আমিরী জলসায়

>

যুক্তরাজে্য আমীর উদ্দিন আহমদের জলসা। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাজে্য আমীর উদ্দিন আহমদের জলসা। ছবি: সংগৃহীত

‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’, ‘কী সুখে যায় দিন-রজনী, কেউ জানে না’ এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার কারি আমীর উদ্দিন আহমদ। ১৪ বছর পর সম্প্রতি দেশে এসেছেন। বাউল গানের দুনিয়ার এই জীবন্ত কিংবদন্তির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সুমনকুমার দাশ 

সিলেট শহরে কেবল সন্ধ্যা নেমেছে। দ্রুত কাজ শেষে আমরা বেরিয়ে পড়ি। চালকের আসনে মু. আনোয়ার হোসেন। ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’সহ জনপ্রিয় অনেক গানের গীতিকার প্রয়াত মরমিসাধক গিয়াসউদ্দিন আহমদের বড় ছেলে তিনি। টুকটাক আলাপ করতে করতেই আমাদের গাড়ি শহর ছাড়িয়ে ততক্ষণে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার আলমপুর গ্রামের পথে। গাড়ি চলছে, নির্জনতা জেঁকে বসছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে আমাদের আলাপ। দুজনের আলাপ ওই একজন মানুষকে ঘিরেই। তিনি কারি আমীর উদ্দিন আহমদ। বাউল গানের দুনিয়ায় তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর লেখা গান ‘আমিরী সংগীত’ হিসেবেই জনসমাজে পরিচিত। তাঁর রচিত প্রায় পাঁচ হাজার গানের মধ্যে ‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’, ‘কী সুখে যায় দিন-রজনী, কেউ জানে না’, ‘হে দীনবন্ধু, মম হৃদয়ে এসে হও আবির্ভাব’সহ অসংখ্য গান দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়। শেষ পর্যন্ত দেখা হলো তাঁর সঙ্গে...।

প্রখ্যাত এই বাউলশিল্পী ও গীতিকার ১৪ বছর হলো দেশছাড়া। ২০০৪ সালে উগ্র ধর্মান্ধদের চাপে পড়ে নিজ গ্রাম আলমপুর ছেড়ে যুক্তরাজ্যে বসতি গড়েছেন। অভিমানে আর দেশমুখী হননি। দেশে থাকতে বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিম, দুরবিন শাহ, কামাল উদ্দিন ও সাত্তার মিয়াদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গান করেছেন। ‘মালজোড়া’ গানের আসরে তর্ক-বিতর্ক করে হারিয়েছেন দেশের বাঘা বাঘা সব বাউলশিল্পীকে। পেয়েছেন নেত্রকোনার প্রখ্যাত বাউল-গীতিকার রশিদ উদ্দিন, জালালউদ্দিন খাঁসহ অনেক সাধকের সান্নিধ্য। তাঁর লেখা গান গেয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন দেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা। এখন দেশে না থাকলেও বাউলগানের আসরে তাঁর নাম ঠিকই উচ্চারিত হয়।

আমীর উদ্দিন আহমদ সম্প্রতি দেশে এসেছেন। মাস খানেক নিজ গ্রামে অবস্থান করবেন। সে খবর পেয়েই আমরা আমীর উদ্দিন আহমদের বাড়িতে হাজির হই। তখন রাত সোয়া আটটা। গ্রামের রাত। সুনসান চারদিক। তবে ঘরে পা ফেলতেই দেখি উৎসবের আমেজ। আমীর উদ্দিন আহমদকে দেখতে আসা মানুষ গিজগিজ করছে। একটি কক্ষের মেঝেতে আমীর উদ্দিন বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে রেখেছেন শিষ্য-দর্শনার্থীরা।

মু. আনোয়ার হোসেনকে তিনি আগে থেকে চেনেন। কক্ষে ঢোকার পর তাই আলাপ জুড়তে সময় লাগল না। এক কথা-দুকথায় স্মৃতির বন্দরে হাজির হন আমীর উদ্দিন আহমদ। তিনি বলতে থাকেন শাহ আবদুল করিম, দুরবিন শাহ, কামাল উদ্দিনের সঙ্গে এক মঞ্চে গান গাওয়ার নানা স্মৃতি। সিলেট অঞ্চলের বিখ্যাত মালজোড়া গানের বিকাশ ও বিস্তৃতির বিষয়ে কত কথা। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকি। যেমন শুনি তাঁর উত্থান পর্বের কথা।

