দেখা যাক কে জেতে

‘কী মনে হয় তোমার, আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ পাবে?’

আমি ব্রাজিল সাপোর্টার। এ ধরনের প্রশ্ন সাধারণত একটা ফুৎকারে উড়িয়ে দিই। কফির কাপে ঝঞ্ঝা তুলে বলি, ‘কিসের কী? আর্জেন্টিনা ওই ভলিবল খেলে জিতেছে, আর না! ম্যারাডোনার দিন কবেই শেষ। আর মেসি তো কোনো দিন আর্জেন্টিনারই হয়নি!’

বুকে এসব কথা লকলক করে উঠলেও মুখে বলা গেল না। কারণ, প্রশ্নকর্তা স্বয়ং রিফকার বাবা; আমাকে চা খেতে খেতে সুধালেন। রিফকার মুখে শুনেছি, তিনি বীভৎস রকম আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। রিফকা পইপই করে বলে দিয়েছে, ‘বিশ্বকাপের আগে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছো, খেলা নিয়ে কথা উঠবেই! তুমি কিন্তু কোনোভাবেই বুঝতে দেবে না যে তুমি ব্রাজিল। নাহলে আমাদের বিয়ে তো দূরের কথা, কোনো দিন আর দেখা করাও সম্ভব হবে না!’

: কী হলো, কথা বলছ না কেন? খেলা দেখো না?

: জি।

: মানে কী? সত্যি খেলা দেখো না! তোমাদের হবেটা কী? ফুটবল খেলা যে দেখে না সে আবার তরুণ হয় কীভাবে? তোমার তো মনে হচ্ছে এখনই সব ঘুণে ধরেছে! স্যাড, সো স্যাড!

: না না আঙ্কেল, খেলা দেখি তো!

: কী, ক্রিকেট? ওই ভদ্রলোকের খেলা? শোনো, খেলা কী করে ভদ্রলোকের হয় বলো তো? খেলা হবে ঠেলাঠেলি আর হুড়োহুড়ির!

: জি, তা তো বটেই!

: ফুটবল! নামেই একটা ইয়ে আছে! মানে পা তো আছেই, তার সঙ্গে একটা বেশ কষে লাত্থালাত্থির ব্যাপার আছে! এখানে ওসব ভদ্রলোকগিরি চলে না। কোন দল তুমি?

এই যাহ্‌! এবার বোধ হয় আর সামলানো যাবে না। আমি ব্রাজিল, এটা বলা যাবে না! আবার আমি ব্রাজিল হয়ে আর্জেন্টিনার কথা বললে আমার কি আর কুল থাকবে! আমি বললাম, ‘ওই তো...’

: ওই তো মানে? ব্রাজিল?

: জি? না না না! কী যে বলেন!

এবার রিফকার বাবার মুখে একটা হাসি ফুটল, ‘তাহলে?’

: জিদানকে ভালো লাগত তো...

: ফ্রান্স? আরে ফ্রান্স হলো শিল্পের জায়গা। তারা যে কেন ফুটবলের মতো একটা হাড্ডাহাড্ডিতে ভ্যাবাচেকা খাচ্ছে, বুঝলাম না! তুমি ফ্রান্স করো নাকি?

: না না, আঙ্কেল! ওই জিদানকে ভালো লাগত তো!

: সে তাহলে অন্য কারণে! তোমার মাথাতেও তো দেখছি চুল কম!

: জি? সে হিসেবে তো ব্রাজিলের ওই রোনালদো...!

: ছি ছি ছি! কোথায় কার নাম নিচ্ছো তুমি! রোনালদোকে আজ কেউ মনে রেখেছে নাকি?

: কী বলেন, আঙ্কেল! বিশ্বকাপ কাঁপিয়ে দিয়েছিল! ব্রাজিলকে কয়টা কাপ...

: তুমি ব্রাজিল নাকি তাহলে?

: না না না। কী যে বলেন না আঙ্কেল! সেই দিন আছে নাকি ওদের!

