ক্ষ্যাপার গানের আলো

ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের আমন্ত্রণে ক্ষ্যাপা ব্যান্ড দলের সদস্যরা গেয়েছিলেন গানা। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের আমন্ত্রণে ক্ষ্যাপা ব্যান্ড দলের সদস্যরা গেয়েছিলেন গানা। ছবি: সংগৃহীত

গানের জগতের নানা খবরে যাঁদের এক-আধটু চোখ রাখার অভ্যাস আছে, তাঁদের অনেকেই হয়তো বালুজি শ্রীভাস্তাভের কথা জানেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই সেতারবাদক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে ২০১০ সালে লন্ডনে গড়ে তোলেন ‘ইনার ভিশন অর্কেস্ট্রা’ নামের একটি গানের দল। নতুন করে আবার তাদের কথা মনে পড়ল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গানের দল ক্ষ্যাপার সঙ্গে পরিচিত হয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দৃষ্টিশক্তিহীন কয়েকজন শিক্ষার্থী গড়ে তুলেছে ক্ষ্যাপা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) যখন ক্ষ্যাপার সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় হয় তখন ভায়োলিন, জিপসি আর তবলাতে সুর তুলছিলেন মীর আজিজুল হক, শিবনাথ কুমার, সুরমান আলীরা। ভায়োলিনের ‘ছড়’, তবলার ডাহিনা বা ডুগি যাদের চোখে দেখা হয়নি, তারাই তাতে সুর তুললেন। সঙ্গে যোগ দিলেন এই দলের আরেক সদস্য নিখিল চন্দ্র। গাইলেন লালনের গান, ‘আমি কাঙ্গাল হবো মেঙ্গে খাবো, রাজ রাজ্যে আর কার্য নাই, আজ আমায় কৌপীন দে গো ভারতী গোঁসাই’।

 ক্ষ্যাপার মূল ভোকাল নিখিল চন্দ্র নাথ। দলের সদস্যদের মধ্যে সেই একমাত্র স্বাভাবিক। বাকি সদস্যদের মধ্যে মীর আজিজুল হক বাজান ভায়োলিন। শিবনাথ কুমার তবলা ও জিপসি বাজান সুরমান আলী।

নিখিল জানান, ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর টিএসসির আড্ডায় বন্ধুদের সঙ্গে গান গাইতেন তিনি। এক বন্ধুর মাধ্যমে তাঁর পরিচয় হয় সুরমান আলীর সঙ্গে। আর নিখিলের হল-জগন্নাথ হলে পরিচয় হয় শিবনাথের সঙ্গে। শিবনাথ পরিচয় করিয়ে দেন আজিজুলের সঙ্গে। কয়েক মাসের ব্যবধানে গানের সূত্র ধরেই এই মানুষগুলো একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হন। নিখিলের গানের আড্ডাও তখন শুরু হয় নতুন করে। আগের বিচ্ছিন্ন আড্ডা তখন পরিণত হয় লোকগানের আসরে। গানের দল গড়ে তোলার ভাবনাও শুরু হয় তখন থেকেই।

কিন্তু লোকগানের দলের নাম ক্ষ্যাপা কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর দিলেন আজিজুল ও সুরমান। বলেন, ‘দৃষ্টিহীনতা আমাদের সীমাবদ্ধতা বটে। কিন্তু আমরা এটিকে উতরাতে পেরেছি। গানকে আমরা ভালোবাসি। এখন এই গান দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আড়ালে থাকা বাংলা লোকগানকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা উতরিয়ে গানের প্রতি আমাদের প্রেষণা বোঝাতেই এই নামকরণ।’

২০১৭ সালেই গানের দল হিসেবে যাত্রা শুরু করার পর ক্ষ্যাপা এরই মধ্যে গান করেছে ঢাকা, জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে মার্কিন দূতাবাসে।

দৃষ্টিহীনতা যেখানে হার মেনেছে

ক্ষ্যাপার সদস্যরা পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে। এর মধ্যে সুরমান আলী পড়ছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষে। মীর আজিজুল হক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষে এবং পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন শিবনাথ কুমার। অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন নিখিল।

এই শিল্পীদের কেউ গান শিখেছেন স্কুলে আবার কারও হাতেখড়ি পরিবারে। সবারই রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। শব্দ শুনে ফেসবুক ও অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করতে পারেন তাঁরা। 

