নাচের সম্ভাবনা অন্তহীন

ওয়ার্দা রিহাব ও লায়লা হাসান। ছবি: সুমন ইউসুফ
ওয়ার্দা রিহাব ও লায়লা হাসান। ছবি: সুমন ইউসুফ

রাসেল মাহ্‌মুদ: দুই প্রজন্মের নৃত্যিশল্পী আপনারা। লায়লা হাসান যখন শুরু করেছেন, এ দেশে নাচের তখন প্রাথমিক পর্ব। এর পরম্পরায় ওয়ার্দা রিহাবসহ অনেকেই এসেছেন এই মাধ্যমে। শুরুতেই লায়লা আন্টির কাছে জানতে চাই, কেমন ছিল আপনাদের সময়টা? তখন নাচ করাটা সহজ ছিল?

নাচের ভঙ্গিতে শামীম আরা নিপা ও িশবলী মহম্মদ
নাচের ভঙ্গিতে শামীম আরা নিপা ও িশবলী মহম্মদ

লায়লা হাসান: না। আমাদের সময়টা ছিল বেশ রক্ষণশীল। তবে এখনকার মতো এতটা না। তখন যাত্রাপালায় মেয়েদের চরিত্র ছেলেরা করত, তেমনি মেয়ে হয়ে নাচ করত অনেক ছেলে। আমার খুব একটা সমস্যা পোহাতে হয়নি। আমি যে পরিবারের মানুষ ছিলাম, তাতে পরিবারের সহায়তা পেয়েছি অনেক।

ওয়ার্দা রিহাব: লায়লা আন্টিরা নাচের পথকে সুগম করে দিয়েছেন। তবে আমাদের সময়ে চ্যালেঞ্জ ও প্রতিযোগিতা—দুটোই বেশি। নিজের অবস্থান তৈরি করতে এবং সেটাকে টিকিয়ে রাখতে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে।

রাসেল: দেশের নৃত্যাঙ্গনকে যেখানে দেখতে চেয়েছিলেন, সেখানে কি পৌঁছেছে?

লায়লা: আমাদের সময় থেকে অনেক এগিয়েছে। সুযোগ বেড়েছে। এখনকার শিল্পীরা দেশের বাইরে থেকে শিখে-পড়ে আসছে। নাচের শিক্ষার্থী এখন প্রচুর। তারা টেলিভিশন, মঞ্চ বিভিন্ন জায়গায় কাজের সুযোগ পাচ্ছে। এটা আরও প্রশস্ত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নৃত্যকলা বিভাগ খুলেছে। সেখানে যদি বিশদভাবে শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে নাচে আমাদের অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।

ওয়ার্দা: একটু যোগ করতে চাই, শুধু শারীরিকভাবে নয়, একজন নৃত্যশিল্পীকে মানসিকভাবেও শিল্পী হয়ে উঠতে হবে। একটি সেফটিপিন লাগানোর পারদর্শিতাও একজন নৃত্যশিল্পীর গুণ। কীভাবে চলতে হবে, বলতে হবে, তার পরিমিতি মানুষের ভেতরে তৈরি করে দেবে একাডেমি। আর আমরা চাই, কলেজগুলোতেও নাচ চালু হোক। তাহলে শিক্ষিত নৃত্যশিল্পী গড়ে উঠবে। পরে এই নাচ নিয়ে গবেষণা হবে। এখন যেমন ড্যান্স থেরাপি নিয়ে কাজ হচ্ছে। সংশোধনাগারে, কারাগারে নাচের মাধ্যমে থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের স্বপ্ন, স্কুল-কলেজে নাচ চালু হবে। তাতে ঘরে ঘরে অন্তত একজন নৃত্যশিল্পী থাকবে। শুধু লোকনৃত্য নয়, সেগুলোকে ব্যাকরণে ফেলে শাস্ত্রীয় নৃত্যে রূপ দেওয়া হবে। যেমনটি পাশের দেশ করতে পেরেছে এবং বিশ্বব্যাপী সেগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছে।

রাসেল: কীভাবে সম্ভব এসব? ভেবেছেন এর রূপরেখা কী হতে পারে?

