হলুদ হিমু তামাটে সোনা

মাজেদা খালা বললেন, ‘তোর জানাশোনা কোনো ওঝা আছে?’

হিমু বসে ছিল সোফায়। দেয়ালে একটা বড়সড় টিকটিকি। সেটার লেজ নেই। লেজ যে নেই, এটা নিয়ে তার বিকারও নেই। হিমু বলল, ‘টিকটিকিটা পুরুষ না মহিলা?’

মাজেদা খালা একবার টিকটিকি একবার হিমুর দিকে তাকিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেললেন। মেজাজ হারিয়ে ফেললে মাজেদা খালার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। একবার মেজাজ হারিয়ে খালা ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলেন, পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই। শিবগঞ্জ বর্ডার দিয়ে। বিএসএফদের সঙ্গে ঝগড়া করে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন যে ওরা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ ফর্মে মাজেদা খালাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

ইন্ডিয়া যাঁকে সামলাতে পারেনি, বড় খালু তাঁকে সামলে রাখেন। বড় খালু বললেন, ‘আহ্, তুমি এত উত্তেজিত হয়ো না তো, মাজু!’ বড় খালু আদর করে মাজু বলে ডাকেন খালাকে। এই ডাক শুনলেই হিমুর হাসি পায়।

খালা বললেন, ‘ওই, তুই হাসিস কেন, অ্যাঁ? খালা-খালুকে নিয়ে ফাজলামি করে হাসতে তোর খারাপ লাগে না? তোকে ডেকেছি একটা সমস্যার সমাধান করতে, আর তুই আছিস টিকটিকির জেন্ডার নিয়ে?’

মাজেদা খালার সমস্যা অভিনবই বলা যায়। খালা তাঁর ভল্টে গাদা গাদা অলংকার রাখেন। কারণ একটাই, বাইরের ভল্টে তাঁর বিশ্বাস নেই। হিমু অবশ্য বলে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যই নাকি এই ব্যবস্থা। তবে হিমু বললে তো হবে না। বড় খালু প্রতি বছরই কর দেওয়ার জন্য পুরস্কার পান। গতবার তো পেয়েছেন ‘করপুণ্য শিরোমণি’ পদক! অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে এই সনদ গ্রহণ করছেন এমন একটা ছবি ড্রয়িংরুমে শোভা পাচ্ছে। তার পাশেই লেজহীন টিকটিকিটা ঘাপটি মেরে আছে। পুরুষ না নারী, তা বোঝা যাচ্ছে না।

যা হোক, মাজেদা খালা গত রাতে ভল্ট খুলে দেখেন, তাঁর হাতের বালা, কানের দুল, গলার মালা সবই কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তিনি সেগুলো বের করেন এবং বের করেই পরপর তিনবার ফিট হয়ে যান। তাঁর ভল্টের সব সোনা নিমেষেই যেন তামা হয়ে গেছে। মাজেদা খালা জবান হারিয়ে বিজাতীয় উচ্চারণে অ অ করে স্বরবর্ণে দীর্ঘ সময় আটকে থাকেন। রাত ১০টা থেকে ১২টা খালুর বিশেষ পানীয় পানের সময়। এ সময় ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্টও যদি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তিনি বিরক্ত হন। মাজেদা খালার আর্তিতে তিনি অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। খালাও তাঁর পেছন পেছন বাসা থেকে বেরিয়ে যান। ইতিমধ্যে সোনা তামা হয়ে যাওয়ার খবর প্রথমে মহল্লা, পরে এলাকা, তারও পরে পুরো শহর রাষ্ট্র হয়ে যায়। নানাজন খালা-খালুকে নানা ধরনের কথা বলতে থাকে। খালা-খালু সেসবে কর্ণপাত না করে একটা রাত মনের দুঃখে পাঁচতারা হোটেলে কাটিয়ে সকালে যখন ফিরে আসেন তখন দেখেন বিছানার ওপর রাখা অলংকারগুলো আর তামার নেই, সব সোনার হয়ে গেছে!

এমন ভৌতিক কাজকারবার খালা-খালু আগে কখনো দেখেননি। এই ঘটনার একটা সুষ্ঠু সমাধানের জন্য হিমুকে তঁাদের ডাকা।

খালা বললেন, ‘শোন, একটা ভালো ওঝা নিয়ে এসে ঘরটা খুব ভালো করে ঝাড়া দরকার! হিমু, তোর তো নানা ধরনের মানুষের সাথে পরিচয়। চিনিস না ভালো কোনো ওঝাকে?’