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া পর্যন্ত দৃষ্টি ছিল তবলাবাদক শিবনাথ কুমারের। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে পৃথিবীর আলো ঝাপসা হতে থাকে শিবনাথের। সম্পূর্ণরূপে শিবনাথের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় ২০০৪ সালে।

শিবনাথ বলছিলেন, ‘পরিবারে সেই একমাত্র দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। নাটোরের লালপুরের যাত্রা দলে গান গাওয়া বাবা চিকিৎসাও করাতে পারেননি বেশি দিন। গ্রামে পড়াশোনার সুযোগ না থাকায় বাবার সঙ্গে শিবনাথও যোগ দেন যাত্রার দলে। সেখানেই সংগীতের হাতেখড়ি তাঁর। বাবা গান গাইতেন আর তবলা বাজাতেন শিবনাথ। বছর দুয়েক এভাবে কাটানোর পর রাজশাহীর পিটিসি সেন্টারে (দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্কুল) শিবনাথকে ভর্তি করান তাঁর বড় ভাই। সেখানকার স্কুলেই ছিল গান শেখার সুবিধা। শিবনাথের গানের তালিমটাও হয়ে যায় সেখানেই।

একই জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার সুরমান আলীর গল্পটাও আলাদা নয়। কৃষক পরিবারে একমাত্র দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুরমানের কাছে পৃথিবীর আলোর রং একেবারেই অদেখা। শিবনাথের মতো তাঁরও হাতেখড়ি পিটিসি সেন্টারে। সুরমান বলেন, ‘বাড়িতে থাকার সময় বাবা গান শোনাতেন। সেখান থেকেই গানের প্রতি ভালো লাগা। আর স্কুলে গান শেখার পাশাপাশি রেডিওতে গান শুনতাম। তখন আমারও ইচ্ছা করত এভাবে গান গাওয়ার।’

শিবনাথ ও সুরমানের গল্প শোনার সময় পাশে বসে ভায়োলিনে সুর তুলছিলেন মীর আজিজুল হক। আজিজুল বলেন, ‘ভায়োলিনের সুর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। বিষাদের সুর যেন আমার মনের কথা বলে।’

জন্মের পর বেশি দিন স্থায়ী হয়নি আজিজুলের দৃষ্টি। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা কাজ করেন ঢাকার একটি পত্রিকায় টাইপরাইটার হিসেবে। বাসার টেলিভিশনে বাজা ভায়োলিনের সুর টানত আজিজুলকে। কিন্তু মিরপুরের পিটিসি সেন্টারে গান শেখার সুবিধা থাকলেও ছিল না ভায়োলিন শেখার ব্যবস্থা। অন্য কারও কাছে শিখতে চাইলেও কেউ শেখাতে আগ্রহ দেখাতেন না। তাই বাবার কাছে থেকে ভায়োলিন কিনে বাজাতে শিখেছেন নিজের চেষ্টায়। আজিজুল বলেন, ‘প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মালে পরিবারের চিন্তার শেষ থাকে না। অন্যরাও ভালোভাবে দেখে না। কিন্তু সহযোগিতা পেলে আমরাও ভালো কিছু করতে পারি।’

নিজেরা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছেন। তাই এখন চাওয়া গানের জগতে অবদান রাখা। বিশেষ করে গানের জগতে যাঁরা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেছেন, তাঁদের লেখা বা গাওয়া গানকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।

নিখিল, আজিজুল, সুরমানদের এই তাড়নার গল্প শুনে আবারও মনে পড়ল বালুজি শ্রীভাস্তাভের কথা। নিজে দৃষ্টিহীন। কিন্তু সেটি যে তাঁর সীমাবদ্ধতা নয়, তা প্রমাণ করতেই ২০১০ সালে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আরও কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন গানের দল। উদ্দেশ্য ছিল, দৃষ্টিহীন সবার মাঝে এই আত্মবিশ্বাস দেওয়া—চাইলে তারাও সবকিছু করতে পারে। কাজের মাধ্যমে জ্বালাতে পারে নতুন আলো। সুরমান, আজিজুল, শিবনাথরা হয়তো সে আলোরই দিশারি।