ওয়ার্দা: এসবের জন্য যে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার, তা আমাদের দেশে নেই। পাশের দেশ তার শিল্পীদের অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করে। গ্র্যান্ড দেয়, স্কলারশিপ দেয়।

লায়লা: সহযোগিতা ছাড়া নৃত্যশিল্পীরা কীভাবে এগোবে? সংসার চালাতে হবে তাঁদের। খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। শুধু নাচ নিয়ে পড়ে থাকলে রোজগারের উপায় কী হবে?

ওয়ার্দা: অনেক ছেলেমেয়ে নাচ নিয়ে পড়াশোনা করছে, কিন্তু সরকারি কোনো বৃত্তি পায় না তারা। ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে আমরা সে দেশে পড়তে যাচ্ছি এখনো। আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এটা করতেই পারত। আমাদের অনেক মেধাবী নৃত্যশিল্পী আছে। তাদের যদি দেশের বাইরে থেকে শিখে আসার সুযোগ করে দেওয়া হতো, ভালো হতো।

লায়লা: এতে সমৃদ্ধ হতাম আমরাই। তারা শিখে এসে অন্যদের শেখাত। দেখো, নাচের মাধ্যমে কিন্তু আমরা নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছি। নৃত্যশিল্পীরা স্বাধীন ও নান্দনিক চর্চার মাধ্যমে দেশের নারী জাগরণে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন পারছেন নারী পোশাকশ্রমিকেরা।ঘর থেকে বেরিয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন তাঁরা।

ওয়ার্দা: টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তেমন রুচিকর কিছু পাচ্ছি না। মঞ্চে ভালো নাচ দেখতে আসে বড়জোর এক হাজার দর্শক। টিভিতে লাখ-লাখ দর্শক নাচ দেখতে পারেন। সেখানে যদি সত্যিকারের রুচিশীল নাচগুলো দেখানো না হয়, তাহলে সুস্থ নৃত্যসমাজ কখনোই গড়ে উঠবে না।

রাসেল: নাচে আমরা নতুন ফর্ম তৈরি করতে পারছি না কেন? কেনই বা আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী নাচগুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠছে না এ দেশীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা?

লায়লা: নতুন কাজ করতে চায় সবাই। কিন্তু পেরে ওঠা মুশকিল। পৃষ্ঠপোষকতা দিলেই কেবল সেটা সম্ভব। বিদেশে যিনি নাচ করেন, তিনি শুধুই নাচ করেন। তাঁর পরিবারের দায়িত্ব নেয় সরকার। আমরা নাচ করতে করতে ভাবি, চুলায় রান্না বসানো আছে। এসব চিন্তা থেকে মুক্তি না পেলে নতুন ফর্ম কীভাবে আসবে?

ওয়ার্দা: বাংলাদেশে নাচের দুটি ফর্ম আরও সংহতভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। একটি গৌড়ীয় নৃত্য, অন্যটি চর্যা নৃত্য। অনেক সুযোগ আছে আমাদের। আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী তথা লোকনৃত্য রয়েছে। সেগুলোর নামই জানে না তেমন কেউ। দু-একজন সেসব নিয়ে গবেষণা করছেন। যাঁরা লোকনৃত্য নিয়ে এত দিন কাজ করেছেন, তাঁরা এখন পরিবেশনও করছেন।‘মনসা মঙ্গল’, ‘জারি নাচ’, ‘সারি নাচ’—এসবের জন্য যদি ‘গ্র্যান্ড’ দেওয়া হতো, তাহলে এগুলো আরও এগিয়ে যেত। গ্রামগঞ্জে গিয়ে আমাদের এগুলো দেখতে হচ্ছে এখনো। এ নাচকে বড় পরিসরের মঞ্চে নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশের নাচ আরও বহু দূর পৌঁছে যেত!

রাসেল: ইউটিউবে এখন সারা বিশ্বের নাচ দেখা যায়। যে কেউ নিজে নাচ করে প্রকাশ করতে পারে। টিভি ও মঞ্চের পাশাপাশি এ এক বিকল্প শেখা ও দেখার মাধ্যম। এটা কতটা কার্যকর বলে মনে হয় আপনাদের?

