যেখানে দাঁড়াই...

আঁকা: তীর্থ
আঁকা: তীর্থ

আমি যে খুব কাব্য অনুরাগী তা নয়, বরং আধুনিক কবিতার অধিকাংশই আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। তাই কোনো কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে গেলে মিলনায়তনের ওপরের দিকের আসনগুলোতে বসার চেষ্টা করি সব সময়। যদিও তাতে খুব একটা কাজ হয় না। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সবাইকেই যে কবিতার সমঝদার হতে হবে, এমন কোনো কথা তো দেশের আইনে লিপিবদ্ধ নেই (আর থাকলেই বা কী? কত আইনই তো আছে, কে বা কারা মানছে সেসব আইন?)। তবে আমি কবিতা পড়ি। সে পড়ার সংখ্যা অবশ্য খুব বেশি নয় (দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতার ‘গরু মোটাতাজা করতে রাসায়নিক: কর্তৃপক্ষ ভাবছে কী?’-টাইপের মহাগুরুত্বপূর্ণ লেখা পড়ার চেয়ে একটু বেশি), তারপরও কবিতার কিছু লাইন মাথার ব্রাউজিং হিস্টোরিতে থেকে যায়। পরিস্থিতি এলে মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে যায় সেসব কবিতার একটা-দুটো লাইন। তখন মনে হয়, আরে, এ তো আমাকে ভেবে, আমারই জন্য লিখেছেন কবি! যেমন, বাসস্ট্যান্ডে এলেই আমার মনে পড়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ‘যেখানে দাঁড়াই, দেখি ভুল দাঁড়িয়েছি।’ বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না (কারণ, বিশ্বাস ব্যাপারটা আজকাল উঠেই গেছে সমাজ থেকে), কিন্তু এটা সত্যি যে প্রতিবার বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালেই এই কবিতার বাস্তব প্রয়োগ দেখতে পাই আমি।

আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, সাফল্যের চূড়ায় ওঠার চেয়েও বাসে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য। চেষ্টা করলে আপনি হয়তো সাফল্য পাবেন, কিন্তু বাস পাবেন কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার কথাই ধরুন, বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য দাঁড়ানোর আগে অনেক চিন্তাভাবনা করি আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সিটের জন্য যেমন কয়েক শ প্রার্থী, এখানেও তা-ই। শুধু সিট নয়, রড, হ্যান্ডেল কিংবা পা-দানির জন্যও অসংখ্য প্রার্থী অপেক্ষমাণ। সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লড়ে আপনাকে পেতে হবে কাঙ্ক্ষিত সিট। তাই বাসটা ঠিক কোথায় থামতে পারে, তা অনুমান করে জায়গামতো পজিশন নিয়ে দাঁড়াই আমি। তারপর দেখা যায় বাসটি সেখানে না থেমে থেমেছে আরও অনেক সামনে। ততক্ষণে অসংখ্য মানুষ ছুটে গেছে সে বাসের দিকে। ফলে চৌধুরী জাফরউল্লাহ শরাফতের মতো বলতে হয়, ‘এ বাসেও কোনো সিট হলো না।’ পরের বাস, এবারে কিন্তু সামনে গিয়ে পজিশন নিয়েছিলাম আমি। ঠিক যেখানে থেমেছিল আগের বাসটা, সেখানে। এবার হলো উল্টো। চোখের সামনে বাস চলে গেল একেবারে সীমানার বাইরে। ঠিক যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম প্রথমবার। প্রতিবারই একই ঘটনা, যেখানে দাঁড়াই, দেখি ভুল দাঁড়িয়েছি। কে জানে, হয়তো কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেও বাসের জন্য সংগ্রাম করতে হতো, নইলে কবিতার লাইনটা এভাবে মিলে যাবে কেন?

শুধু বাসের লাইনই নয়, আরও অনেক জায়গায় দাঁড়ালেই এই কবিতার কথা মনে পড়ে আমার। ব্যাংকে যখন টাকা জমা দিতে বা তুলতে যাই, দেখি, আমি যে লাইনে দাঁড়িয়েছি, সেটা এগোচ্ছে না একটুও। অথচ পাশের লাইন এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। ঠিক আছে, এখানে তো আর অত ঝামেলা নেই, এগোতে থাকা লাইনে গিয়ে যেই দাঁড়ালাম, কী আশ্চর্য, আবার একই ঘটনা। স্থবির হয়ে গেল এই লাইন, এগোনো শুরু করল সেই লাইন, যেটায় একটু আগেও দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। আবারও যেখানে দাঁড়ালাম, দেখি ভুল দাঁড়িয়েছি!