লালমনি এক্সপ্রেস

চারদিকে অপেক্ষমাণ যাত্রীর জটলা। সময় মেনে লালমনি এক্সপ্রেস আসেনি। এতে আমার যে খুব বেশি রাগ হচ্ছে তা নয়। যে কাজে বের হয়েছি তার জন্য এক-দুই ঘণ্টা অপেক্ষা কোনো কষ্টই না। তা ছাড়া স্টেশনে সময় কাটাতে আমার ভালোই লাগে। কত মানুষ আসে, যায়। কত রঙের, কত ঢঙের মানুষ। কেউ জানালা দিয়ে মুখ বের করে প্রিয়জনদের বিদায় জানায়। কেউবা যানজটে আটকে থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম দেখে।

হঠাৎ পাশ থেকে একজন বললে, ‘ভাই লালমনি কি আজকা আর আসবে?’ আমি কিছু না বলে তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। তিনিও যেন উত্তর পেলেন। রাত ১২টা দেখেছি বেশ কিছুক্ষণ হলো।

ঠিক তখনই লালমনি এক্সপ্রেস আসার ঘোষণা এল মাইকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবে লালমনি।

ভাবছি, ট্রেনে উঠেই আয়েশ করে বসতে হবে। যদিও শেষ মুহূর্তে টিকিট করার কারণে জুটেছে শোভন শ্রেণির টিকিট। কতটা আয়েশ করে বসতে পারব, তা নিয়ে একরাশ সন্দেহ উঁকি দিল। প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি বলে কথা। কোনো কষ্টই কষ্ট নয়।

লালমনি এক্সপ্রেস এল। ট্রেনে উঠেই হতাশ হলাম। আসনটা টয়লেটের কাছাকাছি। ট্রেন ছাড়ার পর যাত্রীর ভিড়ে এমন অবস্থা হলো, পা সোজা করে রাখা তো দূরের কথা, ভাঁজ করে রাখাও কঠিন হয়ে গেল। পায়ের কাছেই মানুষজন বসা। পা নাড়ালেই কারও না কারও গায়ে লাগছে।

ট্রেন চলছে হেলেদুলে। যান্ত্রিক আওয়াজের সুরে। যাত্রীদের কেউ ঘুমে। কেউবা গল্পে। কেউ মোবাইলে। কেউ নীরবে। আর আমি? দেখছি তাদের। সবাই যদি কাজ করে, তাহলে সেই কাজ করা দেখবে কে? আমি সেই কঠিন কাজ করে চলেছি। ট্রেনে সব সময় এমন কিছু যাত্রী থাকবে, যাদের কাজ হলো ট্রেনের এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো। তাদের অধিকাংশের মধ্যে এই কাজের পেছনে মন্দ কারণ থাকে শুনেছি। ফাঁকা বা অল্প ভিড়ে এমন কাজ হজম করা যায়। এমন ভিড়ের মধ্যে এসব দেখলে খুবই রাগ হয়। তবে আমার রাগে কার কী আসে যায়?

স্টেশনে ট্রেন থামছে। যাত্রী নামছে, উঠছে। আবার ট্রেন চলছে। বগিতে একটা পরিবার উঠছে, সবাই শান্তগোছের। শুধু সেই পরিবারের একজন মুখ কালো করে আছেন। তাঁকে দেখে আম্মার কথা মনে পড়ে গেল। আম্মাকে বাসে যাওয়ার কথা বললেও তাঁর এমন অবস্থা হয়।

দেখতে দেখতে ট্রেন টাঙ্গাইল স্টেশনে এসে গেল। বিরতি শেষে আবার নড়তেও শুরু করল। ট্রেনের গতি বাড়তে শুরু করেছে। চোখটা মনে হয় একটু বিরাম চাচ্ছিল। হঠাৎ নারীকণ্ঠের আর্তচিৎকার, ‘আমার ব্যাগ নিয়ে গেল, চোর আমার ব্যাগ নিয়ে গেল।’ চমকে চোখ মেলে দেখি, যে পরিবারের কথা বলছিলাম, সেই পরিবারের বড় মেয়েটাই চিৎকার করছে। জানালা দিয়ে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখি, লুঙ্গি পরা দুটো লোক দৌড়োচ্ছে। তাদের একজনের হাতেই ব্যাগটি ঝুলছে। কারও কিছুই করার নেই।

কেবিনের মধ্যে ততক্ষণে হইচই শুরু হয়ে গেছে। নানাজনের নানা মত বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই করতে হতো, ওই করতে হতো—অনেকে পরামর্শ দিতে থাকল। কেউ বলল—এভাবে কেউ জানালা খোলা রাখে? অনেকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী কী ছিল ব্যাগে?

আমি হতাশ চোখে পরিবারটার সদস্যদের দেখছি। কর্তামশাই কথা বলছেন না। মেয়েটা ভয়াবহ ভয় আর অনুশোচনা নিয়ে তার মাকে ধরে আছে। মনে হয় টাকা ছিল ব্যাগে। আমার যেহেতু কিছু করার নেই, তাই আবার চোখটা বুজলাম।

‘আম্মা, আম্মা, চোখ খোলো আম্মা।’ মেয়েকণ্ঠের আর্তনাদে আবার চমকে চোখ মেলি। মহিলাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। তার চোখ বন্ধ হয়ে আছে। প্রায় আধঘণ্টা পর তিনি চোখ খুললেন, কিছুটা স্বাভাবিক হলো। তখন জানা গেল আসল কাহিনি। মেয়ের বিয়ের কেনাকাটা উপলক্ষে তাঁরা ঢাকা আসছিলেন। কেনাকাটা সেরে বাসায় ফিরছেন এখন। আর ওই ব্যাগটাতে ছিল সেই মেয়ের বিয়ের গয়না।

একসময় সবাই আবার আগের মতো হয়ে গেল। বগিজুড়ে হইচই শুরু হলো। চুপ হয়ে রইল শুধু পরিবারটা।

জুয়েল মাহমুদ শের

ঢাকা