লায়লা: সহজলভ্য জিনিস কিন্তু বেশি দিন টেকে না। একটা-দুটো জিনিস শিখে বেশি দূর এগোনো যায় না। আর ইউটিউব থেকে দেখে খুব একটা শেখা যায়ও না। নাচ গুরুমুখী বিদ্যা। তবে ইউটিউবের ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। সেখান থেকে বিদেশি নাচ নিয়ে নিজের মতো ব্লেন্ড করে আপন সংস্কৃতির সঙ্গে যেটুকু চলনসই, সেটুকু নেওয়া যায়।

ওয়ার্দা: আমি কিন্তু ব্যাপারটিকে ইতিবাচক মনে করি। বাংলাদেশে আমরা যেসব ফর্ম নিয়ে কাজ করছি, দেশের অনেকেই সেসব জানতে পারছে না। গুগলে খুঁজলে অন্তত সেগুলো জেনে নেওয়া যায়। ইউটিউবে সেসব দেখা যায়, এটা একটা বড় সুবিধা। একটা ধারণা নেওয়া বা জানতে চেষ্টা করার জন্য এটা খারাপ না। তবে লায়লা আন্টি যা বললেন, সেখান থেকে শিখলে কাজে আসবে না খুব একটা। আর যারা কপি-পেস্টে বিশ্বাসী, তারা খুব একটা সুবিধা নিতে পারবে না এ মাধ্যম থেকে। এ ছাড়া ইউটিউবের মাধ্যমে অনেক ড্যান্স ফর্ম সম্পর্কে মানুষ জানতে পেরেছে। মডার্ন ড্যান্স ও ব্যালে দেখতে পারছে মানুষ। নতুন অনেক টার্ম সম্পর্কে জেনে দেখে নিতে পারছে, যেমন ‘মোহিনী আট্টম’, ‘কাথাকলি’।

রাসেল: নৃত্যগুরুদের থেকে আপনারা যেভাবে শিখেছেন, এখন সেভাবে শেখার সুযোগ আছে?

লায়লা: বাবার কাছে শুনেছি, আমার হাতেখড়ি হয়েছিল শ্রী মণিবর্ধনের কাছে। নানাবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকি তখন, আমি এত ছোট যে গুরুকে চিনতাম না। পরে শিখেছি ডা. সাজেদুর রহমানের কাছে। তিনি ‘কুয়াশা’ নামে লিখতেন। ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে অবসরে গেছেন। তারপরে বুলবুল একাডেমিতে। এ ছাড়া অজিত সান্যালের কাছে শিখেছি, তিনি বুলবুল চৌধুরীর সরাসরি ছাত্র। ‘কত্থক’ শিখেছি সমর ভট্টাচার্যের কাছে। এ রকম আরও গুরু ছিলেন আমার। তবে ওয়ার্দাদের শিক্ষাটা আরও কার্যকর। আমরা হাত-পা নেড়ে নাচ শিখেছি। পড়াশোনাটা শেখা হয়নি। ওরা আমাদের থেকেও এগিয়ে গেছে। শিক্ষকদের থেকেও এগিয়েছে।

ওয়ার্দা: অনেকে পড়াশোনা করেছেন, অনেকে সেই সুযোগ পাননি। লায়লা আন্টি অনেক গুরুর নাম বলেছেন। কিন্তু আমরা স্পেশালাইজেশনের যুগে বড় হয়েছি। এক গুরুর ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হয়েছে। আমার মনে হয়, শিক্ষক ও গুরুর মধ্যে পার্থক্য আছে। গুরু মাথা থেকে পা পর্যন্ত তৈরি করে দেন। একজন নৃত্যশিল্পীর অনেক শিক্ষক থাকতে পারেন। অল্প সময়ের জন্য অনেকের কাছে শিখতে হয়।

