যখন জ্বর এল

‘৪৩...৪৪...৪৫...।’

‘ইয়েস স্যার। ইয়েস স্যার। ইয়েস স্যার।’

‘৪৬...৪৬...৪৬...’ তিন-তিনবার একই রোল ডাকার পরও কোনো সাড়া না পেয়ে চশমার ওপর দিয়ে সারা ক্লাস একনজর দেখে মোবারক স্যার চোখ-মুখ তিরিক্ষি করে বললেন, ‘কিরে, নুরুজ্জামান আসে নাই?’

নুরুজ্জামান ওরফে নুরু দুষ্টের গুরু, আর মোবারক স্যার ভীষণ বদমেজাজি। নুরুর বিষয়ে কথা বলে পাছে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়, সে জন্য সবাই চুপচাপ বসে রইল। হাজিরা খাতাটা বন্ধ করে স্যার হুংকার ছাড়লেন, ‘এই বদমাইশের দল, নুরা কই?’ এবার কাজ হলো। পেছনের দিক থেকে কেউ একজন বলল, ‘জ্বর আইছে।’

‘জড়াইছে! আবারও জড়াইছে?’ বিড়বিড় করতে করতে মোবারক স্যার নুরুজ্জামান মানে নুরার সাম্প্রতিক কালের সব অপকর্ম মনে করতে লাগলেন, গেল মাসে মণ্ডলবাড়ির ছাগল চুরিতে জড়িয়েছে, তার কদিন বাদে নারকেল চুরিতে জড়িয়েছে, হাঁস-মুরগি চুরির কত ঘটনায় যে জড়িয়েছে সে, তার হিসাব নেই। দুই বছর আগে ঢিল ছুড়ে হাশেম ব্যাপারীর মাথা ফাটানোর ঘটনায় জড়ানোর কথাও স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। মোবারক স্যার ভীষণ বিক্ষুব্ধ। রীতিমতো কাঁপছেন।

নুরার জ্বর হয়েছে—এই সত্যটা সহপাঠীদের সবার জানা। কিন্তু জ্বর হওয়ার খবরে রাগ করার কী আছে, কেউ তা বুঝে উঠতে পারছে না। অবশিষ্ট রোল কল শেষ করে মোবারক স্যার একা একা বলে যাচ্ছেন, ‘এই এক নুরারে নিয়া আর শান্তি পেলাম না। এত কইরা কইছি, খারাপ কাজে জড়াবি না। বদমাইশ আবার জড়াইছে!’

ক্লাস থেকে বেরিয়ে স্যার সোজা গেলেন হেডস্যারের রুমে, ‘স্যার, নুরু আবার জড়াইছে!’

‘কোথায় জড়াইছে?’ হেডস্যারের কণ্ঠেও বিরক্তি।

‘তা শুনি নাই, ক্লাসের ছেলেরা বলছে।’

‘এই বাঁদর ছেলেকে আর স্কুলে রাখা ঠিক হবে না। যত দ্রুত টিসি দিয়ে বিদায় করা যায় ততই ভালো। তবে এক কাজ করি, পরিচালনা কমিটির মিটিং ডেকে সেখানে বিষয়টা উপস্থাপন করি।’ হেডস্যার বললেন।

মোবারক স্যার সায় দিলেন, ‘সেটাই ভালো।’

নুরার বিষয়ে আজ একটা এসপার-ওসপার হবে। স্কুল থেকে নুরুজ্জামানের বাবা তৈয়ব আলীকে খবর পাঠানো হয়েছে। একমাত্র ছেলে ১০৪ ডিগ্রি জ্বরে কাঁপছে, তা নিয়ে তৈয়ব আলীর উদ্বেগের শেষ নেই। তার মধ্যে স্কুল থেকে খবর। লেখাপড়া না জানা তৈয়বের কাছে স্কুল মানে পবিত্র জায়গা, শিক্ষক মানে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। ছেলেটার এই অসুস্থতার সময় তাঁকে কেন ডাকা হয়েছে তার একটা কারণও মনে মনে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন তৈয়ব আলী। নিশ্চয়ই স্কুলের পক্ষ থেকে তাকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে। আশায় বুক বেঁধে অসুস্থ ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলের পথ ধরলেন তিনি।

এক কালের কুখ্যাত কালু ডাকাত পরিচালনা কমিটির সভাপতি। অবশ্য আগের নাম মুছে গেছে, তিনি এখন বিশিষ্ট সমাজসেবক কালু মণ্ডল। পড়াশোনা না বুঝলেও তিনি সভাপতিত্ব বোঝেন। কালু মণ্ডলের সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়েছে। তৈয়ব আলী সেই সভায় উপস্থিত।

তৈয়ব আলীকে দেখামাত্রই সভাপতি গর্জে উঠলেন, ‘আবার জড়াইছে? তা কোথায় জড়াইল?’