একটা সময় হাওরাঞ্চলে উকিল মুনশি, জালাল উদ্দীন খাঁ, শাহ আবদুল করিম, দুরবিন শাহ ও আবদুস সাত্তারদের কণ্ঠের দাপট ছিল। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের হলেও আমীর উদ্দিন কেবল কণ্ঠের জোরে ষাটের দশক থেকে অনেকটা তাঁদের কাতারেই স্থান করে নেন। শুরুতে বিভিন্ন মহাজনের গান গাইলেও একসময় তিনি নিজে গান রচনা করে গাইতে থাকেন। সেসব গানও শ্রোতারা দারুণভাবে লুফে নেন। সেই আশির দশকে হাওরাঞ্চলে ফিতায় রেকর্ড করা ক্যাসেটের ব্যাপক কদর ছিল। বিভিন্ন গানের আসরে উপস্থিত হয়ে ক্যাসেট-ব্যবসায়ীরা শিল্পীদের গান সম্মানীর বিনিময়ে রেকর্ড করে নিয়ে আসতেন। পরে সেসব রেকর্ড ক্যাসেট করে গ্রামের হাটবাজারে ছড়িয়ে দিতেন। আর এসব ক্যাসেট সবচেয়ে বেশি তৈরি হতো সুনামগঞ্জের ছাতকের জাউয়া বাজারে। এর ফলে এসবের পরিচিতি ছিল ‘জাউয়া বাজারি ক্যাসেট’ হিসেবে। 

আমীর উদ্দিন আহমদ। ছবি: আনিস মাহমুদ
আমীর উদ্দিন আহমদ। ছবি: আনিস মাহমুদ

‘জাউয়া বাজারি ক্যাসেট’ যেখানে অন্য বাউলশিল্পীদের বছরে কয়েক শ বিক্রি হতো, সেখানে এক আমীর উদ্দিনের গাওয়া গানের ক্যাসেট বিক্রি হতো কয়েক হাজার। তাঁর কণ্ঠের এমনই মোহনীয় জাদু, যা শোনার জন্য আমীরের গানের আসরে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাতেন। তা-ও কিনা টিকিট কেটে! ব্যাপারটা তিনি নিজেই খোলাসা করলেন। একসময় নিছক বিনোদনের উদ্দেশ্যে গৃহস্থ কিংবা গ্রামবাসীদের উদ্যোগে হাওরাঞ্চলে বাউলগানের আসর বসানো হতো। এ ক্ষেত্রে বাউলশিল্পীদের সম্মানীর খরচ আয়োজকেরাই জোগাড় করতেন। তবে কারি আমীর উদ্দিনের ক্ষেত্রে সে নিয়ম বদলে যায়। আমীর উদ্দিনকে প্রচুর সম্মানীর বিনিময়ে নিয়ে আসতে হতো। আশির দশকেই সে সম্মানী কোথাও পঞ্চাশ হাজার তো কোথাও প্রায় লাখ টাকা উঠত। যেহেতু তাঁর কণ্ঠের আকর্ষণে গানপ্রিয় শ্রোতারা ভিড় করতেন, তাই আয়োজকেরাও ভিন্ন কৌশল নেওয়া শুরু করতে থাকেন। রীতিমতো প্যান্ডেল বেঁধে দর্শনীর বিনিময়ে আমীর উদ্দিনের গান শোনানোর আয়োজন তাঁরা শুরু করলেন। সেখানেও ভিড়। দর্শক-শ্রোতাদের জায়গা দিতে আয়োজকদের রীতিমতো ত্রাহি অবস্থা! তবে এ আয়োজনের মাধ্যমে আয়োজকেরাও আর্থিকভাবে লাভবান হতে থাকেন। শিল্পীর সম্মানীসহ অন্যান্য খরচ শেষে লাভের অংশ আয়োজকেরা মিলেমিশে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতেন! গানের আসরকে রীতিমতো ‘সিনেমা হল’ বানিয়ে ফেলেছিলেন কারি আমীর উদ্দিন।

গল্পে গল্পে রাত বাড়ে। বাউলগান, যাত্রাগান, লোক-বাদ্যযন্ত্রসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। সমাজ, দর্শন, ধর্ম, মৌলবাদ নানা বিষয়ে আলাপ করেন। এখন কী নিয়ে ব্যস্ততা—জানতে চাই ৭৫ বছর বয়সী বাউলশিল্পীর কাছে। বললেন, ‘আমিরীসংগীত নামে গানের একটি সংকলন প্রকাশের কাজ চলছে। এর বাইরে পুরো কোরআন শরিফ পয়ার ছন্দে বাংলায় অনুবাদ করার কাজ করছি। প্রায় অর্ধেক অনুবাদ শেষও হয়েছে। যুক্তরাজ্য ফিরে হয়তো পুরোদমে অনুবাদের বাকি কাজ শেষ করতে পারব।’

দেশের মতো যুক্তরাজ্যেও তাঁর অগণিত শিষ্য-অনুসারী রয়েছেন। তাঁরা প্রায় প্রতিদিনই বাসায় ভিড় করেন। বললেন, ‘তাঁদের নিয়ে গানচর্চা করি। দিন কেটে যায়। বয়সের কারণে আগের মতো মঞ্চে সেভাবে গান গাইতে পারি না।’ একেবারেই যে মঞ্চ ছেড়েছেন এমনটি নয়। ভক্তদের অনুরোধে কিছু কিছু আসরে হাজির হন। এই বয়সে এসেও তাঁর গানের কণ্ঠে মোহাবিষ্ট থাকেন বাংলা ভাষাভাষী প্রবাসীরা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গান লেখাতেই এখন বেশি মনোযোগ তাঁর। চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। সময় দেন নাতি-নাতনিদের।