উগান্ডার মন্ত্রীর ছায়ারহস্য

দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে উগান্ডার এক মন্ত্রীর। মনটা খারাপ। অবশ্য এটা যে দুঃস্বপ্ন, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাঁর বুকে ‘সুখের মতো ব্যথা’-টাইপের অনুভূতি হচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। আয়নায় তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। কী আশ্চর্য! আয়নায় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না!

আয়নাটা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে স্ত্রীর ঘরে গেলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী তাঁকে দেখলেন, কিন্তু কোনো ভাবান্তর নেই। স্ত্রীর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এবার ঘাবড়ে গেলেন মন্ত্রী। এই আয়নাতেও তাঁকে দেখা যাচ্ছে না! স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার আয়নাটা কি নষ্ট হয়ে গেছে?’

তাঁর স্ত্রী একমনে নিজের কাজ করতে লাগলেন। কথা শুনেছেন, এ রকম কিছু মনে হলো না। এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীর গায়ে হাত রাখলেন, নাম ধরে ডাকলেন, চিৎকার করলেন কিন্তু তাতে অবস্থার পরিবর্তন হলো না।

মন্ত্রী মহোদয় বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। রোদ উঠেছে। আশপাশের সবকিছুর ছায়া পড়েছে অথচ তাঁর ছায়া পড়েনি! ‘আরে, ভূত হয়ে গেলাম নাকি!’—মনে মনে ভাবলেন তিনি। পুত্র-কন্যার নাম ধরে ডাকলেন। কেউ সাড়া দিল না। কাজের মেয়েটা তাঁর সামনে দিয়ে চা নিয়ে গেল, সে-ও ফিরে তাকাল না। তিনি কাজের মেয়েটাকে চা দিতে বললেন, কিন্তু সে কোনো ভ্রুক্ষেপই করল না। মন্ত্রী মহোদয় বাড়ির প্রতিটি সদস্যের সামনে দিয়ে হাঁটছেন, চলছেন, ডাকছেন, কথা বলছেন, অথচ কেউ তাঁকে দেখতে পাচ্ছে না! দুপুরের মধ্যে মন্ত্রী মহোদয় নিশ্চিত হলেন, বড় কোনো গন্ডগোল হয়ে গেছে। তিনি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসলেন। এবার নিজেই নিজের মাথার স্পর্শ অনুভব করলেন না।

সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বার। ‘পাগলের ডাক্তার’ হিসেবে একসময় অনেক খ্যাতি ছিল এই লোকের। চেম্বারে সাইকিয়াট্রিস্ট ছাড়া আর কেউ নেই। মন্ত্রীকে চেম্বারে ঢুকতে দেখে সাইকিয়াট্রিস্ট চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। হ্যান্ডশেক করলেন। হাত কচলে বললেন, ‘আরে, মন্ত্রী মহোদয় যে! গরিবের চেম্বারে হাতির পাড়া!’

স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন মন্ত্রী। যাক, কেউ একজন অন্তত তাঁকে চিনতে পেরেছে। দেখতে পেরেছে। তিনি যে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েননি, এই ভেবে খানিকটা আশার আলো দেখতে পেলেন।

সমস্যা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন সাইকিয়াট্রিস্ট।

: আয়নায় নিজেকে দেখছেন না?

: না।

: কেউ আপনাকে দেখতে পাচ্ছে না?

: আপনি ছাড়া কেউ আমাকে দেখতে পায়নি।

: ছায়াও পড়ছে না?

: না।

: সমস্যা তো খুবই গুরুতর।

: কী রকম?

: মনে হচ্ছে, আপনি গুম হয়ে গেছেন।

: কী সব বলছেন! আমি গুম হতে যাব কোন দুঃখে!

: সেটা তো আমারও প্রশ্ন। আচ্ছা, কখন থেকে এমনটা হচ্ছে, বলুন তো।

: সকাল থেকে।

: রাতে কি কিছু হয়েছিল?

: না। কিছুই হয়নি।

: ভালো করে ভেবে দেখুন। কোনো স্বপ্ন-টপ্ন?

: হ্যাঁ হ্যাঁ, স্বপ্ন একটা দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা কি আপনাকে বলা ঠিক হবে?