কালু ডাকাতকে যতটা না ভয় পেতেন, তার চেয়ে সভাপতি কালু মণ্ডলকে বেশি ভয়ংকর মনে হলো তৈয়ব আলীর কাছে। ভাবনা আর বাস্তবের বিস্তর ফারাক দেখে হতভম্ব তৈয়ব বিড়বিড় করে বললেন, ‘কোথায় আর জ্বর আইবে, গায়ে জ্বর আইছে।’

কালু মণ্ডল যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘গাঁয়ের ছেলে গাঁয়েই তো জড়াইব, সে কি ঢাকা শহরে গিয়া জড়াইব?’

আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেন না তৈয়ব আলী। বললেন, ‘অন্য কথা পরে হইব, জ্বর আইছে, এইটা থেইকা পোলাডারে আগে বাঁচানো দরকার।’

নুরুর ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত মোবারক স্যার তৈয়ব আলীর ওপর ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করলেন, ‘অতি আদরে বাঁদর হয়, নুরাও তা-ই হয়েছে। ছেলে অপকর্মে জড়াইছে আর বাবা হয়া তার পক্ষ নিতাছ তুমি? আজকেই ওরে টিসি দেওয়া হইব। তোমার ছেলেরে তুমি যেইখানে খুশি ভর্তি করাও, এই বাঁদর ছেলের দায় আমরা আর নিব না।’

সবাই তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে নাকি ছেলের প্রচণ্ড জ্বরের কারণে মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না সেটাও বুঝতে পারছেন না তৈয়ব আলী। তাই হাতজোড় করে বললেন, ‘স্যার, আমি লেহাপড়া শিখি নাই, তয় পোলাডারে মানুষ করবার চাই। আপনার পায়ে পড়ি, পোলাডারে টিসি দিয়েন না।’

উপস্থিত সবাই নুরুর বাবাকে যে যার মতো তিরস্কার করলেন। তিরস্কার করা বড়লোকের কাজ আর সেটা হজম করার দায়িত্ব গরিবের। গরিব বাবা তিরস্কার হজম করে আবারও বললেন, ‘জ্বর আইছে, তাতে তো আমার করার কিছু নাই!’

কথা শেষ হতে না হতেই তৈয়ব আলীর দিকে তেড়ে গেলেন পরিচালনা কমিটির এক সদস্য। একদিকে ছেলের অসুস্থতা, অন্যদিকে পরিচালনা কমিটি আর মোবারক স্যারের যৌথ আক্রমণে অসহায় তৈয়ব আলী কেঁদে ফেললেন। অসহায়ের শেষ ভরসা হিসেবে তৈয়ব আলী সভাপতির পায়েও পড়লেন, ‘আমার লগে অবিচার কইরেন না। দরকার হইলে আমারে মাইরা ফালান, কিন্তু পোলাডারে টিসি দিয়েন না!’

তৈয়ব আলীর কাকুতি-মিনতিতে সভাপতির মন কিছুটা নরম হলো। হেডস্যারকে বললেন নুরুকে হাজির করতে। তৈয়ব আলী নুরুকে পাশের রুমে বসিয়ে রেখেছিলেন, সভাপতির নির্দেশমতো গায়ে চাদর জড়ানো নুরুকে সভায় হাজির করা হলো। নুরু কাঁপছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল নুরু ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু তৈয়ব আলীর অনুরোধে কালু মণ্ডল নুরুর কপালে হাত দিতেই হাত যেন পুড়ে গেল। কড়া চোখে মোবারক স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জ্বর আইছে, জ্বর, অনেক জ্বর!’

জ্বলন্ত প্রদীপের ওপর পানি ঢাললে যেমন ধপ করে নিভে যায় তেমনি উত্তপ্ত মোবারক স্যার এক মুহূর্তে নিভে গেলেন। পরিচালনা কমিটির সভাপতি কালু মণ্ডলের চোখেমুখে সাক্ষাৎ কালু ডাকাতের প্রতিবিম্ব। মোবারক স্যারকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘জ্বর নিয়া অযথা ঝামেলায় জড়াইলা ক্যান?’

মোবারক স্যার চড়-থাপ্পড়ের মতো অযাচিত তবারকের আশঙ্কা করতে লাগলেন। তবে সে রকম কিছু হলো না। তাঁকে রুমের বাইরে যেতে বলা হলো। তাঁর চাকরি থাকবে কি থাকবে না, সে বিষয়ে পরিচালনা কমিটির সভায় আলোচনা হবে।

অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তায় মোবারক স্যারের একে একে হাত, পা, কান ও মাথা গরম হলো। তাঁর শরীর কাঁপছে, যেন জ্বর আইছে, ভীষণ জ্বর!