দুজন বড় গুরুর কাছে আমি নাচ শিখেছি। একজন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছায়ানট থেকে আমি তাঁর কাছে যাই। টানা ২৫ বছর শিখেছি নৃত্যনন্দনে। আর মণিপুরি শিখেছি ভারতের কলাবতী দেবীর কাছে। ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শুধু নাচ নিয়েই থাকতাম সেখানে। কলাবতী দেবী মনে হয় একটা কলাগাছকেও নৃত্যশিল্পী বানিয়ে দিতে পারবেন। এত শ্রম দেন তিনি! আমার ছাত্রছাত্রীদের সেভাবেই শেখাচ্ছি। তারা বড় বড় জায়গায়, দেশের বাইরে একক পরিবেশনায় ভালো করছে, প্রশংসা পাচ্ছে। আমাকে আমার গুরুরা যেভাবে তৈরি করেছেন, আমিও তাদের সেভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছি। একই শরীরে অনেক ধরনের নাচ ধারণ না করাই ভালো। আমি ১৭ বছর ‘ভরতনাট্যম’ করেছি। কিন্তু এখন ‘মণিপুরি’ ছাড়া আর কিছু করি না। ছায়ানটে ভরতনাট্যম, মণিপুরি—দুটোরই ক্লাস নিতাম। ১০ রকম ফর্মে কাজ করলে কোনোটাই ভালোভাবে করা যায় না। কোরিওগ্রাফিতেও সেই চেষ্টা করি। সাধনা থেকে ‘তাসের দেশ’ প্রযোজনাটি যখন করেছি, মণিপুরিকে ব্লেন্ড করে সেটার ভেতরে রাখার চেষ্টা করেছি।

রাসেল: নাচকে নিরাপদ পেশা হিসেবে নেওয়া যায় তাহলে?

ওয়ার্দা: নিরাপদ পেশা হিসেবে নিতে পারবে, যদি মনের জোর থাকে। আমি পেরেছি। অনেক পুরুষ নৃত্যশিল্পীকে দেখেছি তাঁরা সংসার চালাচ্ছেন নাচ করে।

লায়লা: আমি দ্বিমত পোষণ করব। আমার মনে হয়, সেটা কঠিন হবে। দেশে এখন বড়জোর ১০-১৫ জন সেটা পেরেছে। শুধু নাচকে পেশা করা খুব জটিল। বেশ কষ্ট করতে হয়।

ওয়ার্দা: কিন্তু নাচ ছাড়া এখন কোনো অনুষ্ঠানই হয় না।

লায়লা: সবাইকে সমান সম্মানী দেওয়া হয় না। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। নাচের থেকে এখন সাজসজ্জায় বেশি মনোযোগ দিচ্ছে সবাই। যেন নাচ নয়, সাজটাই প্রধান। নজরুলের গানের সঙ্গে নাচ করতেও একগাদা গয়না পরছে। ভাব বুঝে নাচের পোশাক ঠিক করছে না বেশির ভাগ কোরিওগ্রাফার।

ওয়ার্দা: দেখা গেল, ‘চণ্ডালিকা’র প্রকৃতিকে রাজরানির মতো সাজিয়েছে। বুঝতে হবে, এটা ‘আমি’ না, চরিত্র।

রাসেল: চলচ্চিত্রে কীভাবে শুদ্ধ নাচ যুক্ত করা যায়?

লায়লা: চলচ্চিত্রের নাচে নির্দেশনা কারা দিচ্ছেন? তাঁরা কি নৃত্যশিল্পী বা শিক্ষক? ন্যূনতম রুচির জায়গা নিশ্চিত করতে পারছেন তাঁরা? না। বাণিজ্যিক ছবি করতে হয় বলে নাচটাকেও তাঁরা বাণিজ্যিক করে ফেলেছেন। বাদী থেকে বেগম, বসুন্ধরা—এ ছবিগুলোতে গহর জামিল সাহেবের নির্দেশনায় দুটি নাচ হয়েছিল, অসাধারণ। প্রযোজক-পরিচালক কী চান, সেটার ওপর নির্ভর করে এখন নাচ করতে হচ্ছে।

ওয়ার্দা: একটি বাংলা ছবিতে কাজের সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে বাজেট বড় সমস্যা। হরেদরে অরুচিকর কাজের বাজেটে ভালো কাজ করা যায় না। বাংলাদেশের বাইরে থেকে নৃত্য পরিচালক আনা হচ্ছে, জুড়ে দেওয়া হচ্ছে অশ্লীল নৃত্য। সিনেমায় তো সব বাণিজ্যিক নাচ থাকে না। রুচিশীল একটি-দুটি নাচ রাখলে যে ছবিটা ভালো হয়, সেটা ভাবেন না নির্মাতারা। এ জন্য সিনেমা থেকে সরে এসেছি। আর টিভিতে? মডেল দিয়ে নাচ করানো হচ্ছে। ওগুলো নাচ না। অথচ ঢাকার বাইরে নাচের নামে এগুলোই ছড়িয়ে পড়ছে।