তিনটি চারা-গল্প

‘দাদা শোন, জেঠিকে ছাগলে খাইছে আর জ্যাঠা ঝড়ে উড়ে গেছে!’

সকাল সকাল মোবাইল ফোনের রিংটোন শুনে ঘুম ভাঙা খুব বিরক্তিকর। আধা ঘুমন্ত অবস্থায় কানে ফোন নিয়ে বললাম, ‘হ্যালো।’ তখনই এই দুঃসংবাদ। পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে আমারও খানিক সময় লেগেছিল। ‘জেঠিকে ছাগলে খাইছে, অর্থাৎ জেঠির রোপণ করা গাছ ছাগল সাবাড় করে দিয়েছে। আর জ্যাঠার লাগানো গাছ ঝড়ে উড়ে গেছে।

গাছ রোপণ করা আমার শখ। ভালোবাসা বললেও বেশি বলা হবে না। নিজে রোপণ করি, বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বেড়াতে গেলে তাদের দিয়ে রোপণ করাই। যে রোপণ করে, গাছটা তার নামে বড় হতে থাকে। এই গাছ রোপণ নিয়ে বেশ কিছু গল্পও জমে গেছে আমার ঝুলিতে। আজকাল প্রকৃতির মাথার ঠিক নেই। গ্রীষ্মের সময় অঝোরে বৃষ্টি ঝরে, বর্ষার রোদে জ্বলেপুড়ে খাক হওয়ার দশা। গাছ কমছে বলেই যে এমন অবস্থা, তা কে না জানে? তাই আমার গাছ রোপণ-বিষয়ক সেই গল্পগুলোই শুনুন।

 ১.

গ্রামের বাড়িতে গেলে আমার একটা কাজ নির্দিষ্ট থাকে। রচনার ভাষায় যাকে বলে ‘বৃক্ষরোপণ অভিযান’। সোম ও বৃহস্পতিবার হাটবার। বাজারে গেলে মনে হয় সব চারা কিনে আনি। জায়গার সংকট, তাই বেছে বেছে চারা কিনতে হয়। এক সোমবারে ‘কোনো চারা কিনব না। শুধু ঘুরে ঘুরে দেখব’ ব্রত নিয়ে বাজারে গেলাম। তেজপাতাগাছে চোখ আটকে গেল। ব্যতিক্রমী গাছ। গ্রামে কারও বাড়িতে নেই। কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েও কেনা হলো না। দামে মিলল না। বাড়িতে গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করলাম। বড় ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে গেছি—এ রকম গলার স্বর করে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশিখ্যাত মাসি বলে উঠলেন, ‘বাবা, খুব ভালো করছিস, আনিস নাই। এগুলো বংশমারা গাছ।’

‘বংশমারা গাছ মানে?’

‘আগেকার বয়সীরা এসব বলত। এ রকম হইছেও। বাড়িতে তেজপাতাগাছ লাগালে বাড়ির কেউ না কেউ মারা যাবেই।’

‘তাই নাকি? কী ভয়ংকর কথা!’

‘হ বাবা। আনিস নাই। খুব ভালো কাজ করছিস।’

শেওড়া এবং তেঁতুলগাছে ভূত থাকে বলে শুনেছি। তেজপাতাগাছ নিয়ে গুজব নতুন। নতুন গুজবে নতুন সিদ্ধান্ত। ঠিক করলাম, আর ছাড় দেওয়া যাবে না। কিনতেই হবে। যত দামই হোক! বৃহস্পতিবার বাজার থেকে তেজপাতার চারা কিনে আনলাম। মহাসমারোহে রোপণ করা হলো। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, শহর থেকে বিরাট ব্যান্ড পার্টি আনা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় হাতির পিঠে বসে আছেন। সবাই বলে, তাঁর হাতে নাকি জাদু আছে। মৃত চারা লাগালেও মহিরুহে পরিণত হয়। যা–ই হোক, বৃক্ষরোপণ অভিযান শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। পরের দিন সকালে ঢাকায় ফিরে এলাম...।

দুই মাস পর বাড়িতে গিয়ে দেখি, গাছ মানুষ মারবে কী, গাছ নিজেই মরে আছে! ঘটনা হলো তেজপাতাগাছ পুরো গ্রামে এই একটাই। মাসির মেয়ে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তরকারিতে দেয়। আশপাশের বাড়ির লোক গাছ দেখতে এসে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। সারা জীবন তেজপাতা দোকান থেকে কিনেছে। এখন সাক্ষাৎ গাছ থেকে তেজপাতা ছেঁড়া, চাট্টিখানি কথা? এই অভিজ্ঞতা কি হাতছাড়া করা যায়? ফলাফল নতুন পাতা গজানোর আগেই পুরোনো পাতা শেষ। গাছ আর বেঁচে থেকে কী করবে?

 ২.

ফুল গাছের চারা রোপণ করছি। পাশে দাদু-দাদি দাঁড়িয়ে আছেন। দাদি বললেন, ‘ফুল গাছ তো লাগাইতেছিস। বাড়িতে সাপটাপ আসা শুরু করে নাকি দেখ।’

এই কথাটা আগেও শুনেছি। ফুলের ঘ্রাণ পেয়ে নাকি বাড়িতে সাপ আসে। দাদু আছেন আমার কৌতূহল মেটানোর জন্য। তাঁকেই প্রশ্ন করলাম, ‘দাদু, এটা কোনো কথা হলো? বিখ্যাত কবিতা আছে, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই। কবি কি তাহলে সাপসমাজের প্রতিনিধি হয়ে এই কবিতা লিখেছেন? তারপর ধরেন, প্রেমের প্রতীক ফুল। প্রেমের প্রকাশই তো হয় ফুলের মাধ্যমে।’

‘কবির বিষয় জানি না। তবে প্রেম-সাপ দুটোই একই! বড় হ। বুঝতে পারবি।’

 ৩.

আরেকবারের ঘটনা। কাঁঠালের চারা লাগাচ্ছি। গর্ত খোঁড়া শেষ। চারাটা গর্তে রাখব, ওমনি পেছন থেকে গ্রামের এক মুরব্বি ডাক দিলেন।

‘কিছু বলবেন, চাচা?’

‘বাবা, ওভাবে তো কাঁঠালের চারা লাগালে হবে না।’

‘সব চারা তো এভাবেই লাগালাম, চাচা। কাঁঠালের আলাদা নিয়ম নাকি?’

‘হ বাবা। শোনো, বলি তাহলে। যে চারাটা লাগাবে, অর্থাৎ যার হাতে চারাটা থাকবে, তার কোমর ধরে থাকতে হবে দুজনকে। ওই দুজনের কোমর আবার ধরে থাকবে অন্য চারজন। ওই চারজনের কোমর আবার...’

‘জি চাচা। বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন?’

‘এভাবে চারা লাগালে কাঁঠালও ওভাবে থোকা থোকা ধরবে।’

‘ও আচ্ছা। এই কাহিনি।’

‘এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যার হাতে চারাটা থাকবে, তাকে অবশ্যই তখন মুখে চিনি রাখতে হবে কিংবা মিষ্টি খেতে হবে। তাহলে কাঁঠাল মিষ্টি হবে।’