: হুম। একটা জিনিস মনে রাখবে, হলুদ কিছুই ভালো না! কারও দাঁত হলুদ হলে তাকে আমরা কী বলি, অ্যাঁ? বলি, নোংরা! তারপর ধরো হলুদ পদার্থ, ঢাকার জলাবদ্ধতায় যেসব ভেসে বেড়ায়, সেগুলো দেখে গা গুলিয়ে ওঠে না, অ্যাঁ?

: কিন্তু আঙ্কেল, হিমুও তো হলুদ পাঞ্জাবি পরে!

: কী? হিমু? হিমু আবার এর মধ্যে এল কোথা থেকে! এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?

: না না না, আঙ্কেল! কী যে বলেন!

: তুমি তো তোমার দল বললে না এখনো!

: দল! মানে...আসলে...ব্যাজিও...

: ইতালি? এরা যে কখন কী করে! কিন্তু তোমার দল তো এবার বিশ্বকাপেই নাই! আহা রে, তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি! বুকটা খাঁ খাঁ করছে, না?

: না না না, আঙ্কেল! ইতালি তো আমার দল না!

: ইতালি না? তাহলে?

: জার্মানি গতবার কাপ পেয়েছিল তো...

: জার্মানি? ওই হিটলারের দেশ!

: আঙ্কেল, ওই দেশে তো আইনস্টাইনও জন্মেছিলেন।

: তাতে কী? জার্মানির চেয়ে খারাপ কোনো দল আছে নাকি? একেকটা যন্ত্র! দেখোনি, গতবার ফাইনালে ওরা কী করেছিল! কিচ্ছু খেলা পারে না...

: আর তাতেই আর্জেন্টিনা উড়ে গিয়েছিল, আঙ্কেল!

: অ্যাঁ? কী? এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?

: না না না, আঙ্কেল! কী যে বলেন!

: শোনো, রিফকা আমার একমাত্র মেয়ে! আমি আর সে দুজনই আর্জেন্টিনার সাপোর্টার! আমার মনে হয়, এবারের বিশ্বকাপে তোমারও আর্জেন্টিনা সমর্থন করা উচিত! কী বলো তুমি?

: জি...মানে...

: আমি তো ঠিক করেই রেখেছি, রিফকা মায়ের হাত আমি কোনো মেসিভক্তের হাতেই তুলে দেব। মেসির খেলা তোমার কেমন লাগে?

: ভিনগ্রহের খেলোয়াড় তো আঙ্কেল...

: ভালো বলছ না খারাপ বলছ?

: ওই আর কি আঙ্কেল...

: ‘ওই আর কি’ মানে? তুমি জানো, মেসি কেমন খেলোয়াড়! দেখেছ কখনো তাঁর খেলা? ম্যারাডোনার পর এই একটা খেলোয়াড়ই ফুটবল খেলতে পারে। বাকিরা সব বউছি খেলে মাঠের মধ্যে।

: এইটা একটু আঙ্কেল বাড়াবাড়ি বললেন!

: কিসের বাড়াবাড়ি বললাম, অ্যাঁ? মেসিকে তোমার ভালো লাগে না! এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?

: হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ব্রাজিল! আর আমি চিরদিন ব্রাজিলই থাকব! আপনাদের মতো আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করতে পারব না! একটা কথা মনে রাখবেন আঙ্কেল, বিএনপি থেকে দলবদল করে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া যায়, আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে, কিন্তু ব্রাজিল থেকে কেউ কখনো আর্জেন্টিনা হতে পারে না!

: আমি আমার মেয়ের বিয়ে কোনো দিন কোনো ব্রাজিল সমর্থকের সঙ্গে দেব না!

: আমিও চিরদিন সালমান খানের মতো ব্যাচেলর থাকব, আঙ্কেল! বিয়ে করব না, তবু কোনো দিন আর্জেন্টিনা হব না!

মিটিং ভেস্তে গেল। রিফকা কাঁদল বিস্তর। আমি আর রিফকার বাবা তেল-জল হয়ে থেকে গেলাম। দেখা যাক, কে জেতে!