: উত্তর বাড্ডার এক ওঝা আছে। চোখ বন্ধ করে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে।

: আরে ভূত তাড়াতে পারে কি না, সেইটা বল।

: ভূতও তাড়াতে পারে। ভূতসমাজে ওই ওঝার ছবি দেখানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো করে। বড় ভূত ছোট্ট বাচ্চা ভূতদের বলে, ‘ভাঁলো কঁরে দেঁখে রাঁখ, এঁ থাঁকলে চঁটাস কঁরে সঁটকে পঁড়বি!’

: তাই নাকি?

: হুঁম। খুঁবই ডেঁঞ্জারাঁস ওঝাঁ!

: তুই নাকিস্বরে কথা বলছিস কেন?

: উত্তেজনায় খালা। ভূত তাড়াব, তার উত্তেজনা আছে না?

: তুই ওঝাকে এক্ষুনি ডাক! আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি! ঠিকানা দে...

খালা ড্রাইভারকে ফোন করতে শুরু করলেন। বললেন, ‘শোনো, উত্তর বাড্ডা...এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে আসো! কী নাম...কী নাম রে হিমু?’

: রুমাল বাবা।

: রুমাল বাবা? এটা কেমন নাম?

: উনি পোশাক বলতে শুধু একটা রুমাল পরে থাকেন তো, তাই...

: মানে? সারা গায়ে একটা রুমাল?

: খুব বেশি গরম পড়লে অবশ্য সেটাও পরেন না।

: সর্বনাশ! কী বলিস এই সব? এ রকম একটা মানুষ আমার গাড়িতে বসবে নাকি? গাড়ি ডেটল দিয়ে ধুলেও তো আমি আর ওই গাড়িতে কোনো দিন বসতে পারব না!

: তাহলে অটোতে আসুক।

: না না, ওই লোক বাসায় এলে সারা বাসা আমাকে ধুতে হবে!

: কিন্তু এভাবে কি ভূতের সাথে বসবাস করা ঠিক হবে, খালা?

: ধর, এটা ভূত না-ও হতে পারে, অন্য কিছু...এই শোন, তোর মিসির আলীর সাথে পরিচয় আছে না?

: না।

: কী বলিস? তোদের দুজনের তো একই রাইটার! পরিচয় নাই কেন?

: দুয়েকবার দেখা হয়েছে। অত্যন্ত আলাভোলা মানুষ। আমাকে তার মনে নাই।

: তুই নিজেও তো কম আলাভোলা না! বিয়েটা পর্যন্ত করছিস না। এই সমস্যাটা শেষ হলে তোকে একটা বিয়ে দিয়ে দেব।

: হুম। আজকে দিলে অবশ্য তোমাদের মতোই একই তারিখে বিবাহবার্ষিকী হবে। মন্দ হবে না ব্যাপারটা।

: মানে?

: মানে আজকে তোমাদের বিবাহবার্ষিকী, এ জন্যই সোনা তামা হয়ে যাওয়ার নাটক সাজিয়েছ। এই নাটকের কাহিনি শুনে তোমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই বাসায় আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই বাসা গমগম করছে।

: তুই সব সময় সবকিছুতে একটু বেশিই বুঝিস!

: কই আর বুঝলাম! টিকটিকিটা পুরুষ না নারী, তা-ই তো বুঝতে পারলাম না এখনো। তবে এটুকু বুঝেছি, গত রাতে তুমি আর খালু পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে নিশ্চয়ই ৩০ বছর একসঙ্গে থাকার জন্য ছোট্ট একটা কেক কেটেছ।

: তুই যা! তোকে থাকতে হবে না এই বাড়িতে।

: কাচ্চি না খেয়েই চলে যাব? পুরান ঢাকার কাচ্চি! ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে!

: এই সব বুজরুকি করেই তুই তোর এত এত ফ্যান জুটিয়েছিস, না? ফালতুর ফালতু! নিজেদের বিবাহবার্ষিকীতে এমন করে দাওয়াত কে দেয়, অ্যাঁ?

: তোমরা তো দিলে! বাংলাদেশের অন্য মানুষেরাও দেওয়া শুরু করবে নিশ্চয়ই। আসল ঘটনা ঢাকতে এখন জবরজং ঘটনা কত যে দিকে দিকে সাজানো হচ্ছে। আমার কিন্তু দেখতে ভালো লাগে। মনে হয় আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। খালা, আমি তাহলে গেলাম।

হিমু বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে মনে হয়, মুখের ওপর খালার মজাটা নষ্ট করে দেওয়া বোধ হয় ঠিক হলো না। বেচারারা একটু মজা করতে চেয়েছিল...এখন তো কতজনই মজা করছে। খালা-খালু করলেই বা দোষ কী?