয়েক দিন ধরে চলা শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের সাফল্যের খবর যেন বাতাসে ডানা মেলল ওই হেলিকপ্টারের সঙ্গেই।

থাইল্যান্ডের এ ঘটনা নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে দুটি ঘটনার। একটি ঘটেছে ২০১০ সালে চিলিতে। অপরটি ৪৬ বছর আগে, ১৯৭২ সালে—আন্দিজ পর্বতমালায়। এর সঙ্গেও চিলির নাম জড়িয়ে।

২০১০ সালের ৫ আগস্ট চিলির একটি সোনার খনিতে দুর্ঘটনায় ভূগর্ভে আটকা পড়েন ৩৩ জন খনিকর্মী। খনির প্রবেশমুখ থেকে ৫ কিলোমিটার ভেতরে এবং ভূপৃষ্ঠের ২ হাজার ৩০০ ফুট গভীরে ৬৯ দিন আটকে থাকার পর উদ্ধার হন ওই খনিকর্মীরা। প্রথম ১৭ দিন পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না তাঁদের। উদ্ধারকর্মীরা খনিতে অনুসন্ধান চালানোর একপর্যায়ে ভূগর্ভে খনিকর্মীদের একটি চিরকুট পান। আর তার সূত্র ধরেই খুঁজে পাওয়া যায় তাঁদের।

গুহায় আটকে পড়া কিশোর ফুটবলারদের জন্য শুভ কামনায় থাইল্যান্ডের একটি স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থী। ছবি: এএফপি
গুহায় আটকে পড়া কিশোর ফুটবলারদের জন্য শুভ কামনায় থাইল্যান্ডের একটি স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থী। ছবি: এএফপি

তবে ১৯৭২ সালের ঘটনাটি সবচেয়ে মর্মান্তিক। চিলির আমন্ত্রণে পরিবারের সদস্য, সমর্থক ও বন্ধুদের নিয়ে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর উড়াল দিয়েছিলেন উরুগুয়ের ১৯ জন রাগবি খেলোয়াড়। আন্দিজ পর্বতমালা অতিক্রমের সময় উড়োজাহাজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অনভিজ্ঞ কো-পাইলট ভেবে বসলেন, তাঁরা চিলিতে পৌঁছে গেছেন। উত্তর দিকে ঘুরে বিমানবন্দর ভেবে একটি জায়গা লক্ষ্য করে নামতে শুরু করলেন তিনি। পর্বতের গায়ে বিধ্বস্ত হলো উড়োজাহাজটি। ৪৫ জন আরোহীর ২৭ জনই মারা পড়লেন। দুর্ঘটনার ১০ দিনের মাথায় তাঁদের উদ্ধারে শুরু হওয়া অভিযান স্থগিত করা হয়। ক্ষুধা আর মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে কয়েকজন মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাকি সঙ্গীদের আহার জোগাতে নিজেদের দেহ উৎসর্গ করলেন তাঁরা। এরই মধ্যে শুরু হলো হিমবাহের ধস। যে ফিউজিলাজে আশ্রয় নিয়ে এত দিন বেঁচে ছিলেন ওই যাত্রীরা, তার ওপরই আছড়ে পড়ল হাজার হাজার মণ বরফ। মারা গেলেন আরও আটজন। শেষে দুজন যাত্রী সাহায্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন সেখান থেকে। দুর্ঘটনার ৭২ দিন পর উদ্ধার পেলেন শেষ পর্যন্ত টিকে যাওয়া ১৬ জন।

গুহায় যাওয়ার আগে কিশোর ফুটবলারদের দলীয় ছবি
গুহায় যাওয়ার আগে কিশোর ফুটবলারদের দলীয় ছবি

থাইল্যান্ডের শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনাটির শুরু গত ২৩ জুন। ওই দিন থাম লুয়াং গুহায় প্রবেশের পর নিখোঁজ হয় মু পা (ওয়াইল্ড বোর) ফুটবল দলের ১২ খুদে সদস্য ও তাদের সহকারী কোচ। টানা নয় দিন কেটে যায় গুহার নিকষ অন্ধকারে। ২ জুলাই তাদের সন্ধান পান ব্রিটিশ ডুবুরি রিচার্ড স্ট্যানটন ও জন ভলানথেন। সে সময় কিশোরদের অবস্থান থাম লুয়াং গুহার প্রবেশমুখ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার ভেতরে। ওই জায়গাটা পর্বতের চূড়া থেকে প্রায় এক কিলোমিটার গভীরে।

গুহাটির পুরো নাম থাম লুয়াং নাং নন। এর অর্থ, ‘ঘুমন্ত নারীর বিশাল গুহা’। কথিত রয়েছে, এক রাজকুমারী সাধারণ এক মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু রাজপরিবার তাঁদের বিয়েতে রাজি হয়নি। ক্ষোভে-অভিমানে রাজকুমারী আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পর তাঁর দেহটা নাকি পর্বতে পরিণত হয়। সেই পর্বতেই থাম লুয়াং গুহা।

থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় পার্বত্য এই গুহার দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার। দেশটির উত্তরাঞ্চলে চিয়াং রাই প্রদেশের পং ফা গ্রামের কাছে থাম লুয়াং বনে এর অবস্থান। গুহার ভেতর নানা প্রকোষ্ঠ আর সংকীর্ণ-প্রশস্ত পথ একে দুর্গম করে তুলেছে। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম এক কিলোমিটার পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। কিন্তু বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেলেই এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

চলছে উদ্ধারকাজ
চলছে উদ্ধারকাজ

আটকে পড়া ওই ১৩ জনকে উদ্ধারে পাহাড়ের গায়ে শতাধিক গর্ত খোঁড়া হয়েছে। সরবরাহ করা হয়েছে অক্সিজেন। থাই সেনা ও নৌবাহিনীর পাশাপাশি সহস্রাধিক স্বেচ্ছাকর্মী উদ্ধারকাজে অংশ নেন বলে জানিয়েছেন চিয়াং রাইয়ের গভর্নর ও উদ্ধার অভিযানের প্রধান নারংসাক ওসোত্তানাকর্ন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, কানাডা, লাওস, মিয়ানমার, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিশেষজ্ঞ ডুবুরি ও উদ্ধারকর্মীরা যোগ দেন।

উদ্ধার অভিযান সম্পর্কে নারংসাক ওসোত্তানাকর্ন বলেন, কিশোরদের অবস্থান জানার পর দ্রুতই সেচকাজ শুরু করা হয়। ঘণ্টায় প্রায় ১৬ লাখ লিটার পানি সেচ করা হয়েছে। ৫ জুলাই পর্যন্ত সেচের পর পানির উচ্চতা দেড় সেন্টিমিটার কমে আসে। কিন্তু পরদিন, ৬ জুলাই দেখা গেল, গুহায় অক্সিজেনের পরিমাণ কমে আসছে। এ দিন কিশোরদের অক্সিজেনের বোতল দিয়ে ফেরার পথে নিজের অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে প্রাণ হারান থাই নেভি সিলের সাবেক ডুবুরি সামান গুনান। ৮ জুলাই গুহার বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে ১৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এদিকে ভারী বর্ষণ তো চলছিলই, তার সঙ্গে ঝড় ধেয়ে আসছে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যায়। উপায় না দেখে ওই দিনই শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। সেদিন চার কিশোরকে গুহা থেকে বের করে আনা হয়। পরদিন ৯ জুলাই উদ্ধার করা হয় চারজনকে। আর ১০ জুলাই শেষ দিনের অভিযানে উদ্ধার করা হয় অবশিষ্ট চার কিশোর ও তাদের কোচকে।

একটি স্কুলের দেয়ালে আটকে পড়া কিশোরদের ছবি
একটি স্কুলের দেয়ালে আটকে পড়া কিশোরদের ছবি

নারংসাক ওসোত্তানাকর্ন সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধার অভিযান শুরুর আগে গুহার বিভিন্ন জায়গায় অক্সিজেনের বোতল স্থাপন করা হয়। প্রবেশমুখ থেকে কিশোরদের অবস্থান পর্যন্ত বাঁধা হয় মোটা রশি। সঙ্গে গুহার ভেতরে ও বাইরে সমানতালে সেচকাজ চলছিল।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৮ জুলাই গুহার ভেতর ঢুকলেন ১৯ জন ডুবুরি। সবার আগে রইলেন অস্ট্রেলীয় অ্যানেস্থেসিস্ট ও গুহায় ডুবুরি হিসেবে পারদর্শী রিচার্ড হ্যারিস। তাঁর কাজ ছিল কিশোরদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, উদ্ধারের জন্য চিহ্নিত কিশোরকে হালকা মাত্রার স্নায়ুচাপ নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ প্রয়োগ করা।

উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে নিহত ডুবুরি সামান গুনানের মৃতদেহ আনা হচ্ছে
উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে নিহত ডুবুরি সামান গুনানের মৃতদেহ আনা হচ্ছে

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন কমান্ডার ম্যাকউওয়েন বলেন, উদ্ধার অভিযানের অংশ হিসেবে ২০ টনের মতো সরঞ্জাম গুহার ভেতর ঢোকানো হয়েছে। তিনি এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের জন্য ভাগ্যকেও ধন্যবাদ দিতে চান। ভাগ্য যে সহায়ক ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে উদ্ধার অভিযান সফলভাবে শেষ হওয়ার পরপরই। আটকে পড়া ১৩ জনকে উদ্ধারের পর সবশেষে বেরিয়ে আসেন থাই নেভি সিলের চার সদস্য। আর তার পরই পানিসেচের মূল পাম্পটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।

উদ্ধারের পর চলছে িচকিৎসা
উদ্ধারের পর চলছে িচকিৎসা