ভয়ংকর এক সন্ধ্যায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সম্ভবত ১৯৯৭ সালের দিকের ঘটনা। কিছুদিন হয়েছে আমরা নতুন এলাকায় নিজেদের বাসায় এসে উঠেছি। বাসায় ওঠার পরের দিনই আব্বা আমাদের রেখে সৌদি আরব নিজের কর্মস্থলে ফিরে গেলেন।

নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। পরিচিত মানুষজন হাতে গোনা। আমার ছোট ভাইয়ের বয়স তখন তিন কি সাড়ে তিন বছর। দুই ভাইবোনই ছিলাম খুব চঞ্চল। প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই আম্মার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসার বাইরে মাঠে খেলতে চলে যেতাম। তবে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফিরে আসতাম। কিন্তু একদিন ঘটল তার ব্যতিক্রম।

আমরা দুজন বাসা থেকে একটু দূরে প্রতিবেশী এক বড় আপার বাসায় টিভিতে কার্টুন দেখতে বসে গেলাম। আমি কার্টুন দেখায় মগ্ন, কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম ছোট ভাইটা পাশে নেই। এদিক-ওদিক তাকালাম, কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না। হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠল। এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মাগরিবের আজান তখন হয়ে গেছে, চারদিক অন্ধকার হতে শুরু করেছে। গোধূলির আবছা আবছা আলোয় এদিক-ওদিক পাগলের মতো ছুটতে শুরু করলাম। অনেক ঘুরেও কোথাও ওকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভয়ে শির শির করে উঠল শরীর। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। তবু ছুটতে থাকলাম উন্মাদের মতো।

আশপাশে কোথাও খুঁজে পেলাম না তাকে। কিছু বোঝার ক্ষমতা তখন আমার ছিল না। হঠাৎ দূর থেকে অস্ফুট কান্নার শব্দ ভেসে এল কানে। চমকে উঠলাম। আন্দাজ করতে পারছিলাম না, কান্নার শব্দটা কোথা থেকে ভেসে আসছে। আরেকটু সামনে এগোতে শুনতে পেলাম কেউ চিৎকার করে ‘আম্মা’ ‘আম্মা’ ডেকে কান্না করছে।

আমাদের বাসার রাস্তাটা ছিল ছোট একটা কালভার্টের পাশে। কালভার্টের নিচ দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যায়। আমি দৌড়ে কালভার্টটির ওপরে এসে থমকে দাঁড়ালাম। ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দেখি আমার ভাইটা কিছু ঘাস দুই হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে আর তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে কান্না করছে। তাকে এ অবস্থায় দেখে ভয়ে ছম ছম করে উঠল গা। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। ধপ করে বসে পড়লাম কালভার্টের ওপরই। দুরু দুরু বুকে অস্ফুট কণ্ঠে ওর নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম। সে বিবর্ণ মুখে তাকাল আমার দিকে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে তুলে আনি ওকে কিন্তু মনে সাহস সঞ্চয় করতে পারছিলাম না। কারণ, আমিও তখন সাঁতার জানি না। বিমূঢ় বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। কান্না করব নাকি ওকে সাহস দেব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আশপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না যে কারও কাছে সাহায্য চাইব। আবার বাসায় এসে আম্মা বা ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসব সেই সাহসও পাচ্ছিলাম না। কারণ, ততক্ষণে আমার ভাইটা হয়তো পানির স্রোতে ধাক্কা সামলাতে না পেরে ডোবাতে পড়ে যাবে। অন্ধকার ঘন হচ্ছে ক্রমশ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মানুষের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। অসহায়ভাবে চুপ করে বসে রইলাম। শূন্য চোখে ওর দিকে তাকিয়ে নিজেই কান্না করতে লাগলাম আর ও কাঁদতে কাঁদতে ক্রমশ অবসন্ন হয়ে পড়ছিল।

আচানক দেখলাম এক লোক দৌড়ে এসে আমার ভাইকে অর্ধচেতন অবস্থায় কোলে করে পানি থেকে ওঠাচ্ছে। মনের ভেতর অদ্ভুত এক আনন্দ অনুভব করলাম। তাকে কোলে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওকে জোরে ঝাঁকুনি দিলাম ও নির্বিকার দৃষ্টিতে আমাকে জড়িয়ে কান্না করতে লাগল। মনে হলো বিধাতা আমার ভাইটাকে একটি নতুন জীবন দান করলেন। বড় হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম যে লোকটা তাকে উদ্ধার করল, সে আমাদের পরিচিত বাদাম বিক্রেতা। আজ অবধি সে সন্ধ্যার কথা মনে পড়লে শিউরে উঠি। সে সন্ধ্যায়, সেই বাদামওয়ালার আগমন আর আমার ভাইয়ের ফিরে আসা আমার কাছে আজও অবিশ্বাস্য মনে হয়।

হুসনে আরা শিরিন

সোনাডাঙ্গা, খুলনা।