স্বপ্নের কথা ওঠায় লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন মন্ত্রী মহোদয়।

: মন্ত্রী মহোদয় বলুন। মনের ডাক্তারের কাছে কিছু গোপন রাখতে নেই।

কিছুক্ষণ ভেবে বলতে শুরু করলেন মন্ত্রী, ‘শুনুন ভাই, এত দিন মনে হতো আমার জীবনটা সফল। জীবনে কখনো ব্যর্থ হইনি। কাল রাতে শুয়ে শুয়ে জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম। ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে অল্প কিছুদিনের জন্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। বুকে সাহস নিয়ে তাকে জানিয়েছিলামও একদিন। কিন্তু মেয়েটা রাজি হয়নি। কিছুদিন খুব কষ্টে কেটেছে। প্রথম প্রেম বলে কথা! তবে এরপর নানান ব্যস্ততায় তাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। কাল স্বপ্নে ওর মুখটা দেখে বুকের মধ্যে আবার কেমন কেমন যেন করে উঠল!

‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে উঠলেন সাইকিয়াট্রিস্ট। টেবিলে চাপড়ে বললেন, ‘আপনার গুম হওয়ার কারণ পেয়ে গেছি।’

‘কী কারণ?’ আগ্রহী চোখে তাকালেন মন্ত্রী।

: আপনি সব দিক দিয়ে সফল হলেও, প্রেমে কিন্তু ব্যর্থ। ঠিক?

‘তা কিছুটা ব্যর্থ বলা যায়।’ আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন মন্ত্রী।

: কিছুটা না, পুরোটাই। এত দিন ভুলে ছিলেন। কিন্তু কাল রাতে তাকে স্বপ্নে দেখে এই এত দিন পরও আপনার বুকে কি কাঁপুনি দেয়নি?

: একদম যে দেয়নি, তা নয়।

: তাহলে তো হলোই।

: কী হলো?

: আরে ভাই, আপনার রহস্য উম্মোচিত হলো। আপনি আসলে প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন বলেই সকাল থেকে আপনি নিখোঁজ। মানে গুম হয়ে গেছেন। কেউ আপনার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে না, আয়নায় বিম্ব দেখা দিচ্ছে না, রোদে আপনার ছায়া পড়ছে না...

থম মেরে আছেন উগান্ডার মন্ত্রী। নিজের গুম হয়ে যাওয়ার রহস্য বুঝতে পেরে কিছুটা স্বস্তিও অবশ্য পাচ্ছেন। সাইকিয়াট্রিস্টকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিতে যাবেন। দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

: আচ্ছা ভাই, একটা ব্যাপার। সকাল থেকে কেউ আমাকে দেখতে পেল না, অথচ আপনি আমাকে দেখলেন। শুধু দেখলেন না, চিনেও ফেললেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

: হা হা হা, এই কথা! আসলে হয়েছে কি, আপনি যেমন গুম হয়ে গেছেন, আমিও গুম হয়ে আছি। আপনার মতো আমারও রোদে ছায়া পড়ে না।

: বলেন কী? আপনি গুম হলেন কীভাবে? আপনারও কি ফার্স্ট ইয়ারের প্রেমটাইপের কেস?

: না না, তা নয়। আপনি যেমন প্রেমে ব্যর্থ হয়ে গুম হয়েছেন, আমি হয়েছি ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে।

: আহা রে! কিন্তু পাগলের ডাক্তারিতে আবার ব্যর্থ হলেন কীভাবে? আপনাদের তো সব সময়ই লাভ হওয়ার কথা। দেশভর্তি পাগল...

: কথা ভুল বলেননি। তবে সমস্যা কি জানেন, দেশভর্তি পাগল থাকলেও চেম্বার বলতে গেলে চলেই না।

: কিন্তু কেন?

: কেন আবার। পাগলেরা দেশের বড় বড় পদ দখল করে বসে আছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন জনগণের টাকায় বিদেশে যায় চিকিৎসা নিতে। আমাদের চেম্বার খালিই পড়ে থাকে। ব্যবসায় ব্যর্থ না হয়ে উপায় কী?