'আলিফ-লায়লা'

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

তখনো সন্ধ্যা নামেনি, এরই মধ্যেই আম্মার ডাক, ‘তাড়াতাড়ি ঘরে আয়’। রং-চায়ের সঙ্গে মুড়ি খেয়ে সন্ধ্যায় পড়তে বসা যে কী কষ্টের—আম্মা এ কথা বুঝতেই চাইতেন না। সারা দিন শুধু একই কথা, ‘পড়’, ‘পড়’...।
আর এমনিতেই রং-চা আর মুড়ি আমার দুচোখের বিষ। আম্মাকে যখনই বলি খিদে লেগেছে, তখনই আম্মার ওই এক কথা, ‘যা,
মুড়ি খা।’
ঘণ্টা দেড়েক হু-হা, টো-টা করে উচ্চ স্বরে ইসলাম শিক্ষা বইয়ের মায়ের অধিকার অধ্যায়টা পড়লাম। উদ্দেশ্য একটাই, আজকে আম্মাকে যে করেই হোক খুশি করতে হবে। এই অধ্যায়টা আম্মার খুবই পছন্দ।
বিদেশ থেকে আব্বার পাঠানো সিকো ফাইভ ঘড়ি দেখে নিলাম কখন আটটা বাজে। আগে থেকেই ছোট আপাকে ম্যানেজ করে রেখেছি, যাতে ঘর থেকে আজকে পালাতে সুযোগ করে দেয়। ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়, পরিকল্পনামতো আম্মাকে বললাম, ‘খিদে লেগেছে।’ আম্মার গ্রিন সিগনাল পাওয়ার পরেই ছোট আপাকে হাতের ইশারা দিলাম আমাকে রাতের ভাত খেতে দেওয়ার জন্য। ভাত খেতে খেতে আরেকবার ঘড়ি দেখে নিলাম—পৌনে আটটা।
টিনের চালে ঢিল ছুড়ে বাড়ির এক বন্ধু সংকেত দিল, সে নিরাপদে ঘর থেকে বেরোতে পেরেছে। এখন আমার পালা। ভাত খাওয়ার ঠিক ২০ মিনিট পর, আম্মাকে বললাম, ‘আমার পেটে মোচড় দিয়ে ঘুটঘাট করছে। মনে হয় খাওয়ায় বদহজম হয়েছে।’ আম্মা বলল, ‘তাড়াতাড়ি হারিকেন নিয়ে যা।’ টয়লেটে যেতে সহযোগিতা করবে আমার ছোট আপা। আমাদের গ্রামের টয়লেট তখন ঘর থেকে বেশ দূরে দূরে থাকত। ঘর থেকে বেরিয়ে আমি দৌড় দিলাম, উল্টো দিকে। অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে গা ছমছম করছে। ঝিঁঝিপোকার ডাকেও বুক ধড়ফড় করে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে যেতেই মনে হলো এই বুঝি পেছন থেকে কেউ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপরও কিসের টানে সব ভুলে সামনের দিকে যাচ্ছি। উদ্দেশ্য এলাকার একমাত্র টেলিভিশন মহসিন ভাইয়ের দোকানে গিয়ে বিটিভির আলিফ-লায়লা দেখা।
দোকানের কাছে যেতেই বন্ধুরা তালি দিয়ে আমাকে বরণ করে নিল। রাত আটটার সংবাদ শেষে এখন চলছে বিজ্ঞাপন। কিছুক্ষণ পরই আলিফ-লায়লা শুরু হলো। নড়েচড়ে বসলাম। প্রথমে পাঁচ-ছয় মিনিট দেখাবে গত পর্বের ঘটে যাওয়া ঘটনা।
আলিফ-লায়লা শেষে বাড়ি ফিরলাম। ঘরের দরজা খুলে আমার শোয়ার ঘর দেখে তো মাথায় হাত! বিছানাপত্র, লেপ-তোশক কিছুই নেই। বুঝতে আর বাকি থাকল না, এই শীতের রাতে বিছানাপত্র, লেপ-তোশক ছাড়া ঘুমানোর ব্যবস্থা হলো শাস্তি।
খালি বিছানায় বালিশ ছাড়া শুয়ে নির্ঘুম চোখে অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক করলাম। মনের মধ্যে উঁকি দিতে থাকল মালিকা-হামিরা আর কেহের মানের হু-হা অট্টহাসি। এই হাসিই এখন নিজের কাছে উপহাসের মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর একটু ঘুম ঘুম লাগতেই আম্মা লেপ-তোশক ছুড়ে দিলেন আমার গায়ে, আর আমাকে বকতে লাগলেন, ‘আলিফ-লায়লা দেখোস! আলিফ-লায়লা, আলিফ-লায়লা...।’
রাশেদুল হায়দার
ডুয়েট, গাজীপুর