ওরা এখন পরিবারের বোঝা নয়

প্রতবন্ধী বিদ্যালয়ে চলছে অনুশীলন। ছবি: লেখক
প্রতবন্ধী বিদ্যালয়ে চলছে অনুশীলন। ছবি: লেখক

ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল, ফ্লোর হকিসহ আরও নানা ধরনের খেলায় যুক্ত তারা। কারও কারও কৃতিত্বে স্কুলের নামের পাশে জমা হয়েছে বেশ কিছু অর্জন। আবার স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে, এমন শিক্ষার্থীও পাবেন সরিষাবাড়ী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে।

এ বছর ১৪ থেকে ২১ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে হয়ে গেল বিশেষ অলিম্পিক। এতে সরিষাবাড়ী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের ১২ জন খেলোয়াড় অ্যাথলেটিকস, ব্যাডমিন্টন, নারীদের হ্যান্ডবল, সাঁতার ও ফুটবলে অংশ নেয়। ১১টি খেলায় বাংলাদেশের অর্জন ছিল ২২টি স্বর্ণ। এর মধ্যে সরিষাবাড়ী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের সাগর আলী ও ফারুখ হোসেন অ্যাথলেটিকসে দুটি এবং রিয়া আক্তার ও খালেদা আক্তার নারী হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দুটি স্বর্ণ জয় করে ফিরেছে।

সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা গেল, এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। কারও বাবা ভ্যানচালক, কারও বাবা বর্গাচাষি, কারও বাবা দিনমজুর। ভালো জামাকাপড় দূরের কথা, দুবেলা খাবারই জোটে না অনেকের। সন্তানদের এই অর্জন তাঁদের জন্য বড় পাওয়া।

সোনাজয়ী খেলোয়াড় সাগর আলীর বাবা ময়নাল মিয়া। তিনি সরিষাবাড়ী উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের দামোদরপুর গ্রামে কৃষি কাজ করেন। বললেন, ‘বিদেশ থাইকে ছেলে আমার খেইলে সোনা আনছে। আমরা খুশি হয়েছি।’ শিমলাবাজারের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেটার আশরাফুল আলমের বাবা আসর উদ্দিন বলেন, ‘ছেলে আর এখন আমার কাছে বোঝা না। আমি এখন গর্বিত পিতা।’ আরেক বিশেষ খেলোয়াড় মিষ্টি আক্তারের বাবা বগারপাড় গ্রামের মুজিবুর রহমান বললেন, ‘জন্মের পর মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। সব চিন্তা দূর করে মেয়ে আমার ঘর আলোয় ভরে দিছে।’

অর্জনের ১৯ বছর
২০০৭ সাল থেকে নিয়মিতই যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, আবুধাবিসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পুরস্কার এনেছে সরিষাবাড়ীর এই বিশেষ খেলোয়াড়েরা। নিয়মিত অনুশীলন তাদের এই অর্জনে সহায়তা করেছে। প্রতিদিন চলে প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সরিষাবাড়ী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এদের নিয়ে আশায় বুক বেঁধে আমরা প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলাম। পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি—এই কথার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। প্রতিবছর আমাদের ছেলেমেয়েরা বিশ্বের নানা প্রান্তে খেলতে যায়, পদক নিয়ে ফিরে আসে।’ তবে স্কুলটির মাঠ নিচু হওয়ায় অনুশীলন চালিয়ে যেতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। বছরের ছয় মাসই পানি জমে থাকে মাঠে। প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সরিষাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানালেন, শিক্ষার্থীদের এই অর্জনে সরিষাবাড়ীবাসী গর্বিত। মাসে এক দিন দুপুরবেলা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়।

২০০০ সালে সরিষাবাড়ী পৌরসভা কার্যালয়ের উল্টো দিকে স্থাপিত হয় বিদ্যালয়টি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এটি দেখাশোনা করে। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম তদারকি করে বেসরকারি সংস্থা সুইড বাংলাদেশ। সংস্থাটির জাতীয় কমিটির মহাসচিব জওয়াহেরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে অনুমতিপ্রাপ্ত ৭০টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের মধ্যে সরিষাবাড়ী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের খেলোয়াড়েরা দেশ-বিদেশে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই বিদ্যালয়ে এখনো অবকাঠামোগত ও খেলাধুলার সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সহায়তা পাওয়া গেলে ছেলেমেয়েরা সামনে আরও ভালো করতে পারবে।’